২০০৪ সালের রিচার্ড লিঙ্কলেটারের ছবি ‘বিফোর সানসেট’-এর একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে নোতর দাম ক্যাথিড্রালের দিকে তাকিয়ে প্রেমিকা জেসি তাঁর প্রিয়তম সেলিনকে বলছেন, ‘‘আমার মনে হয় প্যারিসের নোতর দাম একদিন শেষ হয়ে যাবে।’’ ইতিহাসের এই চরম বিপর্যয়ের দিনে এই কথাটাই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে টুইটারে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রায় ৮৫৬ বছরের পথ চলা। ফরাসী বিপ্লব, নেপোলিয়ন থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা সয়েও আপন গরিমায় মাথা উঁচু করে বেঁচেছিল নোতর দাম। এর পর সেইন নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বাড়তে থাকা সন্ত্রাস, বিপ্লব, দূষণের অত্যাচারের মুখে বিদ্রোহ ঘোষণা করে আপন স্থাপত্য, ভাস্কর্য, পুরাকীর্তি আর ভালোবাসার সম্ভার নিয়ে আধুনিক বিশ্বের কাছে সে ছিল একটা মাইলস্টোন। ফ্রান্সের গর্ব। কোনও এক অজ্ঞাত, নির্মম, নিষ্ঠুর অগ্নিবাণ এসে সেই গর্বকেই আজ ছিন্নভিন্ন করে দিল। গথিক স্থাপত্যের ইট, কাঠে আজ পোড়া ছাইয়ের গন্ধ।
স্থানীয় সময় আন্দাজ সাড়ে ৬টা। মঙ্গলবার। প্যারিসের আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সাপের মতো ফণা তুলে তার প্রতিটি পাক যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে নোতর দামকে। আগুনের নির্দয় বাহুপাশে দমবন্ধ হয়ে একটু একটু করে ধসে পড়ছে শতাব্দীর এই অনন্ত সৃষ্টি। অসহায় হয়ে নিজেদের গরিমাকে ধুলোয় মিশে যেতে দেখছে প্যারিসবাসী। আগুনের ধ্বংসলীলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে উদ্ধারের কোনও রাস্তা নেই। প্রায় সাড়ে পাঁচশো দমকলকর্মীর হাতে সবটুকুই ছেড়ে দিয়ে ক্যাথিড্রালের সামনে তাই কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে অগণিত মানুষকে। কারও কণ্ঠে গান, কেউ মাদার মেরির কাছে প্রার্থণারত, কারও বুক ফাটা আর্তনাদ কালো ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে ভারী প্যারিসের আকাশ।
সরকারি সূত্র বলেছে, ২০-২৫ মিনিটের অপারেশনে আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন দমকলকর্মীরা। গুরুতর জখমও হয়েছেন একজন। আগুন নিভেছে, প্রশাসনের তৎপরতায় প্রাণহানিও রোখা গেছে, কিন্তু নোতর দাম বাঁচেনি। রাজ মুকুটের মতো মাথা থেকে খসে পড়েছে তার অহঙ্কারের ধাতব মিনার। এই চূড়াটিকেও এর আগে (১৭৮৬ সালে) খুইয়ে সংস্কারের পরে ফিরে পেয়েছিল সে। প্যারিসের সমস্ত সংবাদ মাধ্যম, সরকারি সূত্র বলছে ক্যাথিড্রালের মূল কাঠামো অক্ষত। অসংখ্য পুরাকীর্তি যেমন ধ্বংস হয়েছে, তেমনি আগুনের গ্রাস থেকে নিস্তারও পেয়েছে কিছু। কিন্তু, নোতর দাম? ভিতরের কঙ্কালটাই শুধু বেঁচে আছে, তাতে প্রাণ নেই।
ইতিহাস আজও কথা বলে
নোতর দাম-দে প্যারিস মানে Our Lady Of Paris। নামের মাঝেই তার পরিচয়, বৈশিষ্ট্য। প্যারিসের সত্তার সঙ্গে জুড়ে আছে সে, একান্ত আপন, নিজের। নোতর দামের আগে তৈরি হয়েছিল আরও চারটি উপাসনালয়। শেষ ক্যাথলিক গির্জা ছিল রোমানেস্ক। যার সংস্কার হলেও পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পায়নি।
