একটা সময় ছিল যখন প্রতিটি দেশের টেলিভিশন ও বেতার শুধু সরকারি কিছু নির্দিষ্ট খবরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। খবরের কাগজে সংবাদটি পৌঁছতে সময় লাগতো। অনেকটা পৌঁছতই না। সময়ের পট পরিবর্তনে বেসরকারি টিভি নিউজ চ্যানেলগুলি সমাজের তৃণমূল স্তরের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলে যথেষ্ট বাহবা কুড়িয়েছে সত্যি, কিন্তু অনেক সময় দেখা গেছে তারা কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঘেরা এবং ভুল তথ্য পরিবেশন করে সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। বর্তমান 4G-র জমানায় সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কোনও সত্যকে আর অপশক্তি দিয়ে চেপে রাখা সম্ভব নয়। সারা পৃথিবী যখন বসন্তের আগমনে রঙের ভুবন রাঙিয়ে তুলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন ভাইরাল হচ্ছে এক করুণ পিতার হৃদয়বিদারক আর্তনাদ— “আমার কন্যাদের ফিরিয়ে দাও, নয়তো পেট্রোল ঢেলে আমাকে জ্বালিয়ে দাও।” ঘটনাটি হোলির দিনে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের। সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজের দুই নাবালিকা বোন রিনা মেঘওয়ার (১৫) এবং রবিনা মেঘওয়ার (১৩)-কে স্থানীয় মালিক সম্প্রদায়ের মুসলমানরা অপহরণ নয়, জোর করে তুলে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের প্রশাসন মৌলবাদী হওয়ায় অসহায়। তারা এই পিতার অভিযোগ প্রথমে নিতে চায়নি। তাই অভাগা এই পিতার আর্তনাদ ছাড়া আর কী বা করার ছিল!
পাকিস্তানের ইংরেজি পত্রিকা ডনের এক তথ্যানুসারে সেখানে প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ২৫ জন হিন্দু মেয়েকে বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ করা হয়। সম্প্রতি বালাকোটে ভারতের এয়ার স্ট্রাইকে পাকিস্তানের মোল্লারা এতোটাই ক্ষিপ্ত হয়েছে যে বিগত কয়েকদিনের ব্যবধানে অন্ততপক্ষে ৭ জন হিন্দু নাবালিকাকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ফোর্সড কনভার্সন বা লাভ জিহাদ পাকিস্তানের ইসলামোফোবিকের একটা প্রধান অঙ্গ। শুধু পাকিস্তানে নয়। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এমনকী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এর বিষাক্ত জাল বিস্তৃত। ২০১৪ সালে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের স্বার্থে কাজ করা এক সংস্থার তরফে জানানো হয় প্রতি বছর অন্ততপক্ষে এক হাজার অমুসলমান বালিকাকে ধর্মান্তরকরণ করা হয় যাদের বয়স গড়ে ১২ বছর থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। সেখানে সংখ্যালঘুদের অবস্থা এতোই করুণ যে অপহরণকারীরা এই নাবালিকা মেয়েদের ঘর থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে নেয়। তারপর ২০-২৫ দিন আটকে রেখে করা হয় টানা বলাৎকার। এমতাবস্থায় রক্ষণশীল হিন্দু পরিবার এবং প্রতিবেশীদের কাছে এই মেয়েরা গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। ফলস্বরূপ তাদের পুরো জীবন নরক যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া আর কোনও উপায় বাকি থাকে না। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে স্থানীয় হিন্দু সংগঠন সংখ্যালঘু নাবালিকা মেয়েদের সুরক্ষা এবং সুবিচারের দাবিতে সংসদে আইন রূপায়ণের প্রস্তাব দেয় কিন্তু ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের প্রবল আপত্তিতে আইনটি প্রণয়ন হওয়ার আগে মাঝপথেই ভেস্তে যায়।
