চর্যাপদের কবি ভুসুকুপা লিখেছিলেন, ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’। নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্যই হরিণ জগতের শত্রু হয়ে যায়। মাংস খাওয়ার জন্য নিরীহ হরিণকে শিকার করে বনের বাঘ থেকে শিকারি মানুষ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম থেকে বিলোপের দিন পর্যন্ত ইউক্রেনের মানুষকে তাড়া করেছে ভয় আর নিষ্ঠুর অত্যাচার। সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পরেও সেই প্রেতাত্মা ইউক্রেনবাসীকে ছাড়েনি। ন্যাটো বা আমেরিকাও খুব মানবিক উদ্দেশ্য নিয়ে ইউক্রেনের দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে বলে মনে হয় না। আফগানিস্তান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আমেরিকার হাত ধরেই জেহাদি মৌলবাদ তলোয়ারের শক্তি থেকে ব্যালাস্টিক মিসাইলে পৌঁছেছে। সেই ভস্মাসুর যখন নিউইয়র্কে আঘাত হেনেছে, তখন তাদের টনক নড়েছিল। সবশেষে অসহায় নিরীহ আফগানিস্তানবাসীকে তালিবান জল্লাদদের হাতে ছেড়ে কাবুল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। আমেরিকার ফেলে যাওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্রসম্ভার ব্যবহার করবে তালিবান জঙ্গিরা। উপমহাদেশের মানুষের জন্য এটাই বাইডেনের সবথেকে বড় উপহার। ইউক্রেনের ভবিষ্যতেও হয়তো সেইরকম পরিণাম অপেক্ষা করছে!
ইউক্রেন একটি প্রাচীন সভ্য দেশ। খেইভেন রাশ সভ্যতা খেইভ শহরকে ঘিরেই তৈরি হয়েছিল। একটা জমজমাট বাণিজ্য কেন্দ্র আর কয়েকশো বছর ধরে গড়ে ওঠা ছোট ছোট জনপদ। ছবির মতো সাজানো সভ্যতা ছিল ইউক্রেন। সোভিয়েত জামানাতেও সে-দেশের ২১ শতাংশ কৃষিজ পণ্য ইউক্রেনের মাটিতেই উৎপাদন হতো। ওইসঙ্গে শিল্পবাণিজ্য সামগ্রী তৈরি হতো ১৮ শতাংশ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটিমাত্র সমুদ্র বন্দরেই বছরের সবসময় জাহাজ আসা-যাওয়া করতে পারত। কৃষ্ণসাগরের সেভাসতোপোল। বন্দরটি ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায়। বাকি সব বন্দরে শীতকালে বরফ জমে থাকত। ইউক্রেনীয়, রুশ আর তুর্কি সংমিশ্রণে এক অনুপম সংস্কৃতি ছিল সেখানে।
আজও আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীরা ইউক্রেনে ডাক্তারি বা অন্য পেশাগত শিক্ষা নিতে যান।
এই মুহূর্তে তাই কয়েক হাজার (?) ছাত্রছাত্রী সেখানে
আটকে আছেন।
এই সুন্দর উর্বর ভূখণ্ড, অসাধারণ প্রকৃতি, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আর প্রাচীন সভ্যতার ইউক্রেনের উপর গত একশো বছরে ধারাবাহিক বর্বরতা চলেছে। রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লবের সময় ইউক্রেনে যথার্থ অর্থেই মাৎস্যন্যায় ছিল। পশ্চিমের ঐতিহাসিকদের মতে ১৯১৭-২০ পর্বে ইউক্রেনের মূলনিবাসী ইউক্রেনভাষী, বলশেভিক, ফরাসি, পোলিশ আর সেইসঙ্গে নিপাট লুটেরা লুম্পেনদের ক্ষমতা দখলের লড়াই চলছিল। অনেক শক্তিশালী ছিল বলশেভিকরা। ফলে ইউক্রেনের বড় অংশটাই সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যায়। বাকিটার মধ্যে পূর্ব প্রান্ত ভাগ করে নেয় পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশ।
ইউক্রেনের ভাগ্যাকাশে তখন থেকেই কালো মেঘ জমতে শুরু করে। ইউক্রেনবাসী কিছুতেই কমিউনিস্ট শাসন মেনে নিতে পারছিলেন না। ইউক্রেনের স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এই রাজনৈতিক গতিবিধিতে প্রমাদ গুনলেন যোসেফ স্তালিন। তাঁর পরিকল্পনাতেই ঘটে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। স্তালিন বলপূর্বক ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আর বাইরে থেকে সব সরবরাহ বন্ধ করে দেন। স্থানীয় ভাষায় এই ভয়াবহ ঘটনাকে বলা হতো হলোডোমর, যার অর্থ ‘না খেতে দিয়ে হত্যা’। আজ যেমন কমিউনিস্ট চীনে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের প্রবেশ নেই, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেও মিডিয়ার প্রবেশ ছিল না। ইউক্রেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত কবল থেকে মুক্তি পায়। তারপরে হলোডোমর নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত শুরু হয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তদন্ত, নিরপেক্ষ গবেষণা, কিয়েভের আদালতের বিচার বিভাগীয় তদন্তে উঠে এসেছে মৃত্যুর আসল বর্ণনা। ১৯৩২-৩৩-এর দুর্ভিক্ষে ইউক্রেনে ৩৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। এরপরে অপুষ্টি আর বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্মের কারণে জীবন্মৃত অবস্থা হয় আরও ৬১ লক্ষ ইউক্রেনবাসীর। স্তালিনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল। হলোডোমরের পরে ইউক্রেনের আর স্বাধীনতা সংগ্রাম করার ক্ষমতা ছিল না।
