যদি প্রশ্ন করা হয় পৃথিবীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কত মানুষ আছেন ? উত্তরটা নিশ্চিত ভাবেই ১৫০ কোটি বা তারও বেশি হবে।আর যদি প্রশ্ন করা হয় হিন্দুদের নিজস্ব দেশ কটা আছে ? উত্তর একটাও না!!!
ভারত সাংবিধানিক ভাবে হিন্দু রাষ্ট্র হবে কি না,তা ভবিষ্যৎই বলবে।তবে বাংলাদেশ,পাকিস্তান,আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে অমুসলিম মানুষ ধর্ম ও জীবন রক্ষার জন্য এদেশে এলে ভারত তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে।এর জন্যই নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইনটি ২০১৯ সালেই বিজেপি সরকার সংশোধন করেছে।যার সংক্ষিপ্ত নাম C.A.A. বা Citizenship Amendment Act,2019.

  তো এই আইন যখন প্রস্তাব আকারে ছিল,তখন থেকেই সারা বিশ্ব প্রচার মাধ্যম মারফৎ দেখেছে ভারতে বসবাসকারি মুসলিমদের বর্বরসুলভ দেশদ্রোহীতার নগ্ন রূপ!অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন,এই আইন কারুর নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার জন্য নয়।তাহলে ভারতে থাকা মুসলমানদের মাথা যন্ত্রণা এত কেন! শুধু ভারতেই নয়,সারা বিশ্বের মুসলিমরা যেন এক "হিন্দু-ভীতি" বা "হিন্দুফোবিয়া"-তে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন!

রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও নানা সংবাদ মাধ্যমের CAA সংক্রান্ত কার্যাবলির দিকে দৃষ্টি দিলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে।

সাল ২০১২।রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি-জেনারেল তখন বান কি-মুন (BAN KI-MOON)।তিনি ১৭ জুলাইয়ে আদামা ডেইং (ADAMA DIENG) নামে একজনকে বিশেষ কাজের জন্য নিয়োগ করলেন।বিশ্বে গণহত্যা প্রতিরোধই হচ্ছে আদামার দায়িত্ব।তিনি পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগালের নাগরিক।
দীর্ঘদিন কাজ করার পর তিনি তাঁর কার্য বিবরণী রাষ্ট্রসঙ্ঘে জমা দেন।নানা দেশের গণহত্যা,ধর্মীয় সন্ত্রাস ইত্যাদি বিষয়ে রিপোর্টে আলোকপাত করেছেন ডেইং।

স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-২০১৯ সংক্রান্ত বিষয়টিও আদামার রিপোর্টে স্থান পেয়েছে।উল্লেখ্য যে,পাকিস্তান চীনের সহযোগিতায়, CAA,লাদাখ রাজ্য গঠন,জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ ইত্যাদি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা বা পারতপক্ষে নিন্দাপ্রস্তাব আনাতে চেয়েছিল।পাকিস্তান বা চীনের সে আশা পূর্ণ হয়নি!

রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভাগ High Commissioner for Human Rights CAA-কে “মৌলিক ভাবেই পক্ষপাতমূলক প্রকৃতি”-র বলে উল্লেখ করেছে! কেন এই দ্বিচারিতা ?
তারা আশা প্রকাশ করেছে যে,ভারতের সুপ্রীম কোর্ট বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে।এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।

শ্রী ডেইং ১৮ মে ২০২০ তারিখে নিউ ইয়র্কে CAA সংক্রান্ত একটি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন।তাতে বলেছেন, “ভারতে বাসকারি মুসলিমদের CAA যথাযথ নিরাপত্তা দিতে পারে নি।যা ভারতের ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অমান্য করে!”

    করোনা অতিমারিতে ভারতের মুসলিমদের প্রতি যে " অবিচার" হচ্ছে,সে-বিষয়েও আদামা সাহেব যথেষ্ট "উদ্বিগ্ন"!তিনি বিবৃতিতে বলেছেন,"ভারতে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে।তাঁরা করোনা আবহের মধ্যেও ধর্মীয় কারণে আক্রান্ত হচ্ছেন।আহত,নিহতও হচ্ছেন।"

  অথচ সারা বিশ্ব দেখেছে ভারতে করোনা অতিমারিতে নিয়ে যাওয়ার পিছনে কারা সক্রিয় ছিল!

