সুলতানি আমলের আগে বাংলায় ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। নালন্দা , তক্ষশীলা থেকে শুরু করে গোবর্ধন, জয়দেব, উমাপতি, ধোয়ির মতো কবি, গীতগোবিন্দ, পবনধূতের মতো কাব্য বাংলায় সেন বংশের আমলেই রচিত হয়েছিল। শেষও হয়েছিল বলা যায়। সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন ছিলেন বাংলার শেষ হিন্দু রাজা। তারপরই শুরু হয় সুলতান আমল।
বিশ্বাসঘাতকতা, ছল-চাতুরী দিয়ে বাংলায় হয়েছিল প্রথম ইসলাম অনুপ্রবেশ।
অনেকেই বলেন লক্ষণ সেন অত্যন্ত দুর্বল রাজা ছিলেন। তিনি ইসলাম আক্রমণ ঠেকাতে পারেননি। এই গল্প কিন্তু সর্বাংশে সত্য নয়। এমনটা নয় যে বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন কোনও চেষ্টাই করেননি। ইতিহাস সবসময়তেই বলেছে , “বখতিয়ার খিলজী ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে নদীয়ার রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন।” সত্যিই কি তাই? ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ছিলেন আফগানিস্থানের গরমশীরের বাসিন্দা। ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই সময়ই গজনির তুর্কী সুলতান মহম্মদ ঘোরির দলেই যোগ দিতে চেয়েছিলেন বখতিয়ার খলজি। কিন্তু স্বপ্ন সার্থক হয়নি। এদিকে অর্থ বলও তেমন নেই যে ঘোড়া, অস্ত্রসস্ত্র, সেনা নিয়ে ভারতাভিযান চালাবেন। যাই হোক, এক সময় তিনি দিল্লির সুলতান বকুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানেও বিশেষ লাভ হয়নি। বদাউনের শাসনকর্তা মালিক হিজবর-উদ-দীনের কাছে কিছুদিন চাকরি করার পর বখতিয়ার চলে যান অযোধ্যায়। এখান থেকেই তাঁর ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হওয়ার শুরু। অযোধ্যার শাসক হুসাম-উদ-দীন বখতিয়ারকে ভিউলী ও ভগত নামে দু’টি পরগনার জায়গীর প্রদান করেছিলেন। এই দুই জায়গার সীমান্তরক্ষী ছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর মতোই ভাগ্যান্বেষী মুসলিমরা খিলজী সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজন এসে ইখতিয়ার উদ্দিনের সঙ্গে যোগ দেয়।
তাঁর দল এইবার জায়গায় জায়গায় অভিযান শুরু করে। প্রথমেই তারা ওদন্তপুরী মহাবিহার ধ্বংস করে ওই স্থানের নতুন নামকরণ করে বিহার শরীফ। এরপর ধ্বংস করেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বিহার জয় করে লোভী বখতিয়ারের নজর পড়ে বাংলার দিকে।
পরের বছর আরও সেনা নিয়ে তিনি আক্রমণ করেন নদীয়া। বখরতিয়ার খিলজির ঘোড়া এত জোড়ে ছুটছিল যে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পেরেছিলেন ১৮ জন। বাদবাকি সৈন্যরা ছিল পেছনে। ঐতিহাসিক মিনহাজের লেখনী থেকে এই তথ্য মেলে।
লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল ঢাকায়। কিন্তু সেই সময় তিনি নদীয়ায় এসেছিলেন তীর্থ করতে। তুর্কী আক্রমণের আন্দাজ আগেই করেছিলেন লক্ষণ সেন। শুধু তাঁর আন্দাজে একটু ভুল ছিল। আসলে বৃদ্ধ সম্রাট ভেবেছিলেন, রাজ্যের মূল প্রবেশপথ তেলিয়াগড় গিরিপথেই বহিঃশত্রু আসবে। আক্রমণ ঠেকানোর জন্য তিনি প্রহরাও বসিয়েছিলেন। সুচতুর বখতিয়ার তা বুঝতে পেরে অন্য পথ ধরেন। তিনি দক্ষিণ দিকের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা ঝাড়খন্ডের মধ্যে দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। শুধু তাই নয় খিলজি বাহিনী বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শহরে প্রবেশ করেছিল। বখতিয়ার খিলজি ছিলেন বেঁটে খাটো , লম্বা হাত, চেহারাও আহামরি কিছু ছিল না। ফলে এই মানুষ যে একটি শহর লুঠ করতে পারে তা কেউ ভাবতেই পারেনি। সবাই-ই ভেবেছিল এই ছোট ছোট দলগুলি আসলে ঘোড়া ব্যবসায়ী।
রাজা সেই সময় সবে দুপুরের খাবার খেতে বসেছিলেন। আচমকা প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে আসে খলজির বাহিনী। তারা প্রহরীদের মেরে প্রাসাদে প্রবেশের আগেই বৃদ্ধ রাজা গঙ্গা পেরিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হন। পরিস্থিতি এমনই ছিল প্রাণ বাঁচাতে লক্ষণ সেনকে খালি পায়ে পেছনের দরজা দিয়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে পালাতে হয়েছিল। ৩ দিন ধরে নদিয়ায় লুটপাট চালান বখতিয়ারের বাহিনী। প্রচুর ধন সম্পদ লুঠ করে সেখান থেকে। কোনও বাধাই প্রায় তিনি পাননি। নদিয়ার নতুন নামকরণ করেন তিনি লখনৌতি।
বাংলার এক অংশ জয় করে সেখানে শাসনকার্য শুরু করেছিলেন তিনি। তবে লোভ তাঁর পিছু ছাড়েনি। নদিয়া জয়ের পর দুর্গম তিব্বত জয় করতে বেরিয়েছিলেন তিনি। এই অভিযানে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ নন। প্রচুর সেনা মারা পড়ে। এই ব্যর্থতায় ভেঙে পড়েন খিলজি। অবশেষে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মারা যান বাংলায় প্রথম তুর্কী আক্রমণের কাণ্ডারী।
Source : “sportsnscreen” via Dailyhunt