একাত্তরের বাংলাদেশ : নরকের নগ্নরূপ

পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তির জন্য বাংলাদেশ যে বীভৎস অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছিল তা ভোলা যায় না। কিছু শুষ্ক পরিসংখ্যান এই নৃশংস অত্যাচারের পরিধি কত বিস্তৃত ছিল তা তুলে ধরতে পারে না।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এই হত্যালীলায় যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের সম্মানে ও ভবিষ্যতে এই ধরনের হত্যালীলা রুখতে ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে, যা ভারতবাসীর কাছে বিশেষ তাৎপর্যের। ছেচল্লিশ বছর আগে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। ঢাকার বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন, ৫ লক্ষ মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে এসেছিলেন দশ লক্ষ লোক। এই তথ্য আতঙ্কের চোরস্রোত বইয়ে দিতে পারে ঠিকই; কিন্তু সেই হত্যালীলার মধ্যে কতটা বীভৎসতা লুকিয়ে ছিল, ধর্ষণের সঙ্গে মহিলাদের ওপর কীধরনের অমানবিক নির্যাতন হয়েছে, যাঁরা ঘর ছাড়তে বাধ্য হলেন তাঁদের কোন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলা হয়েছিল যাতে তারা পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি, শিকড় উপড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন— কোনো শুষ্ক পরিসংখ্যান কি এগুলির জবাব দিতে পারে ?
যাঁরা সেই সময় রাস্তাঘাটে মৃত বিবস্ত্র মহিলাদের যৌনাঙ্গে অজস্র ক্ষতচিহ্ন এবং শিশুদের মৃতদেহ দেখেছেন বা এইরকম বীভৎস অত্যাচারের কাহিনি শুনেছেন ভারতের উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে এমন বহু মানুষ ছিলেন যাঁরা সেদিনের অভিজ্ঞতা কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না। আমার কথাই ধরুন, ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দালালরা যতটা বর্বর হতে চেয়েছিল ততটাই হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। এ ব্যাপারে কেউ ভিন্নমত পোষণ করবেন বলে আমার মনে হয় না।
গত ২৫ ও ২৬ নভেম্বর ঢাকাতে ‘হত্যালীলা-অত্যাচার ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্র আয়োজিত হয়। আয়োজক ছিল ‘জেনোসাইড টরচার অ্যান্ড লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ ১৯৭১, জেনোসাইড-টরচার আর্কাইভ ও মিউজিয়াম ট্রাস্ট’। এই আলোচনায় স্মরণ করা হয়েছিল যে তাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে কী বিপুল পরিমাণ নৃশংসতা ও অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল এবং একই সঙ্গে ওই আলোচনা চক্রে এও দেখা গিয়েছিল যে ১৯৭১-এর পর জন্মানো বিভিন্ন প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষই পাকিস্তানিদের নৃশংস অত্যাচারের বিষয়ে অবহিত আছে এবং তারা এ বিষয়ে আরও জানতে ইচ্ছুক। এটা খুবই বিশেষভাবে লক্ষণীয় কারণ সেনাপ্রধান পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদের সেনা-শাসনকালে চারটি লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে রাখা হয়েছিল— যুদ্ধাপরাধীদের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, দেশের মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, বাংলাদেশের ইসলামিকরণ ও তাকে পাকিস্তানের কাছাকাছি আনা।
বেগম খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-০৬ সালে গঠিত দু’টি সরকারেরও এই ধরনের লক্ষ্য ছিল। আলোচনা-চক্রের বিভিন্ন আলাপচারিতায় এও দেখা গিয়েছিল, যে শাহবাগ আন্দোলন রাস্তায় নেমে সফল হয়েছিল তা সেনাপ্রধানের বা তাদের হাতের পুতুল ছিল না আবার খালেদা জিয়া, যার স্বামীর নাম জিয়াউর রহমান তার দ্বারা পরিচালিত হয়নি। বাংলাদেশ এসব ভুলে যায়নি। এর জন্য প্রাথমিক কৃতিত্ব সেই পুরুষ ও মহিলাদেরই প্রাপ্য যারা ভীতিপ্রদর্শন, কারাগারে বন্দি করে অত্যাচার ও হেনস্থা সত্ত্বেও নিরবচ্ছিন্নভাবে। লড়াই চালিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের অগ্নিপরীক্ষার স্মৃতিতে এবং এজন্য নিজেদের দহন করতেও তারা পিছপা হয়নি।
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরেই বিষয়টি আবার বিবর্ণ হতে শুরু করেছিল। প্রথমে সেনাপ্রধান, পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাংঘাতিকভাবে অবদমিত করবার চেষ্টা করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। আওয়ামি লিগকে খোঁড়া করে দেওয়া হয়েছিল। লিগের গোটা নেতৃত্বকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাত্রে জেলের মধ্যে খুন করা হয়েছিল। যা কিছু সময়ের জন্য মুক্তি-পন্থী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। আবার শোনা গেল জিয়াউর রহমান গোলাম আজাদকে, যে লোকটি ছিল সম্ভবত শত্রুপক্ষের জঘন্যতম সহযোগী, তাকে পাকিস্তান থেকে আনার ব্যবস্থা করছে। ১৯৭৮-এর জুলাইয়ে গোলাম বাংলাদেশে ফিরল। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। সে পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল।
১৯৭৯ সালে এই ঘোরতর পরিস্থিতির বিরুদ্ধে একটি নাগরিক সমিতি গঠিত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-এ-ইসলামিদের মিটিং ও সমাবেশের প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধারা সংসদ আন্দোলনে নামার কথা ঘোষণা করে। শহিদ রমির মা জাহানারা ইমাম, যিনি সর্বজনমান্য একজন মহিলাও বটে এবং শহিদদের অন্য আত্মীয়েরা এই আন্দোলনে শামিল হন। তারা পাশে পান একদল বুদ্ধিজীবীকেও।