    আদামা সাহেবের মানবাধিকার রক্ষা সংক্রান্ত দায়িত্ব-বোধ দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।
   শ্রী ডেইং সাংসদ সুব্রহ্মনিয়ান স্বামীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন।ডেইং দাবি করেছেন যে," শ্রী স্বামী বলেছেন মুসলিমরা 'ইকোয়াল' নয়!"মুসলিমদের প্রতি এটা নাকি খুবই 'অমানবিক" ও "বিভেদমূলক কথা"!

গত ১৯/০৫/২০ তারিখে শ্রী স্বামী ডেইংকে উত্তর দিয়ে জানান যে,”রাষ্ট্রসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আদামা ডেইং নিউ ইয়র্কে আমার একটি সাক্ষাৎকারের বিষয় নিয়ে অসত্য কথা বলেছেন।পাকিস্তানের মালিকাধিন একটি টেলিভিশন চ্যানেল সেটা সম্প্রচার করে।আমি নাকি বলেছি যে,’ ভারতীয় সংবিধান অনুসারে হিন্দুদের সাথে মুসলিমরা সমানাধিকার পান না!ডেইং অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবেই আমার নামে মিথ্যা বলেছেন।আমি আদালতের মাধ্যমেই এর বিহিত করব”।

শ্রী স্বামীর সাক্ষাৎকারের পুরোটা ডেইং সাহেব সামনে আনেন নি।সামান্য একটি ক্লিপস থেকে তিনি স্বামীর প্রতি অভিযোগ তুলেছেন।সাক্ষাৎকারটি এবছরই এপ্রিলের ২ তারিখে আমেরিকা-ভিত্তিক “VICE NEWS” সম্প্রচার করে।VICE NEWS-ও শ্রী স্বামীর পুরো সাক্ষাৎকার প্রচার করেনি।কিছুটা অংশ করেছিল।তার থেকে আবার কিছুটা নিয়ে ডেইং সাহেব স্বামীর বিরুদ্ধে মুসলিম-বিদ্বেষের বিষ ঢালেন।

  সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা CAA নিয়ে সাক্ষাৎকারে শ্রীস্বামী দুটি বিষয় বলেন।
      প্রথমত তিনি বলেন, "কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মুসলমান হলেই,সে-দেশ বিপদের মধ্যে থাকে।"

দ্বিতীয়ত ” জোর দিয়ে বলা যায় না যে মুসলিমরা সেই সমতায় এসেছে”।
সন্দেহজনক বিষয় হল VICE NEWS শ্রী স্বামীর পুরো ও সত্য ভিডিওটা প্রচার করেনি বা ইন্টারনেটে আপলোডও করেনি!
VICE NEWS-এর এই আচরণের উদ্দেশ্য কী ?পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার মাধ্যম এমনটাই করে!”ডলার-পুষ্ট আশীর্বাদি হাতকে তো তুষ্ট রাখতে হবে”!

গত ৬ এপ্রিল ২০২০,সুব্রহ্মনিয়ান স্বামী VICE NEWS কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর সাক্ষাৎকারের পুরোটা ও সত্য কপিটা চেয়েছেন।
VICE NEWS সম্প্রচারিত ভিডিও সাক্ষাৎকারের কিছুটা অংশ আবার ০৩/০৪/২০ তারিখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ট্যুইটারে শেয়ার করেন।সেখানে ইমরান লেখেন,” RSS প্রভাবিত বিজেপি নেতৃত্ব একুশ শতকে দাঁড়িয়ে ২০০ মিলিয়ন মুসলিম সম্পর্কে এমন কথা বলছেন,যা ইহুদিদের নিয়ে নাৎসিরা বলত”।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব নিয়ে আদামা ডেইং যে ভাবে কথা বলে চলেছেন তাতে অনেকেই ক্ষুব্ধ।তাঁদের মত আদামা তাঁর “পদমর্যাদা“রাখতে অপারগ!

