আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার – অগাধ পাণ্ডিত্য ও অনুপ্রেরণার এক পুরোধা

ইতিহাস হল সমাজ দর্পণ এবং একজন ঐতিহাসিকের কাজ হল একটি যুগের ঘটনাবলী ধৈর্যসহকারে কোন কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। সময়ের সাথে সাথে ফ্যাশনের আদব-কায়দার পরিবর্তন হলেও ইতিহাসের লক্ষ্যের কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটেনি। সর্বোপরি ইতিহাস হলো একটি অবিরাম সাধনা, একটি পবিত্র আহ্বান যা সাবধানতার সাথে অতি যত্ন সহকারে গ্রহণ করা উচিত যাতে এই সাধনালব্ধ ফলগুলি অতীতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং নির্ভুল চিত্র উপস্থাপন করতে পারে। প্রাথমিকভাবে এটা আমাদের মনে রাখা দরকার, ইতিহাস অতীতের জনজীবনের জনমানুষের কথাও বলে এবং আমরা যে উচ্চতর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার যুগে বসবাস করছি সেই ধারণাও দেয়, যেখানে অন্য ব্যক্তির সংবেদনশীলতাকে আঘাত করা বা অন্যকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত যত্ন নেওয়া হয় না, এটি একটি বিশিষ্ট বোধ বা অনুভূতি গঠন করে যা আমাদের নির্দেশ করে অতীতে জনজীবনের পর্যালোচনা করার সময় আমাদের বর্তমানের সঙ্গে একই মানদণ্ড প্রয়োগ করা উচিত।

আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার উপরোক্ত ইতিহাসের সংজ্ঞার মূর্ত প্রতীক। তিনি জীবন এবং মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রেই কিংবদন্তী ছিলেন এবং প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে একটি পূর্ণ, কার্যক্ষম এবং গুরুত্বপূর্ণ জীবন যাপন করেছিলেন:১৮৮৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকানিবন্ধ এখানে দেওয়া হলো :-

  • জন্ম ১৮৮৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর, খান্দাপাড়া জেলা,ফরিদপুর। অধুনা বাংলাদেশ। তিনি তিন ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ।
  • অন্য একজন উজ্জ্বল শিক্ষাবিদ ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী স্যার আশুতোষ মুখার্জী, তৎকালীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পরামর্শ মোতাবেক রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন ১৯১৪ সালের জুন মাসে।
  • “প্রাচীন ভারতীয় কর্পোরেট জীবন”নামক পিএইচডি থিসিসটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল।
  • বিভিন্ন পর্যায়ে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ ইণ্ডোলজি কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন এবং তারপ নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও বেশকিছুদিন অধ্যাপনার কাজ করেন।
  • তিনি শিকাগো ও পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক ছিলেন।
  • তিনি গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যাণ্ড এবং বোম্বের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির অবৈতনিক কর্মী ছিলেন।
  • তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ কলকাতা সভাপতি হয়েছিলেন, পুনের ভাণ্ডারকর অরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সম্মানীয় সদস্য ছিলেন।
  • তাঁকে ইণ্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস এবং  সর্বভারতীয় প্রাচ্য অধিবেশনের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়েছিল।
  • তাঁকে কলকাতা রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের সভাপতিও করা হয়েছিল।
  • তার অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৮ সালে তিনি কলকাতার শেরিফ নিযুক্ত হন।

এখানে প্রথমযুগীয়  বৃত্তি নিয়ে তার কর্তৃক অনুমোদিত কাজগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা দেওয়া হলো। আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার মূলত ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় মোট পঁয়ত্রিশটি খণ্ড এবং শতশত নিবন্ধ ও কাগজপত্র লিখেছিলেন।