পাকিস্তানে মূলত অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্যের শিকার সংখ্যালঘু পরিবারকে বিশেষ করে টার্গেট বানানো হয়। স্থানীয় মুসলমান জমিদাররা তাদের সংখ্যালঘু ক্ষেতমজুরদের কন্যাদের লালসার শিকার করে। এইসব বল পূর্বক ধর্মান্তরকরণের পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করছে। স্থানীয় বিভিন্ন উগ্র মুসলমান সংগঠনের উস্কানিতে এই সমস্ত বর্বরতা অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ পায়। অনেক সময় নিম্নবিত্ত পরিবারের অমুসলিম বালিকাদের ভোগের আশায় যথেষ্ট পরিমাণে রেশন, অর্থ, এমনকী বাসস্থান দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে সর্বাধিক সংখ্যালঘু হিন্দুদের বসবাস। অপহরণের সিংহভাগই ঘটে প্রদেশটির হিন্দু অধ্যুষিত মিরপুরখা, থরপারকার ও উমেরকোট জেলায়। সম্প্রতি এই প্রদেশে জামায়েত উলেমা-ই-ইসলাম, জামাত-উল-দাওয়া, ফালাহ-ই-ইনসানিয়ত ফাউন্ডেশন ইত্যাদি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠনের বাড়বাড়ন্তের ফলস্বরূপ এই ধর্মান্তরকরণ। বিশেষ করে ভীল, মেঘওয়ার, কোহলি, ভাগরি প্রভৃতি তফশিলি গোষ্ঠীভুক্ত সংখ্যালঘু পরিবার এই ধর্মান্তরকরণের শিকার।
পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সমাজের উপর এমন অত্যাচার নতুন কিছু নয়, তাদের পাঠ্যপুস্তকে ধর্মের নামে শিশুদের কোমল মনে হিংসা ও জেহাদের বিষাক্ত বীজ বোপন করে দেওয়া হয়। US Commission On International Religious Freedom পাকিস্তানের প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়ন করে ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীলতা এবং অমুসলমানদের প্রতি ঘৃণার স্পষ্ট চিত্র প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। এই পুস্তকগুলিতে লেখা আছে হিন্দুদের সংস্কৃতি এবং সমাজ অন্যায় ও নিষ্ঠুরতার উপর প্রতিষ্ঠিত; অন্যদিকে ইসলাম শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা দেয়। চতুর্থ শ্রেণীর সামাজিক অধ্যয়নে লেখা মুসলমান বিরোধী শক্তি পৃথিবীতে ইসলামকে খতম করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ইতিহাস বইয়ে বারবার সোমনাথ মন্দির আক্রমণকারী গজনিকে বীরের সম্মানে বসিয়েছে, শেখানো হয় পাকিস্তানের জন্ম হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিচ্ছবি। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের উদ্ভবের কারণ হিন্দুদের চরম চক্রান্ত। কিন্তু একবারও উল্লেখ করা হয়নি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান কী হারে গণধর্ষণ, হত্যা বাঙ্গালিদের উপর করেছিল। সম্প্রতি পাকিস্তানের নবম ও দশম শ্রেণীর উর্দু বইকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ বইটির একটি অধ্যায় ‘পাকিস্তান কি কাহানিয়া হে’ এতই বিদ্বেষপূর্ণ যে আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তানকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়। তৃতীয় শ্রেণীর উর্দু পাঠ্যপুস্তকে লেখা ইসলাম বাকি সব ধর্ম থেকে শ্রেষ্ঠ। সপ্তম শ্রেণীতে লেখা অমুসলমানদের সহানুভূতি কেবল ফায়দার জন্য দেখানো হয়। পঞ্চম শ্রেণীর ইসলামিক অধ্যয়নে লেখা ছাত্র হওয়ার জন্য তোমরা হয়তো ইসলামিক জেহাদে অংশগ্রহণ করতে পারছো না কিন্তু আর্থিক মদত অবশ্যই করতে পারো। পাকিস্তানের সাধারণ শিক্ষা এমন হলে মাদ্রাসাগুলিতে কিরকম ব্রেইনওয়াশ চলছে তা সহজেই অনুমেয়। পাকিস্তান তাদের কৃতকর্মের জন্য পৃথিবীর তৃতীয়তম ধর্মীয় অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বাংলাদেশেও