প্রতিবাদ আন্দোলন ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বহু প্রবন্ধ, বই ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। শাহরিয়র কবিরের যুগসন্ধিক্ষণের কাজ একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা : কে কোথায়’, যুদ্ধাপরাধীদের বিস্তারিত বর্ণনা ও সক্রিয়তাকে ফুটিয়ে তুলেছিল নিপুণভাবে। ১৯৮৭ সালে এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এবং তা নতুনভাবে একটি আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে এরশাদ-সরকার ইসলামকে ঘোষণা করায় এর বিরুদ্ধে একটি নাগরিক কমিটি গঠিত হয় এবং প্রতিবাদ আন্দোলনও চলতে থাকে।
একইসঙ্গে জামাত-এ-ইসলামি বাংলাদেশের কাজকর্ম ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং ১৯৯১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পূর্বোল্লিখিত গোলাম আজম, যে তখনও একজন পাক-নাগরিক, তাকে তাদের আমির’ (প্রধান) হিসেবে ঘোষণা করে জামাত। এর ফলে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি সর্বজনমান্য ১০১ জন বাংলাদেশি নাগরিক গঠন করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এর প্রথম ঘোষণাতেই বলা হয়েছিল যে তারা একটি জন-আদালত গঠন। করবেন এবং সরকার কোনো কার্যকরী। পদক্ষেপ না নিলে তারাইযুদ্ধাপরাধী হিসাবে ও বাংলাদেশের সংবিধান অমান্য করবার জন্য আজমকে দোষী সাব্যস্ত করবেন। এই বিচারের জন্য আন্দোলনে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি— যা নির্মূল কমিটি’ নামে ওই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, এদের নেতারা সেই রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সহযোগিতার দাবি জানায় যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে; যাতে করে জন আদালতকে বিপুলভাবে জনপ্রিয় করে তোলা যায়। আওয়ামি লিগ-সহ তেরোটি রাজনৈতিকদল এতে রাজি হয়। ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক হন জাহানারা ইমাম।
খালেদা জিয়া সরকারের বৃহৎ মাপের অবদমন সত্ত্বেও, ঢাকার রাস্তা, রেল ও ব্যক্তিগত যানের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণও যার মধ্যে ছিল, ঢাকার সুরাবর্দি উদ্যানে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জন-আদালতের বিচারসভা বিপুল সাফল্য পায়। ৫ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে গোলাম আজমকে। যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করে তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষিত হয়। এই ঘটনা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আর পেছনে ফিরে তাকাবার উপায় ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও এবং ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন জাহানারা ইমামের। মৃত্যু ঘটলেও আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি হতেই থাকল।
বিরুদ্ধ নীতির অস্তিত্ব থাকলেও, নির্মূল কমিটির নেতারা— শাহরিয়র কবীর, মুনতাসির মামুন, কাজিমুকুল ও অন্যান্যরা লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন, ঠিক যেভাবে প্রাক্তন সেনানায়ক যেমন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) কোয়াজি সাজ্জাদ আলি জাহির, বীর প্রতীক, তাদের উদ্যোগ সে দেশের ক্রমবর্ধমান নাগরিক সমাজের মৌখিক সমর্থন পায়, যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এঁদের পাশে দাঁড়ায়। ২০০৬ সালটি বাংলাদেশের পক্ষে খুবই তাৎপর্যের যে বছর নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কম্যান্ডারস ফোরাম যৌথভাবে সেদেশের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক মিটিং-মিছিলের আয়োজন করে; যাদের দাবি ছিল জামাত-এ-ইসলামি, বাংলাদেশের মতো সংগঠন এবং এদের শাখা সংগঠন যেমন ইসলামি ছাত্র সঙ্ (পরে ইসলামি ছাত্র শিবির), আল বদর ও আল শ্যাম, রাজাকার, শান্তি কমিটি ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের বিচার, যারা কেবল পাকিস্তানের গুপ্তচর ও সমর্থক হিসাবেই কাজ করেনি, একই সঙ্গে ধর্ষক, গণহত্যাকারী ও অত্যাচারী রূপেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সামনে নিজেদের মেলে ধরেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দর্শনের সমর্থক হিসাবে যারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছেন, ওই ঘটনা তাদের দাবিকে নতুনভাবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তা আরও সঙ্ঘবন্ধ হয়। যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েকজন জঘন্য যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও তাদের শাস্তি দিতে সমর্থ হয়। এক সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় একটি দেশে মানবতা-বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল এবং পাকিস্তানিরা ছিল সেই অপরাধের সহযোগী ও তার সংঘটক। বাকিটা সবই ইতিহাস।
হিরন্ময় কার্লেকার
(লেখক দ্য পাইওনিয়ার পত্রিকার কনসালট্যান্ট এডিটর ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.