বিরাট কোহলি মানেই ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকদের কাছে সচিন তেন্ডুলকরের উত্তরসূরি। ভারতীয় ক্রিকেটে রাজার আসনে বসেছিলেন বিরাট। সমর্থকেরা নাম দিয়েছিলেন ‘কিং কোহলি’। বিরাট-রাজের সেই শাসন কি শেষ হচ্ছে?
ধারাবাহিকতার অভাব
এই বছর এখনও পর্যন্ত টেস্টে অর্ধশতরান নেই বিরাটের ব্যাটে। শেষ শতরানটি এসেছিল গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শতরানের পর টেস্টে তিন অঙ্কে পৌঁছতে বিরাটের লেগেছিল চার বছর। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আমদাবাদে ১৮৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু মাঝের চার বছরে তাঁর তিন প্রতিপক্ষের (স্টিভ স্মিথ, কেন উইলিয়ামসন এবং জো রুট) থেকে শতরানের সংখ্যায় হোক বা মোট রানে পিছিয়ে পড়েছেন বিরাট। কখনও বড় ইনিংস খেলে ম্যাচ জেতালেও, আগের মতো ধারাবাহিকতা দেখাতে পারছেন না বিরাট। যে কারণে তরুণ হাসান মেহমুদ বা ও’রুরকির মতো তরুণ বোলারেরাও বিরাটকে আউট করছেন।
শূন্যের রেকর্ড
বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৮তম বার শূন্য রানে আউট হলেন বিরাট। এখনকার ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বাধিক। ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যে তাঁর থেকে বেশি বার শূন্য রানে আউট আর কেউ হননি। জাহির খান (৪৩) এবং ইশান্ত শর্মা (৪০) তাঁর থেকে এগিয়ে থাকলেও দু’জনেই বোলার। এই লজ্জার রেকর্ডের কথা জানলে বিরাটের রাতে ঘুম আসা কঠিন। বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “এই তালিকায় বিরাটের নাম আসাটা দুর্ভাগ্যজনক। বিরাট বড় ব্যাটার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রচুর রান করেছে। ৩৮টা শূন্য করেছে বলে ৮০টা শতরান তো ভোলা যাবে না। এই ধরনের রেকর্ডে বড় ব্যাটারদের নাম মাঝে মাঝে চলে আসে।”
পড়ছে গড়
কিছু দিন আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৭ হাজার রানের মাইলফলক পার করেছেন বিরাট। টেস্টে ৯ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁতে আর মাত্র ৫৩ রান প্রয়োজন তাঁর। এক দিনের ক্রিকেটে আর ৯৪ রান করলেই ছুঁয়ে ফেলবেন ১৪ হাজার রানের মাইলফলক। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অবসর নিয়েছেন ৪১৮৮ রান করে। কিন্তু এক সময় সব ধরনের ক্রিকেটে বিরাটের গড় ছিল ৫০-এর উপরে কখনও কখনও তা ৬০-এর কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে টেস্টে বিরাটের গড় ৪৮.৮৯। ২০১৯-এর নভেম্বরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শতরানের পর থেকে এখনও পর্যন্ত মাত্র দু’টি শতরান করেছেন। ক্রমশ কমছে বিরাটের গড়। তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার, সমর্থকদের চাহিদাও তাই আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু বিরাট কি সেই আশা পূরণ করতে পারছেন?
নেটেও নাস্তানাবুদ
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ়ের মাঝে নেটে বিরাটকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন যশপ্রীত বুমরা। কানপুরে নেটে পেসারদের বিরুদ্ধে ব্যাট করছিলেন বিরাট। সেই সময় বুমরা তাঁকে ১০টি বল করেন। তার মধ্যে চার বার আউট হন বিরাট। এক বার তাঁকে এলবিডব্লিউ করেন বুমরা। দু’বার তাঁর ব্যাটে লেগে বল স্লিপের দিকে যায়। এক বার শর্ট লেগে ক্যাচ দেন তিনি। চার বারই বিরাট স্বীকার করে নেন যে তিনি আউট হতেন।
পেসারদের বিরুদ্ধে বার বার সমস্যায়
পেসারদের বিরুদ্ধে ম্যাচেও সমস্যায় পড়ছেন বিরাট। বৃহস্পতিবার তাঁকে আউট করলেন উইলিয়াম ও’রুরকি। বেঙ্গালুরুকে বিরাটের ঘরের মাঠ বলাই যায়। আইপিএলে বেঙ্গালুরু রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে খেলেন তিনি। সেই বেঙ্গালুরুতে ২৩ বছরের তরুণ ডানহাতি পেসারের বল হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। বিরাট সুইংয়ের মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে ব্যাট করছিলেন। আচমকা উঠে আসা বল বিরাটের গ্লাভসে লেগে চলে যায় লেগ গালিতে। সামনের দিকে ঝাঁপ দিয়ে ক্যাচ ধরেন গ্লেন ফিলিপ্স। বল ঠিক মতো ধরেছেন কি না জানতে তৃতীয় আম্পায়ারের সাহায্য নিতে হয়। তিনি জানিয়ে দেন বিরাট আউট। ভারতের প্রাক্তন নির্বাচক সম্বরণ বললেন, “বিরাটের উইকেটটা নিউ জ়িল্যান্ডের পরিকল্পনার ফসল। বিরাটের পা সাধারণত আড়াআড়ি থাকে। সেটারই সুযোগ নিয়েছে কিউই বোলারেরা। ওরা গায়ে বল করছিল। সাধারণত টেস্টের শুরুতেই লেগ গালিতে ফিল্ডার রাখা হয় না। কিউইরা ফাঁদ পেতেছিল। বিরাট সেই ফাঁদে পা দিয়েছে।”