পাকিস্তানি মডেলে জেহাদি বীজ বপন করা হয়। তাদের পঞ্চম শ্রেণীর, ‘ইসলাম ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা’ পাঠ্য বইয়ের ১৬ এবং ১৭ নম্বর পাতায় অমুসলমানদের মিথ্যাবাদী, সম্পদ আত্মসাৎকারী এমনকী ‘পশুর চেয়েও অধম’ হিসাবে শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানের এই মৌলবাদী ব্রেনওয়াশের ফসল হচ্ছে তাদের জঙ্গিবাদ। নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই জঙ্গি হামলায় যথেষ্ট আন্তর্জাতিক সহানুভূতি লাভ করলেও আজ পর্যন্ত ধর্মীয় সংকীর্ণতার উধের্ব উঠতে পারেননি। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের মসজিদ হামলায় সমবেদনা জানিয়ে তিনি এক টুইট বার্তায় লেখেন, ‘Heartbroken for # Newzealand, Please pray for the victims and their families’, তখন একজন তাকে পাকিস্তানে বলপূর্বক দুই হিন্দু মেয়ের ধর্মান্তকরণ নিয়ে চুপ থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে মালালা চরম অসৌজন্যতায় তাকে ব্লক করে দেন। নিউজিল্যান্ড এবং পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের প্রতি মানসিকতার তার এত ফারাক কেন? পাকিস্তানে এর আগেও রিঙ্কল কুমারী, আসিয়া বিবিরা ঘৃণ্য ঘটনায় আন্তর্জাতিক শিরোনামে এসেছিল। এই বছরের জানুয়ারি মাসে সিন্ধু প্রদেশের রাজকুমারী তালরেজাকে সালার খান নামে এক দুষ্কৃতী গুলি করে হত্যা করে। মেয়েটির অপরাধ ছিল সে ধর্মান্তরিত হতে এবং বিয়ে করতে অসম্মতি জানিয়েছিল। পাকিস্তানে বাঁচার জন্য মুসলমান নাম রেখেও শেষ রক্ষা হয় না। ২০১৯ এর ৬ ফেব্রুয়ারি ১৩ বছরের ক্রিস্টান নাবালিকা সাদাফকে স্থানীয় মুবাসির হোসেন অপহরণ করে ধর্মান্তরিত করে। ২৪ মার্চ ২০১৯-এ আরেক নাবালিকা সোনিয়া ভিলকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। নাবালিকা রিঙ্কুল কুমারী, জীবানী বাগরি, অঞ্জলি মেঘওয়ার, কিরণ কুমারী, রিনা, রুবিনা এই রকম অভাগীদের নামের তালিকা কোথায় শেষ হবে? এটাই কি পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ‘নয়া পাকিস্তানের’ উদাহরণ যেখানে তিনি সংখ্যালঘুদের সমান নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়ার কথা বলেছিলেন? পাকিস্তানের শুধু পাঠ্যপুস্তকে নয় সেখানকার সাংসদরা মহান সংসদে দাঁড়িয়ে হিন্দুদের অপমান করতে বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করেন না। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের উপর পাশবিকতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করায় অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। কারণ এর আগে কেউ এভাবে পাক সংখ্যালঘুদের হয়ে আওয়াজ তুলেননি। সম্প্রতি ইউরোপীয়ান সংসদের ৫০ জন সদস্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রেরিত এক চিঠিতে জম্মু-কাশ্মীরে পিলেট গান ব্যবহার বন্ধ করা, সুরক্ষাবাহিনীর বিশেষ অধিকার অধিনিয়ম (আফস্পা) এবং জনসুরক্ষা কানুন (পি.এস.এ) বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানায়। কাশ্মীরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং ৩৫ (এ)-র মতো যে সুবিধা দেওয়া আছে সেটা হয়তো পৃথিবীর আর কোনও নাগরিকদের ভাগ্যে আজ পর্যন্ত জোটেনি। কিন্তু এর পরেও ইউরোপীয়ান সাংসদদের চিন্তার অন্ত নেই। এ রকম সামান্য দুশ্চিন্তা যদি কেউ পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য কিছুটা হলেও করতেন তাহলে কোনও নাবালিকার বাবার কান্না সীমান্ত পার থেকে এপারে এসে পৌঁছত না।
রঞ্জন কুমার দে
2019-04-22