  • ইতিহাস ভারতীয় উপনিবেশ বাংলার ইতিহাস বাংলার আদি ইতিহাস, ঢাকা, ১৯২৪ (The Early History of Bengal, Dacca, 1924.)
  • চম্পা, সুদূর প্রাচ্যের প্রাচীন ভারতীয় উপনিবেশ (Champa, Ancient Indian Colonies in the Far East)
  • সুবর্ণদ্বীপ; সুদূর পূর্বে ভারতীয় উপনিবেশ (Suvarnadvipa, Ancient Indian Colonies in the Far East)
  • বাংলার ইতিহাস (The History of Bengal,)
  • কম্বুজা দেশ বা কম্বোডিয়ার হিন্দু উপনিবেশ (Kambuja Desa Or An Ancient Hindu Colony In Cambodia)
  • ভারতের ইতিহাসের অগ্রগতির কাহিনী (An Advanced History of India)
  • ভারতবাসীর ইতিহাস কৃষ্টি সংস্কৃতি (এগারো খণ্ডে): সাধারণ সম্পাদক (The History and Culture of the Indian People (in eleven volumes): General Editor)
  • ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস (তিনটি খণ্ড) [History of the Freedom movement in India (in three volumes),]
  • বকাটক– গুপ্তযুগ (আনুমানিক 200 থেকে 250 খ্রীষ্টাব্দ) (Vakataka – Gupta Age Circa 200–550 A.D.)
  • সুদূর পূর্বের হিন্দু উপনিবেশ সমূহ (Hindu Colonies in the Far East)
  • ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া (India and South-East Asia)
  • প্রাচীন লাক্ষাদ্বীপের ইতিহাস (The History of Ancient Lakshadweep)

দুর্ভাগ্যবশত আমি বাংলা ভাষা জানিনা কিন্তু যারা বাংলা ভাষা জানেন ও বুঝতে পারেন তাদের কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ দয়া করে তাঁর অনুপ্রেরণামূলক আত্মজীবনী “জীবনের স্মৃতিদীপিকা” পড়ুন এবং উপলব্ধি করুন যার কিছু অংশের অনুবাদ পড়ে আমি মোহিত হয়ে রয়েছি।

প্রথম জীবন

আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের প্রথম জীবন খুব একটা সহজ ছিল না। মাত্র আঠারো মাস বয়সে তিনি তার জন্মদাত্রী মাকে হারিয়েছিলেন এবং তাঁর কাকিমা তাঁকে লালনপালন করে করে বড়ো করে তোলেন বাকি ভাইবোনদের সঙ্গে। তিনি এমন এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে দারিদ্রতা ছিল নিত্যসঙ্গী। তাঁর নিজস্ব পরিভাষায় তিনি খুব সুন্দর করে বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন:

এমন অনেক দিন গেছে আমরা দুদিন বা তারও বেশি সময় একনাগাড়ে অভুক্ত থেকেছি। যখন আমরা পাঁচ ছবছর বছর বয়সী ছিলাম তখন পাঁচ ছ‌আনা দামের এক ধরনের পোশাক আমাদের পরার জন্য দেওয়া হতো আমরা যার নাম দিয়েছিলাম ‘নিমা’ (ছোট্ট ছোট্ট বোতাম আঁটা আঁটোসাঁটো জামা) এই দিনগুলো ছিল ভীষণ পীড়াদায়ক। আমাদের একজোড়া ভালো চটি জুতো ছিলনা সেসময়। একদিন রাত্রে আমি প্রায় বন্যার জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছিলাম আমার কাকিমা হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং আমাকে বাঁচিয়ে তোলে তাই আমি আজ জীবিত রয়েছি এবং আমার জীবনের গল্প তোমাদের সামনে তুলে ধরতে পারছি।

কিন্তু এগুলোই সব ছিলনা। রমেশচন্দ্র মজুমদার বর্ণনা করেছেন কিভাবে ওই দিনগুলিতে কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে তাঁরা বড় হয়েছেন।

তখন বাস বা ট্রেন কিছুই ছিলনা যাতায়াতের জন্য, এমনকি ভালো রাস্তাঘাট‌ও ছিল না। সুতরাং সাঁতার শেখা অবশ্যম্ভাবী ছিল। জ্বালানির দরকার নেই, লাইনে দাঁড়ানোর দরকার নেই,  সোজা জলে ঝাঁপ মেরে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাও। আমরা যখন বিদ্যালয় যেতাম তখন কলার ভেলায় চড়ে  অথবা অশক্ত তালের গুঁড়িতে চেপে যেতাম যাতে করে নিজেরা শুকনো থাকতে পারি। তখনকার দিনে তালপাতায় লেখার চল ছিল, কিন্তু আমাদের বিদ্যালয় আমরা কলার পাতায় লিখতে পছন্দ করতাম যেহেতু খুব সহজেই সেগুলো পাওয়া যেত। আমরা ধারালো বাঁশের লাঠি ব্যবহার করতাম সেগুলোর ওপর লেখা জন্য।

খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি নিজেকে ক্ষুরধার মেধাসম্পন্ন এবং বৃত্তি প্রাপ্ত ছাত্র হিসেবে আলাদা করে তুলেছিলেন  এবং ধারাবাহিকভাবে নিজের জায়গা ধরে রেখেছিলেন উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত। বাংলায় প্রবাহিত পদ্মা নদীর মতো তাঁর প্রতিভার কূলকিনারা করা অসম্ভব ছিল। কলেজে থাকাকালীন তাঁর ইতিহাস অধ্যয়নের প্রতি আজীবনের জন্য ভালোলাগা জন্মায় এবং সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ ব্যাপারে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন।

একজন ঐতিহাসিকের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন:-

” সর্বপ্রথম একজন ঐতিহাসিককে আবেগ, কুসংস্কার ,পূর্বকল্পিত ধ্যানধারণা এবং সমস্ত মানবিক অনুভূতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে কারণ এগুলি তাঁর পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে।”

তিনি স্কুলজীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর শোবার ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের একটি বড় তৈলচিত্র টাঙানো ছিল। এই সমস্ত ঘটনার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ঘটনা বিশেষের দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ফলস্বরুপ ভারতবর্ষের চিরন্তন প্রতিভা সম্পর্কে তার হৃদয় এক দৃঢ় প্রত্যয় জন্ম নেয় এবং তিনি নিজেকে একজন মহান দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বতন্ত্র করে তুলতে সক্ষম হন। প্রকৃতপক্ষে, ভারতবর্ষের সঙ্গে  তাঁর এই আত্মিক সংযোগ‌ই ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে তদন্তের জন্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তিনি শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে ভারতীয় সভ্যতা হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম সভ্যতা এবং দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে বৃহত্তমের স্থান অধিকার করে ছিলাম।

গবেষণা ও পাণ্ডিত্যে সেরাদের সেরা

রমেশচন্দ্র মজুমদার ইতিহাসের দুষ্প্রাপ্য পুঁথি এবং অল্প পরিচিত বিষয়গুলির উপর গবেষণা ও লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, তাঁর সময়ে দক্ষিণ পূর্ব ভারতে ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব সম্পর্কে বিশেষ তথ্য জানা যেতো না বা  কোনো। তথ্য ছিল না বললেই চলে তিনি সেই বিষয়টিকে সামনে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ফলাফল হিসেবে বেশ কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করা যায় :-

  • Champa, Ancient Indian Colonies in the Far East (includes today’s Malaysia, Vietnam, and Cambodia) চম্পা,সুদূর পূর্বের প্রাচীন ভারতীয় উপনিবেশ (আজকের মালয়েশিয়া ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া যুক্ত ছিল)
  • Suvarnadvipa (Burma or Mynmar) সুবর্ণ দ্বীপ (বার্মা বা মায়ানমার)
  • (Kambuja Desa Or An Ancient Hindu Colony In Cambodia) কম্বুজা দেশ বা  কম্বোডিয়া (একটি প্রাচীন হিন্দু উপনিবেশ)
  • (India and South-East Asia) ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া

রমেশচন্দ্র মজুমদার এই বইগুলি লেখার জন্য অন্য কোন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেননি বরং তিনি নিজে ওই জায়গাগুলিতে গিয়ে মাসের-পর-মাস থেকেছেন এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন, আঞ্চলিক ভাষায় লেখা লিপিগুলো পড়েছেন, দুষ্প্রাপ্য পুঁথির পাঠোদ্ধার করেছেন।  এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি এক‌ইসঙ্গে যথেষ্ট ধৈর্য্য, সময়সাপেক্ষ এবং বিরক্তিকর ছিল। ভবিষ্যতে গবেষণা ক্ষেত্রে নিযুক্ত ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই বইগুলি অত্যন্ত মূল্যবান এবং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সম্ভবত রমেশচন্দ্র মজুমদার‌ই হচ্ছে প্রথম যিনি প্রাচীন লাক্ষাদ্বীপ নিয়ে বিস্তারিত ভাবে লিখেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা চলতি কথাটি উপমা হিসাবে ব্যবহার করা যায়, হাতি যখন রাস্তা দিয়ে চলে সে নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেয়।