পেসারদের বিরুদ্ধে বিরাটকে আগেও সমস্যায় পড়তে দেখা গিয়েছে। বিশ্বের কোনও পেসারের জানতে বাকি নেই বিরাটকে অফ স্টাম্পের বাইরে বল করলে ফাঁদে পা দেবেন। পঞ্চম বা ষষ্ঠ স্টাম্পে থাকা বলে বার বার খোঁচা দিয়ে আউট হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। বাঁহাতি পেসার হলে তো চিন্তা আরও বেড়ে যায় সমর্থকদের। মিচেল স্টার্ক, ট্রেন্ট বোল্ট, মহম্মদ আমিরের মতো বোলার চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিলেন বিরাটের জন্য।
সমস্যা স্পিনারদের বিরুদ্ধেও
শুধু পেসার নয়, কিছু কিছু সময় স্পিনারেরাও ত্রাস হয়ে ওঠেন বিরাটের জন্য। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেমন বিরাট উইকেট দিয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ এবং শাকিব আল হাসানকে। অনুশীলনে অক্ষর পটেলের বলে বোল্ড হয়েছিলেন তিনি। শেষ তিন বছরে লেগ স্পিনার এবং বাঁহাতি স্পিনারদের বিরুদ্ধে ২৭ বার আউট হয়েছেন বিরাট। কোভিডের আগে বিরাট স্পিনারদের বিরুদ্ধে যতটা আগ্রাসী ব্যাটিং করতেন, সেটা এখন আর দেখা যায় না। আগে স্পিনারদের বিরুদ্ধে বিরাটের পায়ের নড়াচড়া ছিল সাবলীল। সেটাই এখন অনেক মন্থর। ধীরে ধীরে কেরিয়ারের শেষের দিকে পা বাড়াচ্ছেন বিরাট?
জায়গা ছাড়ার সময় এসে গিয়েছে?
ভারতের হয়ে এক সময় চার নম্বরে ব্যাট করতেন সচিন। তিনি অবসর নেওয়ার আগেই ভারতীয় ক্রিকেট পেয়ে গিয়েছিল বিরাটকে। সচিনের জায়গা নেওয়া বিরাটের কি এ বার জায়গা ছাড়ার সময় এসে গিয়েছে?
বিরাট গত চার বছরে টেস্টে মাত্র দু’টি শতরান করেছেন। সেখানে রুট করেছেন ১৮টি শতরান। উইলিয়ামসন করেছেন ১১টি শতরান। স্মিথ করেছেন ছ’টি শতরান। পরিসংখ্যান কিন্তু বিরাটের পতনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ এই চার বছরে বিরাটের গড় ৩২.৯২। ৩১টি টেস্টে তিনি করেছেন ১৭৪৫ রান। সম্বরণ বলছেন, “যে কোনও সেরা ব্যাটারের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথম ১০-১২টা শতরান খুব তাড়াতাড়ি করছে। পরেরগুলি করতে সময় লাগে। কারণ তখন তাঁর দুর্বলতাগুলো বোলারেরা বুঝতে শুরু করেছে। বিরাটের ক্ষেত্রে যদিও এখন শতরান পেতে খুব বেশি সময় লাগছে। এতটাও উচিত নয়।”
বিরাটকে নিয়ে আশা ছাড়তে নারাজ সাবা করিম। ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার বললেন, “বিরাট খুবই পরিশ্রমী। ও অনুশীলনে নিজেকে উজাড় করে দেয়। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জ়িল্যান্ড, ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে রান করেছে। ওর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। এখন বিরাট টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছে। টেস্টে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আশা করি আগামী দিনে যে টেস্টে শতরান পাবে বিরাট।”
গত ১৬ বছরে বিরাট যে ভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করেছেন, ভারতকে ম্যাচ জিতিয়েছেন, তাতে বিরাটের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কঠিন। কিন্তু রান না পেলে তো যে কোনও ব্যাটারকেই বসতে হয়। ধারাবাহিক ভাবে রান না পেলে কখনও কখনও দলের বোঝা হয়ে উঠতে হয় বড় ক্রিকেটারকে। বিরাট সমর্থকেরা চাইবেন না বিরাটকে সেই সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখতে।
নিন্দকেরা যদিও ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলছেন। কেউ বলছেন বিরাটের সামনে এগিয়ে এসে খেলা উচিত হয়নি, কেউ বলছেন বিরাটের অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলা উচিত নয়, কেউ বলছেন বিরাট অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৭ হাজারের বেশি রান করা বিরাট শুনতে পাচ্ছেন কি?