একজন অমুসলিম হওয়ায় বাংলাদেশে আপনাকে শৈশব কী কী অসুবিধার শিকার হতে হয়েছে?

একজন অমুসলিম হওয়ায় বাংলাদেশে আপনাকে শৈশব কী কী অসুবিধার শিকার হতে হয়েছে?
এটা নিয়ে বাস্তবে ১টা আস্ত বই লেখা সম্ভব। অনেক বড় ইতিহাস। যা বলে শেষ করা যাবে না। বুকে চাপা কষ্ট এবং আর্তনাদ আজ আমি আপনেগো সাথে শেয়ার করব।

যখন অনেক ছোট ছিলাম( প্লে, নার্সারি, কেজি ক্লাস) তখন বুঝতাম না এই ধর্ম জিনিস টা কি? স্কুলে যাইতাম, বন্ধুবান্ধবদের সাথে খেলতাম, পড়াশোনা করতাম আরো কত কিছু।

যখন নার্সারীতে পড়তাম তখন আমার ১ বন্ধুর মা তাকে নিয়ে স্কুলে আসছিল। তো সে আমাকে পেয়ে খুব খুশি, তাই সে আমার পাশে বসলো। তখন তার মা বলছিল,” ঐ নাজমুল (আমার বন্ধুর নাম) তুই ওর পাশে বইছছ ক্যান?” তখন আমার বন্ধু বলল,” কেন মা কি হইছে? অপূর্ব আর আমি খুব ভালো বন্ধু।” তখন তার মা বলল,” তুই জানস না ও ১টা হিন্দু পোলা?” তখন সে বলল,” হিন্দু কি জিনিস? যাই হোক আমরা খুব ভালো বন্ধু আর আমি ওর সাথেই বসব।” তখন তার মা বলল, ” ও আলাদা ধর্মের, ঐ ছেলে খারাপ; ওর সাথে বসলে তুইও খারাপ হয়ে যাবি।” আমার বন্ধু বলল,” না মা, ও খুব ভালো ; আমরা খুব বন্ধু। আমরা একলগে খেলতে যাই, পড়ালেখা করি…… আমি ওর পাশে বসব।” তখন তার মা তাকে সজোড়ে কানে আর গালে ১টা চড় মারল আর বলল,” হিন্দুর লগে মিশ্যা তুইও জাউড়া হইয়া গেছস।”আর প্রহার করতে লাগল। আমি আমার বন্ধুকে বাচাতে গেলে সে এমন জোড়ে ১ ধাক্কা মারল আমি বেঞ্চে মাথার সাথে খুব জোড়ে ঠুয়া খাইলাম। আর অন্যরা তাকে বাঁচাতে গেলে তাদেরও ধমক দিচ্ছে। পরে শ্রেনী শিক্ষক এসে সমস্যার সমাধান করল।

৪র্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ঐ বন্ধুর সাথেই একদিন খেলতে যাব তাই আমি তাকে বললাম, ” আমারে তগো লগে নিবি? আমিও খেলমু।” তখন সে আমাকে বলল,” তুই নামাজ পড়ছ? যেদিন নামাজ পড়া শুরু করবি সেদিন আমগো লগে খেলতে আসিছ।” আমি ওর কথা শুনে রীতিমতো অবাক। তখন ভাবতে লাগলাম যেই বন্ধু একদিন আমার জন্য পাগল ছিল, আজ সেই নাকি ধর্মের কারনে আমায় দুরে সরিয়ে দিচ্ছে!!!

