পাকিস্তানের বিতর্কিত বালোচিস্তানে নিয়মিত পূজিত হন দেবীদুর্গা

দূরে অনেক দূরে যেখানে কাশফুলের দোলা লাগে না৷ শিউলির রূপে রূপসী হয়না ভোর৷ আকাশ জুড়ে শরতের সাদা মেঘের খেলা দেখা খুবই কঠিন৷ এমনই এক শুষ্ক প্রান্তরে পূজিত হন দেবী দুর্গার এক প্রতিরূপ৷ ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম এই পীঠ শুধু হিন্দুদেরই নয়, এর মাহাত্ম ছড়িয়ে রয়েছে মুসলিমদের মধ্যেও৷ দেবী দুর্গা এখানে মাতা হিংলাজ৷ এলাকাটি হল পাকিস্তানের অত্যন্ত বিতর্কিত বালোচিস্তান প্রদেশ৷

আরব সাগর তীরবর্তী পাকিস্তানের এই অঞ্চলটির সঙ্গে মিশে রয়েছে ইরান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত৷ স্বাধিকার অর্জনের দাবিতে ১৯৪৭ সালের পর থেকেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘর্ষ শুরু করেছেন বালোচরা৷ এই বিদ্রোহী বালোচদের অভিযোগ, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ কায়েম করার চেষ্টায় পাকিস্তান সরকার লাগাতার মানবতা বিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে বালোচিস্তানে৷

বিতর্কের মাঝেই নিয়মিত আরাধনা হয় বালোচিস্তানের দুর্গা বলে পরিচিত মাতা হিংলাজের৷ প্রয়াত সাহিত্যিক অবধূত যখন হিংলাজ দর্শন করেছিলেন তখনও ভারত অখণ্ড৷ এরপর দেশভাগ হয়েছে৷ গঙ্গা ও সিন্ধু দিয়ে অনন্ত জলরাশি ছুটে গিয়েছে মোহনার দিকে৷ অবধূত রচিত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ পড়ে শিহরিত হয়েছেন পাঠক-পাঠিকরা৷ একই নামে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা ছবি৷ বিশাল মরুভূমি (থর ও মাকরান) পার করে দেবী হিংলাজ দর্শনের যে কাহিনী লিখেছিলেন অবধূত, তারই চলচ্চিত্রায়নে মজেছিলেন দর্শকরা৷ছবিতে ‘পথের ক্লান্তি ভুলে ….’  গানে দুর্গম সেই যাত্রার বর্ণনা উঠে এসেছিল৷ হিংলাজ যাত্রা কত কঠিন সেই উপলব্ধি আরও স্পষ্ট হয়েছিল৷

এখনও হিংলাজ দর্শন যে কোনও ভারতীয় তীর্থযাত্রীর কাছে কঠিন৷ কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে ভিসা পাওয়াই দুরহ৷ তার উপর বালোচিস্তান প্রদেশ নিয়ে বিতর্কে জের৷ ফলে দেবী হিংলাজ দর্শনে যাওয়া কঠিনতর হয়েছে৷

হিংলাজ দেবীর মাহাত্ম্য:

পৌরাণিক কথা অনুসারে দক্ষ রাজা বৃহস্পতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর কন্যা সতী মহাদেবকে বিয়ে করেছিলেন৷ এতেই রেগে যান দক্ষ রাজা। আয়োজন করেন এক যজ্ঞের৷ সেখানে সকল দেব দেবীকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমন্ত্রণ জানানো হয়নি মহাদেবকে৷  কিন্তু  মহাদেব সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। দক্ষ রাজা মহাদেবকে অপমান করেন। স্বামীকে অপমান সহ্য করতে পারেননি দক্ষ কন্যা সতী৷  তিনি আত্মাহুতি দেন। শোকাহত মহাদেব যজ্ঞ ভণ্ডুল করে স্ত্রীর  মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। বিষ্ণু  তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতী দেবীর মৃতদেহ ছেদন করেন। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে দেবীর দেহাংশ৷

যে স্থানে দেহাংশগুলি পড়েছে পরবর্তী সময়ে সেই স্থান শক্তিপীঠ (৫১টি) হিসেবে পরিচিত হয়েছে৷ আধুনিক পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশের হিঙ্গুলায় পড়েছিল দেবীর ব্রহ্মরন্ধ্র৷ সেটিও একটি শক্তিপীঠ৷ হিংলাজ মাতার মন্দির ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের অন্যতম ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবেই পরিচিত৷ হিঙ্গোল নদীর তীরে বিখ্যাত হিঙ্গোল অভায়রণ্যের মধ্যে গুহায় রয়েছে এই শক্তিপীঠ৷

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মুসলিমদের মধ্যেও বিশেষ মাহাত্ম রয়েছে দেবী হিংলাজের৷ তাঁদের কাছে এই মন্দির ‘নানি মন্দির’ হিসেবে পরিচিত৷ ‘নানি কি হজ’ বা নানি দর্শন করতে প্রতি বছরই হিংলাজে আসেন বহু মুসলিম পূণ্যার্থী৷ মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণেও পাকিস্তান সরকার বিশেষ উদ্যোগ নেয়৷

শারদোৎসবে মেতে উঠবে বাংলা৷  দুর্গা আরাধনায় দেশজুড়ে পালিত হবে নবরাত্রী৷ পাকিস্তানেও পালিত হবে সেই উৎসব৷আর ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে ধর্মীয় বন্ধন দূরে ঠেলে সম্প্রীতির এক অসাধারণ উদাহরণ হয়েই পূজিত হবেন বালোচিস্তানের দুর্গা হিংলাজ মাতা৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.