‘নববর্ষের পণ’ কি মনে থাকবে বাঙালির?

নব বৎসরে করিলাম পণ

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নব বৎসরে করিলাম পণ–
লব স্বদেশের দীক্ষা,
তব আশ্রমে তোমার চরণে
হে ভারত, লব শিক্ষা।
পরের ভূষণ পরের বসন
তেয়াগিব আজ পরের অশন;
যদি হই দীন, না হইব হীন,
ছাড়িব পরের ভিক্ষা।
নব বৎসরে করিলাম পণ–
লব স্বদেশের দীক্ষা।

না থাকে প্রাসাদ, আছে তো কুটির
কল্যাণে সুপবিত্র।
না থাকে নগর, আছে তব বন
ফলে ফুলে সুবিচিত্র।
তোমা হতে যত দূরে গেছি সরে
তোমারে দেখেছি তত ছোটো করে;
কাছে দেখি আজ হে হৃদয়রাজ,
তুমি পুরাতন মিত্র।
হে তাপস, তব পর্ণকুটির
কল্যাণে সুপবিত্র।

পরের বাক্যে তব পর হয়ে
দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা।
তোমারে ভুলিতে ফিরায়েছি মুখ,
পরেছি পরের সজ্জা।
কিছু নাহি গণি কিছু নাহি কহি
জপিছ মন্ত্র অন্তরে রহি–
তব সনাতন ধ্যানের আসন
মোদের অস্থিমজ্জা।
পরের বুলিতে তোমারে ভুলিতে
দিয়েছি পেয়েছি লজ্জা।

সে-সকল লাজ তেয়াগিব আজ,
লইব তোমার দীক্ষা।
তব পদতলে বসিয়া বিরলে
শিখিব তোমার শিক্ষা।
তোমার ধর্ম, তোমার কর্ম,
তব মন্ত্রের গভীর মর্ম
লইব তুলিয়া সকল ভুলিয়া
ছাড়িয়া পরের ভিক্ষা।
তব গৌরবে গরব মানিব,
লইব তোমার দীক্ষা।