১১৬০ খ্রিষ্টাব্দে বিশপ মোরিস দে সাল্লির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ শুরু হয় নোতর দামের। ১১৬৩-র ২৪ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে চারটি পর্যায়ে নির্মাণ শুরু করেন শিল্পীরা। নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রাজা সপ্তম লুই এবং পোপ আলেক্সাজান্ডার তৃতীয়। নানা পর্যায়ে পেরিয়ে নির্মাণ শেষ হয় ১২৬০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৭৯০ পর্যন্ত একাধিক বার নির্মাণ গঠনে বদল আসে, সংস্কারও হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, চতুর্দশ লুইয়ের শাসন কালে (১৬৪৩-১৭১৫) এই বদলটা ছিল খুবই অপ্রত্যাশিত। গথিক রীতির নির্দশনবাহী নকশা কাটা কাচের জানলার জায়গায় স্থান পেয়েছিল সাধারণ জানলা। প্রবেশ পথ থেকে ভিতরের শিল্পতেও পরিবর্তন এসেছিল অনেকটাই। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব বড় নির্দয় হয়ে দেখা দেয় নোতর দামের ভাগ্যে। ধর্মীয় রীতির একাধিক স্মারক, প্রাচীন মূর্তি নির্বিচারে ধ্বংস করেছিলেন বিপ্লবীরা।
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে নেপোলিয়নের শাসনকালে এর পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়। ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে ফের ক্যাথলিকদের হাতে যায় নোতর দাম, তবে এর অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা রোখা যায়নি। সেই সময় ইউজেন-ইমানুয়েল ভায়োলেট-লে-ডুকের নকশায় পুনর্নির্মিত হয় নোতর দাম। তিনি ছিলেন গথির শিল্পরীতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তাঁরই কারিগরি দক্ষতায় নোতর দামের কাঠামোয় লাগে গথিক রীতির ছোঁয়া। কালে কালে ক্যাথিড্রাল হয়ে ওঠে গথিক স্থাপত্য-ভাস্কর্যের গরিমা। জোসেফিনের সঙ্গে নেপোলিয়নের বিয়ের স্থানও ছিল নোতর দাম। বহু কালজয়ী সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে নোতর দাম। তারই মধ্যে একটি ভিক্তর হুগোর ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নোতর দাম’।
উনিশ শতকের দোরগোড়ায় নোতর দামের গরিমা তখন অনেকটাই থিতিয়ে। ফরাসী বিপ্লব তার অর্ধেকের বেশি ধ্বংস করে দিয়েছে। ১৮৩১ সালে এই ফরাসি কবির লেখনীতে নোতর দামকে ফের নতুন করে চেনে বিশ্ববাসী। এর সৌন্দর্য ও ইতিহাসকে পরতে পরতে নিজের সাহিত্যে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন হুগো। ১৮৪৪-এ সম্রাট লুই ফিলিপ নতুন করে নোতর দামকে গড়ে তোনার কাজে হাত দেন। ১৯৪৪-এর অগস্টে গুলিবিদ্ধ হয় নোতর দাম। এর সিসার ছাদ এবং অসংখ্য কাঁচের জানলা ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল।
রক্ষা পেয়েছে যিশুর মুকুট, রোজ উইনডো, ইমানুয়েল
ত্রয়োদশ শতকের তিনটি রোস উইনডো (নকশা কাটা নানা রঙের জানলা গথিক শিল্পের সেরা আকর্ষণ) নোতর দামের অন্যতম ঐতিহ্য। সবচেয়ে ছোটটি পশ্চিমের কোণায় তৈরি হয় ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে। ৮৪টি প্যানেলের নকশা কাটা দক্ষিণেরটি ১৩ মিটার ব্যাসের। উত্তরের জানলাটির সঙ্গে আবার রয়েছে ১৮টি সমান্তরাল ছোট জানলা, প্রতিটিতে নকশা কাটা। যদিও এর আসল কাঁচের কারুকার্য এখন আর নেই, আগের অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে পুনর্নির্মিত জানলাগুলি এই অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছে। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যরীতির বিশেষজ্ঞ এবং ঐতিহাসিক অ্যালিক্স বোভে বলেছেন, ‘‘আগুন লাগা মাত্রই মনে হয়েছিল এই কাঁচের জানলাগুলি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তবে আগুন নিভলে স্বস্তি আসে, দেখা যায় তিনটি রোস উইনডো সুরক্ষিত রয়েছে।’’
হোলি ক্রাউন বা ‘ক্রাউন অব থর্নস’। কাঁটার মুকুট। যিশু খ্রিষ্ট স্বয়ং এই মুকুট মাথায় ধারণ করেছিলেন বলেই বিশ্বাস অধিকাংশের। ১২৩১ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি সম্রাট নবম লুই যখন ক্যাথিড্রালের সংস্কারের কাজ করছিলেন সেই সময় গির্জার ভিতরে সুরক্ষিত রাখা হয় এই মুকুট। আগুন অবশ্য এই ঐতিহ্যে দাগ কাটতে পারেনি। ‘ক্রাউন অব থর্নস’ তার নিজের গরিমায় এখনও অবিচল।