তবে একবার ভয় পেয়েছিলেন স্তালিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ক্রিমিয়ার বন্দরগুলো তুরস্কের মানুষের দখলেই ছিল বহুকাল। অটোম্যান সাম্রাজ্যের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল সেই দাপট। ১৭৮৩ সালে খোদ ক্রিমিয়ায় মুসলমান ধর্মালম্বী তাতারের সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ। পরে সংখ্যা কমেছে বিভিন্ন কারণে। তবু ‘দুনিয়ার কে ডর্ করে না তুর্কির তেজ তলোয়ারে?’, কাজী নজরুল ইসলামের সেই কথাই যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার স্তালিনের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছিল। ক্রিমিয়া, সেভাতোপোল বন্দর আর তাতারদের আধিক্য। উপায়? উপায় ‘এথনিক ক্লিনসিং’। ১৯৪৪ সালের ১৮-২০ মে-র মধ্যে প্রায় ২ লক্ষ তাতারকে ক্রিমিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। বয়স্ক মানুষ, মহিলা, অসুস্থ ও শিশুদের পাচার করা হয় পশুবাহী মালগাড়িতে করে। মাত্র তিনদিনের অত্যাচারে তাদের জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ কমে যায়—মৃত্যু অথবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কারণে।
কমিউনিস্ট শাসনে ইউক্রেনে ঘটেছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা। চেরনোবিলের ঘটনা ১৯৮৬ সালে ২৬ এপ্রিলের। চেরনোবিলের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চারটি রিয়্যাক্টর ছিল। সবক’টিই ছিল রাশিয়ায় তৈরি আরবিএমকে ১০০০ মডেল। এই ধরনের রিয়্যাক্টর বা অত্যাধুনিক পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের যন্ত্রপাতির নিয়ামক সংস্থা হল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ)। তাদের বিজ্ঞানীরা বহুবার রাশিয়ার রিয়্যাক্টরের নিরাপত্তার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান চীনের মতো, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নও কোনও আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করত না। দুর্ঘটনার পরদিনও স্থানীয় মানুষকে তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এমনকী চার-পাঁচটি বিয়ের অনুষ্ঠানও হয় টাউনশিপে। ক্রমে মানুষ অসুস্থ হতে থাকে, গা জ্বালা করে, বমি শুরু হয়। ঘটনার ৩৮ ঘণ্টা পরে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। এলাকা খালি করা শুরু হয়। এরপরে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চলে তেজস্ক্রিয়তা চাপা দেওয়ার কাজ। এই গাফিলতির জন্য মোট ৯ হাজার মানুষের সরাসরি প্রাণ যায় এবং অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন আরও প্রায় ৫ লক্ষ ইউক্রেনবাসী।
ভ্লাদিমির পুতিন নিজেও খুবই সন্দেহজনক ব্যক্তিত্ব। ১৯৭৫ সালে তিনি সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে যোগ দেন। তখন থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য। তিনিই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে প্রকাশ্যে বললেন, ‘কমিউনিজম একটি অন্ধগলি, যা সভ্যতার মূলধারা থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে শেষ হয়েছে।’ আবার ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তিনি স্তালিনের সাম্রাজ্যবাদী নীতি নিলেন।
স্তালিন পূর্ব ইউরোপে একের পর দেশে সাম্রাজ্যবাদী থাবা বসিয়েছিলেন। তৈরি করেন ১৯৪৬ সালে পিপলস রিপাবলিক অব বুলগেরিয়া এবং পিপলস সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব আলবেনিয়া, ১৯৪৭ সালে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব রোমানিয়া, পোলিশ পিপলস রিপাবলিক, ১৯৪৮ সালে চেকোস্লোভ্যাক সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক আর ১৯৪৯ সালে হাঙ্গেরিয়ান পিপলস রিপাবলিক। সেইসব জায়গায় নামেই ছিল গণতন্ত্র, আসলে শাসন করতেন সোভিয়েত পুতুলরা। প্রতিবারই ৯৫ শতাংশের বেশি ভোট পেতেন তাঁরা। তেমনই পুতিন তাঁর কেজিবি-জীবনের যাবতীয় কূটকৌশল কাজে লাগিয়ে ইউক্রেনে সন্ত্রাসবাদীদের মদত দিয়েছিলেন। তারপর বসিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইউনোকোভিককে, ২০১৪ সালে রাশিয়ায় পালিয়ে আসা পর্যন্ত যিনি ছিলেন পুতিনের হাতের পুতুল।
ভারতের পুরনো মিত্র রাশিয়া। উপমহাদেশে ভারত
আর পাকিস্তানের বিবাদে দুই কমিউনিস্ট দেশ দুই পক্ষ নিয়েছিল। ভারতকে সমর্থন করেছিল রাশিয়া আর চীন ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে।
আজকের ইউক্রেনের বিপদের কথা পৃথিবীর সকলেই জানে। এটাও জানে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্র সোভিয়েত আগ্রাসনের থেকেও ভয়ানক। ইউক্রেন তপ্ত তাওয়া থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়বে না তো?
জিষ্ণু বসু