কিন্তু, সর্বোপরি রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ভুলত্রুটির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং তিনি এ ব্যাপারে অত্যন্ত সৎ ছিলেন। এর পাশাপাশি বিপর্যয়ের মুখে তিনি নির্ভীকভাবে এগিয়ে যেতেন তাঁর সাহস ছিল অপরিসীম। তিনি কে, কি তাঁর পরিচয় সেসব তার কাছে কোনো বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করত না, কোনো পরিস্থিতিতেই তিনি সত্যের সঙ্গে আপস করতে রাজি ছিলেন না। তাঁর নিজস্ব পরিভাষায় বলতে গেলে, “ইতিহাস কখনো কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে বিশেষ খাতির যত্ন করে চলে না। একজন ঐতিহাসিক সর্বদা সত্যকে উন্মোচনের জন্য সংগ্রাম করে যাবে” এবং আচার্য এমন এক কঠিন সত্যটিকে বলে দিয়েছিলেন যার জন্য তাঁকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাব নেহেরু একপ্রকার নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন তাঁর কর্মজীবন আর আগের মত সুষ্ঠু স্বাভাবিক থাকবে না। কিন্তু এর পেছনে আসল কারণ কি ছিল?

আসলে রমেশচন্দ্র মজুমদার খোলাখুলি জানিয়েছিলেন তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপারে কিছু গোপন তথ্য প্রকাশ করতে চলেছেন এবং নবাব নেহেরু ও গান্ধীজীর ভূমিকা নিয়ে কিছু অবাক করা সত্য কাহিনী এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ করবেন। নেহেরু ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দিনরাত নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাঁর পিছনে উঠেপড়ে লেগেছিল এবং সে  ব্যাপারটি এই নিবন্ধে বিশদে  আলোচিত হয়েছে।

কিন্তু এই গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি তাঁর নিজের ভাষাতেই শুনে নেওয়া যাক:-

১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ অবধি যে মাটি-কামড়ানো লড়াইটা হয়েছিল, আমি তা নিজের চোখে দেখেছি। সেই দেখায় কোনো আবেগ বা অনুভূতি মিশে ছিল না – এমন দাবি আমি করি না। তবু আমি চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য নিরপেক্ষ থাকতে। অন্যদের তুলনায় আমার একটা সুবিধা ছিল। আমি এমন অনেক কিছুর সাক্ষী ছিলাম যারা ইতিহাসে এক-একটা দিকচিহ্ন হয়ে থেকেছে। যাঁরা পরে, শুধু কাগজ বা ফটো দেখে সেই পরিস্থিতি বা সেইসব মানুষের সম্বন্ধে ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করেন, তাঁদের তুলনায় আমার কাজটা সহজ ছিল।

আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ গবেষক হিসেবে সম্পূর্ণ একাকী নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন এবং উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং অবশেষে “সরকারি” নেহেরু সংস্করণ প্রকাশের পাঁচ বছর আগে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের ঘটনাবলী ধাপে ধাপে তিনটি খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন। আমি ভীষণভাবে জোর দিয়ে বলেতে বলতে পারি আজকের দিনের দাঁড়িয়েও এই খণ্ডগুলি এক এবং অদ্বিতীয় যার কোনো দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।

ভারতবাসীর ইতিহাস কৃষ্টি সংস্কৃতি (এগারো খণ্ডে)

সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল “ভারতবাসীর ইতিহাস কৃষ্টি সংস্কৃতি” নামাঙ্কিত এগারোটি  খণ্ডে প্রকাশিত অসাধারণ রচনা,যা তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন। এই কার্যটি আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার ও কে.এম. মুন্সীর অসামান্য বুদ্ধি আধ্যাত্মিক ও দেশপ্রেমের সম্মিলিত রূপ ছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার কে.এম.মুন্সীর মধ্যে এমন এক সমর্থককে খুঁজে পেয়েছিলেন যিনি ঐতিহাসিক সত্য প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আবেগাপ্লুত ছিলেন এবং কে.এম.মুন্সী ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সেরা মানুষটির সন্ধান পেয়েছিলেন রমেশচন্দ্র মজুমদারের মধ্যে। প্রকল্পের কোন দিক নিয়ে কে.এম. মুন্সী কোনদিনই আচার্যকে একটাও প্রশ্ন করেননি। তিনি কেবলমাত্র প্রতিটি খণ্ড কবে লেখা হয়েছিল এবং কবে প্রকাশিত হয়েছিল সেটুকু লিখেই সন্তুষ্ট ছিলেন। এখানে মুন্সির ভারতের ইতিহাস সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল তা নিয়ে আলোচনা করা হল :-