যাই হোক।
VICE NEWS“-এর কয়েকটি সংবাদ-শিরোনামের প্রতি নজর দিলে তাদের পরিচয় পরিস্কার হবে।

যেমন :-
১) “ভারতের জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা বলছে মুসলমানরাই করোনা ছড়াচ্ছে”।
২) “হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যা করছে”।
৩) “ভারতে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নতুন আইন মুসলমানদের বিতাড়নের জন্য”।
৪) “ভারতে ক্ষমতাসীন দল মুসলিমদের মনে ভীতি সঞ্চারের জন্যই মুসলিম বিরোধি নাগরিকত্ব আইন এনেছে”।

বাজারি বা পক্ষপাতদুষ্ট প্রচার মাধ্যমের কার্যকলাপ কেমন হয়,তা বঙ্গবাসী প্রতিনিয়তই দেখি।”কর্তাভজনা” না-করলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে যে!

গত ২৭/০৯/২০১৭ শ্রী ডেইং ” Courage in the Service of Peace” শীর্ষক এক ভাষণ দেন।যার আয়োজন করেছিল “Finn Church Aid” ।সেখানে ডেইং বলেন,” ভারতীয় মানব-অধিকার কর্মী গৌরী লঙ্কেশ-এর হত্যাকান্ডে আমি গভীর ভাবে মর্মাহত।তিনি ভারতের জাতপাত ব্যবস্থা এবং হিন্দু ডানপন্থী চরমভাবাপন্নদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বলার পরই নিহত হন।চার্চের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গিয়ে আদামা সাহেব “হিন্দু চরমপন্থা” নিয়ে “শান্তির ললিত বানী” বিতরণ করছেন !
বিশ্ববাসী সকলেই জানেন মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের কীর্তি-কাহিনি!সেখানকার শাসক রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিরোধি কাজে এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সেনা নামাতে হয়।বিশ্বে এত মুসলিম দেশ থাকা স্বত্ত্বেও কোনো “জাত-ভাইয়ের দেশ” এই রোহিঙ্গা মুসলিমদের ঢুকতে দেয় নি।বাংলাদেশে কিছুটা আশ্রয় পায়।আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শাসক রোহিঙ্গাদের রাজ্যে আমন্ত্রণ জানায়।
২৪/০৩/২০১৯ তারিখে ঢাকায় আয়োজিত একটি সভায় শ্রী ডেইং রোহিঙ্গাদের সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানায় তাদের আশ্রয় দেবার জন্য।তিনি বলেন,” প্রধানমন্ত্রী হাসিনা দু’বাহু বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানিয়েছেন।এটা বাংলাদেশের আবহমানকালের আতিথেয়তা।এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”অথচ ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে কত হিন্দু প্রাণ,মান,সম্ভ্রম,সম্পদ হারিয়েছেন সে-ব্যাপারে ডেইংজি “স্পিকটি নট“!

০২/০৪/১৯ তারিখে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভায় গৃহিত হয় যে, “বিশ্বকে একসাথে রুখে দাঁড়াতে হবে মুসলিম-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে,ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে”!

১৯/০৬/১৯ তারিখে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিউ ইয়র্কের সদর দপ্তরে একটি সভা হয়।রাষ্ট্রসঙ্ঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি-রূপে মলিহা লোধি (MALEEHA LODHI) সভায় দাবি করেন “ইসলামোফোবিয়া গঠনের জন্য পরিকল্পনা নিতে হবে।

২৪/০৬/১৯ তারিখে এই সংক্রান্ত আলোচনা হয়।পাক-তুর্কি-ভ্যাটিকান মিলে ছয়টি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলে।এবং নির্দিষ্ট রূপরেখাও তৈরি করা হয়।

ভারত মানব জাতির পরিপন্থী কোনো পদক্ষেপই করেনি।অথচ একশ্রেনির মুসলিমপ্রেমী মিডিয়া-প্রতিষ্ঠান-ব্যক্তিবর্গ অকারণে গুজব ছড়াচ্ছে।পৃথিবীতে মুসলিম দেশ- খ্রিস্টান দেশ আছে।যেখানে অন্যরা নাগরিকত্ব পেতে গেলে জীবন শেষ হয়ে যাবার অবস্থা হয়।কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে তো অমুসলমান কেউ নাগরিকত্বই পান না।সেই অর্থে হিন্দুদের নিজস্ব কোনো দেশ নেই।বাস ভূমি নেই।

মুসলমান ও খ্রিস্টানদের দেখে হিন্দুরাও দাবি তুলছেন,ভারতকে সাংবিধানিক ভাবেই হিন্দুরাষ্ট্র করতে হবে।এখানে হিন্দুরাই হবেন প্রথম শ্রেনির নাগরিক।

      সুজিত চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.