স্কুল জীবনে অনেক সময় ধর্ম নিয়ে কটুক্তি শুনতে হইছে। অনেক সময় আকাডা, মালাউন, মালু, ডান্ডি, ড্যাডা এসব মধুর শব্দও শুনতে হইছে। অনেকে প্রশ্ন করত তরা নিজেরা মুর্তি বানাইয়া হেই মুর্তিরে তরা ভগবান মানছ, পূজা হইয়া গেলে ফেলে দেছ। এমন প্রশ্নও শুনছি তরা গরুর দুধ খাছ কিন্তু গোমাংস খাছ না ক্যান? আবার অনেকে বলত হিন্দুরা নাকি গোমুত্র খায়, অথচ আমি কোনো হিন্দুকে আজ পর্যন্ত এটা খাওয়া দুরে থাক, স্পর্শ পর্যন্ত করে দেখিনি এমনকি হিন্দু ধর্ম গ্রন্থেও এসব ব্যপারে কিছু লেখা নাই। অথচ আমরা যদি বলতে যাইতাম মুসলিমরাতো উটের মুত খায়। তখন আমাদের মারতে আসত।আমাকে অনেকে বন্ধু বান্ধবীরা বলত ইসলাম সঠিক ও সত্য ধর্ম; তগো ধর্ম ভুয়া।তাই সময় থাকতে মুসলিম হয়ে যা নইলে পরে দোজখের আগুনে পুরে শাস্তি পেতে হবে।এরকম ঘটনাও ঘটছে আমাকে কলেমা পড়ার জন্য জোড় করছিল, কিন্তু আমি তাদের সাথে তর্কে যেতাম, কখনো কখনো মাইরও কপালে জুটছে। আমাকে এরকম অনেক বন্ধু বলছিল যে, সমগ্র পরিবার মুসলিম হইলে নাকি জান্নাতে যায় আর যে দাওয়াত দেয় তার নাকি সোয়াব হয়। তো আমি বলতাম, জান্নাত কি তোর বাপের? যে তুই আমার ১৪ গুষ্টিরে জান্নাতে পাঠাবি?”

তারা সুযোগ পাইলেই আমাদের সব দেবদেবীদের নিয়ে কটুক্তি করত, খারাপ ভাষা ব্যবহার করত। আরো অনেক উদ্ভট প্রশ্ন করত এখনো করে।

যখন ৯ম শ্রেণীতে পড়তাম তখন ১দিন স্কুলের স্যার দেশভাগের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে পাইছিল,”১৯৪৭ সালে ২০ শে জুন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের কারনে যুক্তবঙ্গ গঠিত হয়নি…… পশ্চিমবঙ্গ বাঙালি হিন্দুদের হোমল্যান্ড।”তখন স্যার বলল,” ঐ হ্যানে হিন্দু ছাত্র ছাত্রী কয়েকজন আছছ? খাড়া।” আমরা হিন্দু ছাত্র ছাত্রী ছিলাম ৫জন। আমরা দাঁড়ালে উনি আমাদের উদ্দেশ্য করে পুরা ক্লাসকে বলেন,”এই হিন্দুগো লেইগা বাংলা ভাগ হইছে, এই হিন্দুর জাতের লেইগা আমরা উন্নতি করতে পারিনাই, বাংলাদেশ উন্নতি করতে পারেনাই, আমগো বাংলাদেশ বড় হইতে পারেনাই, এরা ভারতের দালাল, বাংলাদেশ হইল এদের লুটপাটের জায়গা, এরা বাংলাদেশের প্রকৃত চোর……” আমাদেরকে আরো বলছিল, ” ঐ তরা হ্যানে আছছ ক্যান? তরা জানছ না এইডা মুসলমানের দেশ? তগো হ্যানে থাকনের অনুমতি দেয় ক্যাডা? তরা তগো হোমল্যান্ড পশ্চিমবাংলায় যাছ না ক্যান? কবে যাবি? কবে বাংলাদেশেরে মুক্তি দিবি?………প্রভৃতি। তখন আমাদের মধ্যে ১ হিন্দু ছাত্রী বলছিল,” স্যার আমরা থাকলে আপনার যদি ক্লাস নিতে সমস্যা হয়, তাইলে আমরা অক্ষনি ক্লাস থে বাহির হইয়া যামুগা।” তখন স্যার বলল,” তরা ৫টা ক্লাসের বাইরে কান ধইরা খাড়াইয়া থাক।” স্যারের কথামতো আমরা ৫জন ক্লাস থেকে বেড়িয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু তখনও সে হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুদের নি এত খারাপ কথা বলছিল যেটা গালাগালকেও ছাপিয়ে যাবে।

আরেক ঘটনা———————

আমার জন্ম ঢাকা জেলায়। ছোটকালে দেখতাম আমাদের টিন আর বেড়ার বাড়ি, অনেকটা ভাঙাচুরা। তো আমার বাবা আর মা ১২বছর টাকা জমিয়ে বাসাটাকে ২তলা দালান বানাইছিল, খুব শখ করে। আমরা কারো থেকে ১ চুল জায়গাও ধার করিনাই। আমরা খুব সুন্দর করে টাইলস করে রঙ করে ভালো ফিটিংস করে বাসা বানাইছিলাম। বাসা তৈরির ২মাস পর ১দিন মাঝরাতে——