“আমি আমাদের তথাকথিত ভারতীয় ইতিহাসের অপ্রতুলতা দীর্ঘদিন যাবৎ অনুভব করছি.. আমি বহু বছর ধরে ভারতের ইতিহাসের বিস্তারিত বর্ণনা একত্রিত করার পরিকল্পনা করেছিলাম। ভারতীয়রা জন্মলগ্ন থেকে যে ইতিহাসের সাক্ষী গোটা বিশ্ব যেন সেই ইতিহাসের এক ঝলক দেখতে পারে সেই চেষ্টায় আমি করে আসছি। ভারতের ইতিহাস শুধুমাত্র বিদেশীরা কিভাবে ভারতীয় জনগণের উপর আগ্রাসন চালিয়েছিল সেই গল্প বলে না বরং আমরা কিভাবে তাদের প্রতিহত করে শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে এনেছিলাম সেই কাহিনী ও তুলে ধরে।”

প্রকৃতপক্ষে “অন্তর্দৃষ্টি” (vision) শব্দটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়:- কে.এম. মুন্সী দ্বারা গৃহীত এটি একটি মহা সংকল্প ছিল। এই মহাসংকল্পটির উদ্দেশ্য একমাত্র সঠিক মাত্রায় অনুধাবন করতে পেরেছিলেন আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার। “ভারতীয়দের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংস্কৃতি” বইটির কাজ শেষ করতে প্রায় বত্রিশ বছর সময় লেগেছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদার এই কাজের জন্য ভারতবর্ষের তাবড় তাবড় পণ্ডিত ব্যক্তিদের এক ছাতার তলায় নিয়ে এসেছিলেন যারা তাঁর আবেগ ও আত্মোৎসর্গের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন এবং নিজেদেরকে এই মহান কার্যক্রমের অংশীদার করে তুলেছিলেন। ভারতীয় বিদ্যাভবন দ্বারা প্রকাশিত এগারো খণ্ডে  বিভক্ত এই বইটিতে বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসের খুঁটিনাটি তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং এখনও পর্যন্ত এই খণ্ডগুলিই হচ্ছে সেই সময়ের ইতিহাসের একমাত্র বহুল তথ্যসমৃদ্ধ ব‌ই।এই সমগ্র কাজটি যখন শেষ হয় তখন আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের বয়স হয়েছিল অষ্ট‌আশি বছর অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর ঠিক চার বছর আগে এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল।

আচার্যের নিজের কথা উদ্ধৃত করার চেয়ে নিবন্ধটি শেষ করার আর কোনো ভালো উপায় নেই :-

“আমার বক্তব্য সবার পছন্দ নাই হতে পারে। সত্যি বলতে কি, এদেশের অনেকেই এই কথাগুলোর প্রবল বিরোধিতা করবেন – এও আমি জানি। তবে সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি’র লেখা একটা কথা আমাকে সান্ত্বনা দেয়~ ‘কেউ-না-কেউ, কোথাও-না-কোথাও, কখনও-না-কখনও আমার কথাগুলো বুঝবেনই, কারণ কাল নিরবধি এবং পৃথিবীও বিপুলা’।”

আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপনের সবচেয়ে ভালো উপায় হল:- তাঁর কাজগুলির পুনর্বিবেচনা ও সঠিক মূল্যায়ন করার পাশাপাশি সেগুলো সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচার করা। এগুলো কেবল ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ জ্ঞানগর্ভ কাজ নয় বরং সভ্যতার পথনির্দেশক স্তম্ভ।

ধর্ম ডিস্প্যাচ পত্রিকায় প্রকাশিত মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন সদানন্দ গৌড়াপ্পা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.