বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় বিপ্লব এনেছে কৃত্রিম প্রজনন বা আইভিএফ (IVF)। এক কথায় যাকে বলা হয় টেস্ট টিউব বেবি। বেশি বয়সে সন্তানধারণ, বা প্রসবজনিত সমস্যার সমাধান এখন এই পদ্ধতিতে জাদুবলেই সম্ভব হয়। এই পদ্ধতির অনেকগুলি স্তর রয়েছে। সাধারণ আইভিএফ-এ পুরুষের শুক্রাণু ও স্ত্রীয়ের ডিম্বানুর মিলনেই সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু ‘থ্রি-পেরেন্ট বেবি’, অর্থাৎ দু’জন মা ও একজন বাবার থেকে সুস্থ সন্তানের জন্ম হওয়াটা আইভিএফের একটা নতুন চমক। আর এই সাফল্যকেই কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতির নয়া বিপ্লব বলে দাবি করলেন গ্রিস ও স্পেনের চিকিৎসকরা।
এই ‘থ্রি-পেরেন্ট বেবি’ পদ্ধতির চিকিৎসাবিজ্ঞানসম্মত নাম ‘ম্যাটারনাল স্পিন্ডেল ট্রান্সফার’ (MST) । সম্প্রতি এই এমএসটি প্রয়োগ করে মা হয়েছেন বত্রিশের যুবতী। বার্সেলোনার একদল চিকিৎসক সফল ভাবে আইভিএফের এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছেন বলে দাবি। চিকিৎসকদের কথায়, নানা জটিলতার কারণে ওই যুবতীর আগে চার বার আইভিএফ ব্যর্থ হয়। তারপরেই এমএসটি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। প্রায় তিন কেজি ওজনের সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ওই মহিলা।
সাধারণ আইভিএফের সঙ্গে কতটা তফাৎ এমএসটি-র
চিকিৎসকের মতে, সাধারণ আইভিএফ-এ মিলনের সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে এমন ডিম্বাণুদের গোনাডোট্রপিন ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে বাইরে বার করে আনা হয়। এর পর পুরুষের শুক্রাণু সংগ্রহ করে তাকে টেস্ট টিউবে রাখা হয়। সেখানেই ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হয় শুক্রাণু।
তবে এর নানা স্তর রয়েছে। সাধারণ আইভিএফ-এ শুক্রাণু ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হতে অক্ষম হলে প্রয়োগ করা হয় ‘ইকসি’ পদ্ধতির। এই উপায়ে চিকিৎসকরাই টেস্ট টিউবের মধ্যে যান্ত্রিক উপায়ে নিষেক (শুক্রাণু-ডিম্বানুর মিলন) ঘটান। তারপর তা প্রবেশ করানো হয় হবু মায়ের শরীরে। মহিলা যদি সে ক্ষেত্রে গর্ভধারণে অক্ষম হয়, তাহলে ‘ওভাম ডোনেশান’ পদ্ধতিতে ডিম্বানু সংগ্রহ করা হয় অন্য নারীর শরীর থেকে, তারপর শুক্রাণুর সঙ্গে তার মিলন ঘটিয়ে ভ্রুণ প্রতিস্থাপণ করা হয়। তা ছাড়া, সরাসরি অন্য নারীর গর্ভে ডিম্বানু ইনজেক্ট করাও সম্ভব, যাকে সারোগেসি বলা হয়। কোনও কারণে পুরুষ ও মহিলা দু’জনেরই শারীরিক জটিলতা থাকলে ‘এমব্রায়ো ডোনেশন’পদ্ধতিতে নির্বাচিত অন্য নারী ও পুরুষের থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বানু সংগ্রহ করা হয়।
এমএসটি পদ্ধতিতে মায়ের শরীর থেকে যে ডিম্বানু নেওয়া হয় তার সঙ্গে অন্য নারীর ‘ডোনার মাদার‘-এর ডিম্বানু মিশিয়ে দেওয়া হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। এরপর সেই মিশেলের সঙ্গে শুক্রাণুর মিলন ঘটানো হয়। এই মিশেল হয় মাইটোকনড্রিয়ার স্থানান্তর পদ্ধতিতে যাকে মাইটোকনড্রিয়াল ট্রান্সফার বলা হয়। চিকিৎসকদের দাবি, হবু মায়ের শরীরে কোনও রকম রোগ থাকলে বা মাইটোকনড্রিয়াল ডিজিস থাকলে, সেটা এই উপায় দূর করা সম্ভব। সাধারণ আইভিএফ ব্যর্থ হলে এই পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম হওয়ার গ্যারান্টি নাকি অনেক বেশি।
নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন
২০১৬ সালে এমএসটি পদ্ধতি প্রকাশ্যে আনেন গবেষকরা। ব্রিটেন এই পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিলেও বাধ সাধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয়, দুই মায়ের মিশেলের কারণে সন্তানের বংশগত ধারায় বদল আসতে পারে। তা ছাড়া, দু’টি ডিম্বানুই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গ্রিসের গবেষকরা জানিয়েছেন, সন্তানের ৯৯ শতাংশ জিন আসে বাবা-মায়ের থেকে। সুতরাং একই পরিবারের বা নিকট সম্পর্কের কোনও মহিলার থেকে যদি ডিম্বানু সংগ্রহ করা হয়, তাহলে আর নৈতিকতার প্রশ্ন থাকে না। সারোগেসি পদ্ধতিতেও তো গর্ভ ভাড়া করে সন্তানের জন্ম দেওয়া হয়ে থাকে। বার্সেলোনার মেডিক্যাল টিমের প্রধান ডঃ নুনো কোস্টা-বর্গেসের কথায়, “স্পিন্ডেল ট্রান্সফার আইভিএফ পদ্ধতিতে বিপ্লব আনতে পারে। বন্ধত্য দূরীকরণে এই উপায় নতুন আলোর পথ দেখাতে পারে।”