আগুন থেকে বেঁচে গিয়েছে ক্যাথিড্রালের মূল ঘণ্টা ‘ইমানুয়েল।’ এর ওজন ২৩ টন। ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দে এটি ক্যাথিড্রালের দক্ষিণ মিনারে স্থানান্তরিত করা হয়। তা ছাড়াও নোতর দামে রয়েছে নানা আকার ও ওজনের আরও দশটি ঘণ্টা। ২০১৩ সালে নোতর দামের ৮৫০তম প্রতিষ্ঠাদিবন উদযাপনের সময় এগুলির মধ্যে ছোট ঘণ্টাগুলিকে ক্যাথিড্রালের উত্তর প্রান্তে স্থানান্তরিত করা হয়। ইমানুয়েল বেঁচে গেলেও, বাকিগুলির অবস্থা সম্পর্কে এখনও স্পষ্ট করে কিছু জানা যায়নি।
অজস্র দুর্মূল্য শিল্প সামগ্রী ও প্রাচীন ছবি সাজানো ছিল ক্যাথিড্রালের দেওয়ালে দেওয়ালে। তার কিছু উদ্ধার করে সিটি হলে রাখা ছিল, পরে সেগুলি লুভর মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত করা হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র। তবে অধিকাংশ চিত্রকল্প উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলেই জানিয়েছেন দমকলকর্মীরা। মাদার মেরির জীবনী চিত্রটি কী অবস্থায় রয়েছে তাও অজানা। গির্জায় রাখা খ্রিষ্টানদের অতি পবিত্র হোলি নেলস বা পবিত্র নখ রক্ষা পেয়েছে কিনা সেটাও জানা যায়নি। তবে যিশুকে যে কাঠে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল তার কিছু টুকরো রাখা ছিল নোতর দামে। সেগুলি আগুনের গ্রাস থেকে বেঁচে গিয়েছে।
সুরক্ষিত রয়েছে সুপ্রাচীন অরগ্যানগুলিও। ১৪০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি এমন অরগ্যান তৈরি হয় ক্যাথিড্রালে। মূল অরগ্যানে রয়েছে ৮০০০টি পাইপ। ডেপুটি মেয়র ইমানুয়েল গ্রেগরি ফরাসি সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই অরগ্যানগুলির কোনও ক্ষতি হয়নি।
৩০০ ফুট উঁচু প্রধান ধাতব চূড়াটি ভেঙে পড়লেও সুরক্ষিত রয়েছে এর জোড়া সৌধ। যে গুলি নির্মিত হয়েছিল ১২২০-১২৫০-এর মধ্যে। আইফেল টাওয়ার (১৮৮৯)তৈরির আগে ৬৯ মিটার উঁচু এই সৌধ দু’টিই ছিল প্যারিসের উচ্চতম টাওয়ার। দক্ষিণের সৌধটি উচ্চতায় উত্তরের থেকে কিছু বড়। প্রতিটিতে রয়েছে ৩৮৭টি সিঁড়ি যা শেষ হয়েছে গথিক হলে। গথিক শিল্পের অন্যতম নিদর্শন ক্যাথিড্রালের দু’টি স্থাপত্য Gargoyles ও Grotesques আগুনের করাল থাবা থেকে সুরক্ষিত। ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে এই দু’টি স্থাপত্য নোতর দামের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে যায়।
নোতর দামের পুনর্গঠনের জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ক্যাথিড্রালের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের অনেকটাই ফিরিয়ে আনা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ইতিহাসের এই বিপর্যয়ের দিনে নোতর দামকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বও। ফরাসি শিল্পপতি থেকে অ্যাপল সংস্থার সিইও টিম কুক— কোটি কোটি ডলার নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই।
পুনর্নির্মান হবে নিশ্চয়ই। ভযাবহ অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি একদিন মানুষের মন থেকে মুছে যাবে, কালের নিয়মেই। তবে যে নোতর দামের মৃত্যু হয়েছে, তাকে ফের পুনরুজ্জীবিত করা যাবে কি? ঐতিহ্যে, ইতিহাসে, দর্শনে, ভাস্কর্যে— পোড়া ছাইয়ের অতল গহ্বর থেকে জীবনের ফিনিক্স পাখি আরও একবার প্যারিসের আকাশে ডানা মেলবে কি? তার উত্তর মনে হয় বিশ্ববাসীর কাছে অজানা।