জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর যে ইসলামিক পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তার ছিল দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। গোটা পূর্ব পাকিস্তান ছিল একটি রাজ্য বা প্রদেশ। আর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল চারটি রাজ্য বা প্রদেশ। যথা—পঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয় উর্দু। যদিও উর্দু কোনো রাজ্যের জনগণেরই মাতৃভাষা নয়। পঞ্জাবের পঞ্জাবি, সিন্ধুর সিদ্ধি, বালুচিস্তানের বালুচ ও সীমান্ত প্রদেশের পুশতু এবং পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গের বাংলা। মূলত পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশ মাত্র। উর্দুভাষা পূর্ববঙ্গের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে শেষ পর্যন্ত শুরু হয় যুদ্ধ।
৭১-এর ২৫ মার্চের মধ্যরাতে সশস্ত্র পাকসেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালির উপর। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। গঠিত হয় গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সেই সরকারের অনুরোধে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে অবতীর্ণ হয় মুক্তিযুদ্ধে। প্রায় দশমাসের দুর্বার লড়াইয়ের পর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পাক বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। জেনারেল নিয়াজি তিরানব্বই হাজার পাকসেনা- সহ ঢাকায় যৌথ বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে করেন আত্মসমর্পণ। আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতালাভ, ভারত- বাংলাদেশ মৈত্রী ইত্যাদি সবই ঠিক এবং বাস্তব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ কী? ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সৃষ্টিতে হিন্দুদেরও রয়েছে অবদান। তারাও রক্ত ঝরিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। ৭০ সালের নির্বাচনে পাক জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামি লিগ। এই গরিষ্ঠতা লাভ কী শুধু হিন্দু ভোটে সম্ভব ছিল ? তখন বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫-১৬ শতাংশ। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় অধিকাংশ মুসলমান বলতো, তারা আওয়ামি লিগে ভোট দেয়নি, ভোট দিয়েছে হিন্দুরা। তারা পাকিস্তানের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধ চায় না। অর্থাৎ, বাংলাদেশ যুদ্ধের জন্য হিন্দুরা দায়ী। বাংলাদেশের চারটি মূলনীতির একটি হচ্ছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। অথচ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন সংবিধানে ঢোকানো হয়, বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ কথাটি। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে হয়ে যায় ইসলামিক রাষ্ট্র। হাসিনা সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুধু ব্যাপকভাবে হিন্দু কবি, লেখকদের লেখাই শুধু বাদ দেওয়া হয়নি, হিন্দু গন্ধযুক্ত শব্দগুলিকে বাদ দিয়ে সেখানে ঢোকানো হয়েছে ইসলামিক শব্দ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলীয় নেতা-মন্ত্রীরা সর্বদা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলেন, অথচ তারাই আবার ভোটের স্বার্থে ইসলামিক দলকে জোটে নিচ্ছেন। বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের নেতা-মন্ত্রীরাই সবচেয়ে বেশি হিন্দু-সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন এবং তাঁদেরই বাধায় হাসিনা সরকার আজও পাক সরকারের কুখ্যাত ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ বাতিল করতে পারেনি। ফলে বহু হিন্দুর সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে ও যাচ্ছে। হাসিনা সরকারেরই কিছু অনৈতিক নীতিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিনহা আইনসিদ্ধ করতে বা মান্যতা দিতে অস্বীকার করায় তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দালাল, ঘুষখোর, বিরোধী খালেদা জিয়ার দল বিএনপির সমর্থক, আর্থিক জালিয়াত ইত্যাদি অবমাননাকর অভিযোগ তুলে তাকে দেশ থেকে সরকার তাড়িয়েছে। অসাম্প্রদায়িক আওয়ামি সরকারের আমলেই বাংলাদেশে ঘটেছে বহু হিন্দু নির্যাতন, হিন্দুনারী অপহরণ, ধর্ষণ, হিন্দুদের সম্পত্তি জবর দখল, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, বাস্তুভিটে থেকে উৎখাত ইত্যাদি ঘটনা। ঘটছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, দিনাজপুরের ঠাকুর পাড়ার হিন্দুবাড়ি লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মারধর, মন্দির ভাঙচুর ইত্যাদি সাম্প্রতিক ঘটনা হিন্দু উৎপীড়নের জ্বলন্ত উদাহরণ।
কাজেই পূর্বপাকিস্তানে মুসলমানরা হিন্দুদের উপরে যেভাবে অত্যাচার চালাত, দেশত্যাগে বাধ্য করত, স্বাধীন বাংলাদেশেও তাই চলছে। তাই হিন্দুরা পূর্বপাকিস্তানে ছিল যে তিমিরে, বাংলাদেশেও আছে সেই তিমিরেই। শহিদ দিবস, বাংলাভাষা দিবস, স্বাধীনতাযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস ও ১৯৯৯ সালে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাংলাদেশের হিন্দুদের মনে কোনো রেখাপাত করেনা, করেনা আত্মতৃপ্তির সৃষ্টি। দেশভাগের সময় পূর্বপাকিস্তানে ছিল ২৯ শতাংশ হিন্দু। আর আজ মাত্র ৮ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হবে হিন্দু শূন্য এবং বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান দেশ হবে বাংলাদেশ।
শেখ মুজিবের অদূরদর্শিতা, রাজনৈতিক অপরিপক্কতা ও দেশশাসনে অবিচক্ষণতাই সপরিবারে তাকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছে। তাঁর কন্যা হাসিনা সেই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে কিছুটা শিক্ষা নিলেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের সুরক্ষায় তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। সম্প্রতি নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা এই প্রশ্নই তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি একজনও নির্যাতিত হিন্দুর পাশে দাঁড়িয়েছেন? তাদের মনে ভরসা জোগাতে পারছেন না। তাই বাংলাদেশের যে কোনো রাষ্ট্রীয় উৎসব হিন্দুদের কাছে বিবর্ণ, মূল্যহীন।
ধীরেন দেবনাথ