উপজেলার চেয়ারম্যান আর তার গুন্ডারা জানালা, দরজায় পিটাচ্ছিল, আর আমার বাবাকে ডাকছিল। এত আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি ভাবছিলাম, এত রাতে জানালা দরজায় বাইড়ায় ক্যাডা?” আমি দরজা খুলতেই দেখলাম একদল লোক হাতে পিস্তল, চাপাতি, ছুড়ি, বটি, রামদাও, কিরীচ নিয়ে বাসায় হাজির। আমি দেখে প্রচন্ড ভয় পাইছিলাম। তখন আমি বাবা মাকে ডাকছিলাম। তাঁরা(বাবা, মা) গেটের সামনে আসতেই বাবার মাথায় পিস্তল ঠেকায়, মায়ের গলায় রাম দা, আমার গলায় বটি ধরে বলে,” মালাউনের বাচ্চা মালাউন তরা এই বাসা আমগো কাছে বেইচ্চা দে, নইলে আইজি তগোরে মাইরাফালামু।” তখন আমার বাবা হাত জোর করে তাদের কাছে কাকুতি মিনতি করে বলছিল,” চেয়ারম্যান সাহেব, আমরা কি অপরাধ করছি? আপনেরা আমাদেরকে মারতে আসছেন কেন?” তখন তারা বলল,” তরা জানস না আমরা হ্যানে কোনো মালাউন থাকতে দিমুনা?” আমার ছোট ভাইকে পর্যন্ত তারা মেরে ঘুম থেকে তুলছিল। তখন আমার বাবাকে তারা জোর করে দলিলে স্বাক্ষর করায় এবং হুমকি দেয় আগামী ২দিনের মধ্যে তরা এই এলাকা ছাইড়া যাবিগা, তগো যাতে এই উপজেলার কোথাও না দেখি। এর পরেও আমার বাবা অনেক হাতেপায়ে ধরে বলছিল,” স্যার, আমারে আর ৩ডা দিন বাড়ায় দেন, আমার বউ বাচ্চা আছে আবার এত ফার্নিচার।” তখন আমরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমরা ঐ কয়দিন ঠিকমতো খাইতে পারতাম না, রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছিল। ঐ কয়দিন আমার বাবা এদিকে ওদিকে বাসা দেখতো, বাড়িওয়ালাদের সাথে কথা বলত কিন্তু হিন্দু জানলেই তারা বলত আমরা হিন্দু ভাড়াটিয়া রাখিনা। আর আমি আমার মা, ভাই রীতিমতো পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। কিন্তু বাসা আর ঠিক হয়না। এরপরে উঠলাম আত্মীয়ের বাসায়। তাদের বাসায় জিনিস পত্র গুলো পাঠিয়ে দিছিলাম। আর এদিকে অন্য কাজগুলো ঠিক করছিলাম।এর মধ্যে ৫দিন যেতে না যেতেই আবার সেই মারণাস্ত্র নিয়ে হাজির।বলছিল তরা এখনো যাসনাই? তখন তাদের থেকে টাকা নিয়ে সেখানথেকে চলে আসলাম। ১০টাকার জিনিস ১টাকায় বেচলে যা হয়। আমাদের সাথেও একই ঘটছিল। যেগুলো আমার লেখার ইচ্ছা নাই, আপনাদেরো পড়ার ধৈর্য্য নাই।

এরপরে ১দিন আমার বাবার দোকানও তারা জবরদখল করে নিল।

এখন যেখানে থাকি সেখানেও পাশের বাসার মুসলিমরা আমাদের ঠাকুরঘরের দিকে নোংরা ছোড়ে। যদিও জানালা বন্ধ। এখন আর সেই জানালা খুলিনা। আরো অনেক ঘটনা আছে।

তবে শেষে ১টা কথাই বলব, আমাদের সাথে যা হইছে, অন্য কারো সাথে হলে এতদিনে দেশ ছেড়ে চলে যেত। এতকিছুর পরও আমরা দেশমাতৃকাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। এবং মরলে এই ভূখন্ডেই মরব।

জয় বাংলা।

কলমে ✍ অপূর্ব দে (ঢাকা, বাংলাদেশ)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.