(উৎসর্গ কাব্যগ্রন্থ)
না , ইংরেজী নিউ ইয়ারের জন্য নয় এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন বাংলা নববর্ষকে উদ্দেশ্য করে। বাংলা নববর্ষে বাঙালি এই কবিতা পাঠ করে আটমাস পরেই ইংরেজি নববর্ষ পালন করতে পারে —- একে বাঙালির হুজুগ বলা হবে না আন্তর্জাতিক হওয়ার উদযাপন তার বিশ্লেষণ জরুরী।
‘লব স্বদেশের দীক্ষা’র কথাগুলো শুধুই কবিতার পঙক্তিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি কবিগুরু। নিজের প্রতিটি কাজে তার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন।
একজন বিজ্ঞানী যিনি উপনিষদের বাণীতে গভীরভাবে আস্থা রাখতেন এবং নিজের সারাটা জীবন ‘সর্বং খলিদং ব্রক্ষ্ম’-এর সত্যতা অর্থাৎ জীব ও জড়ের মধ্যে একইরকম চৈতন্যের উপস্থিতি প্রমাণ করতে ব্যস্ত, সেইসময় তাঁকে উৎসাহদান করেছিলেন কবিগুরু।সেই বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন কবিগুরুর পরম বন্ধু আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। কবিগুরু যখন গরমের ছুটিতে পাহাড়ে যেতেন সঙ্গী হতেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার , যিনি স্বদেশের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটনে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন — লিখেছেন গবেষণা আধারিত ছত্রপতি শিবাজীর গৌরবগাঁথা, ঔরঙ্গজেবের কুকীর্তি।সেই দলে আর একজন সন্ন্যাসিনী সঙ্গী হতেন — স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা ,নিজেকে যিনি নিবেদিত করেছিলেন ভারতবর্ষের নারীশিক্ষা , সংস্কৃতির উন্নয়নে আর তার সঙ্গেই ছিল স্বাধীনতা সংগ্ৰামে বিপ্লবীদের প্রেরণা দেওয়া।
কবিগুরু বলেছেন ‘তব সনাতন ধ্যানের আসন
মোদের অস্থিমজ্জা’ ।সেই অস্থিমজ্জায় প্রাণ দেওয়ার দায়িত্ব সমগ্ৰ সমাজের, প্রতিটি ব্যক্তির। আমাদের প্রত্যেকের জীবনপদ্ধতি , সনাতনী রীতি সেই অস্থিমজ্জায় প্রাণ জিইয়ে রাখবে, সমগ্ৰ রাষ্ট্রকে পুষ্টি দিবে।
কালগণনা একটি জনগোষ্ঠীর ‘সভ্যতা’ হিসেবে গণ্য হওয়ার অন্যতম শর্ত।যে পুরাতন সভ্যতাগুলির ক্ষেত্রে কালগণনার কোনো ইতিহাস জানা যায়, তাদের মধ্যে এখন শুধুমাত্র ভারতবর্ষই টিকে আছে।
মায়া, ইনকা, মিশরীয় সভ্যতা এখন ইতিহাসের পাতাতেও হারিয়ে যেতে বসেছে। একটিমাত্র মত,একটিমাত্র পথ, একটিমাত্র উপাস্যের ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ‘Civilization’ এর ধারণা প্রাচীন সংস্কৃতির গভীরে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানমনস্কতাকে বুঝতে পারে নি বা চায় নি।
ইউরোপে , আরবে যখন তরবারির জোরে মত প্রতিষ্ঠা চলছে আর ‘Civilization’ এর নতুন ধারণা জন্ম নিচ্ছে তার হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে যুক্তির মাধ্যমে মত প্রতিষ্ঠা সমাজের কাছে সাধারণ ব্যাপার —- বেদ , উপনিষদে আমরা গুরু-শিষ্যের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে, তর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন তত্ত্বের মিমাংসার উদাহরণ পাই।যে সংস্কৃতি ও সমাজ যুক্তিকে আপন সভ্যতার সূচনা থেকেই অগ্ৰাধিকার দিয়েছে তার পাশ্চাত্যের ধারণা অনুযায়ী ‘Civilization’ এর সার্টিফিকেট জোটে নি!
ভারতবর্ষকে তাই পাশ্চাত্যের ধারণা অনুযায়ী ‘Civilized’ করতে চেয়ে ভারতীয়দের মন থেকে আপন সংস্কৃতি সম্পর্কে অবজ্ঞা ভরে দিয়েছিল ইংরেজ শাসক—- উপনিবেশ হিসেবে ভারতীয় ভুখন্ডই তারা দখল করে নি , পরাধীন করেছিল ভারতীয় চিন্তাকে।তাই ভারতীয় মনের এই ঔপ্যনিবেশিক দাসত্ব স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ভারতবর্ষের পক্ষে অগৌরবের।
ভারতবর্ষে এই ঔপ্যনিবেশিক দাসত্বের চিহ্নগুলিকে ‘আন্তর্জাতিকতা’র নামে, ‘আধুনিকতা’র নামে টিকিয়ে রাখতে চান , তাদের কাছে প্রশ্ন ‘আধুনিকতা’র সংজ্ঞা কি ? আধুনিক যুগে কোনো তত্ত্ব , আচার , মতের বেঁচে থাকার জন্য যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে উত্তীর্ণ হওয়াকেই প্রধান শর্ত বলে মেনে নেওয়া যায়, তাহলেও ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিজ্ঞানকে, ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা’ বোঝার চেষ্টা করলেন না কেনো?
মার্ক্সবাদীদের মতে , অর্থই ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি এবং সংস্কৃতি তার উপরে গড়ে ওঠা একটা কৃত্রিম ইমারত যার সাহায্যে ক্ষমতার প্রয়োগ হয় নিঃশব্দে আর জিইয়ে রাখা হয় শ্রেণীবৈষম্য—- একথা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রমাণ করা গেলেও ভারতবর্ষের সংস্কৃতিকে এই তত্ত্বের ব্যতিক্রম হিসেবে খুব সহজেই বোঝা যায়।যদি ‘নববর্ষ’ পালনকেই আমরা উদাহরণ হিসেবে ধরে নিই তাহলে কালগণনার ইতিহাস নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতেই হয়।
যারা সংস্কৃতি , সমাজব্যবস্থা সমস্ত কিছুকেই শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে তারা তো চাইবেই সংস্কৃতির মৌলিকত্বকে ধ্বংস করে দিতে।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। বাংলার সংস্কৃতি বলতে কি বোঝাতে চেয়েছে বাঙালিয়ানা তথা ভারতীয়ত্বকে বিশ্বের সঙ্গে যোগ করতে চাওয়া বিশ্বভারতী? বাঙালির খাদ্য, বাঙালির বাদ্য, বাঙালির খোল আর বাঙালির দোল দেখিয়েছে বিশ্বভারতী।বাংলার চিত্র, বাংলার নৃত্য, বাংলার ধুতি আর বাংলার গীতি। বাংলার রীতি আর বাংলার প্রীতিই ছড়াতে চেয়েছে বিশ্বভারতী। নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে যোগ নয় , নিজের মূল ছেড়ে আকাশে ওঠা নয় বরং নিজের মধ্যে যা বিশ্বজনীন তাই দিতে চেয়েছে বিশ্বভারতী আর বিশ্বভারতীর রূপকার।
কিন্তু, চীন-রাশিয়ার বিপ্লবের মন্ত্র দিয়ে বাঙালির মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস হয়েছে। শ্রেণী সংগ্রামের শব্দদূষণ বিবেকানন্দ-চৈতন্যের সাম্যের বাণী শুনতে দেয়নি।
পশ্চিমবঙ্গে চার দশক যে মতাদর্শের চাষ হয়েছে তার জন্য ‘আন্তর্জাতিক বাঙালি’র হুজুগটা যে একটু বেশি হবে তা স্বাভাবিক।
কিন্তু, বিশ্বের মধ্যে ব্যতিক্রম ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ওপরেই সমস্ত কিছু দাঁড়িয়ে আর তার পেছনের সামাজিক বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান আধুনিক বিজ্ঞান ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আর মার্ক্সবাদীদের দ্বারা প্রচারিত তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র ব্যতিক্রম হিসেবে ভারতীয় সংস্কৃতি আরো সুস্পষ্টরূপে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করবে যত ঔপ্যনিবেশিক দাসত্বকে আমরা উপলব্ধি করে এর থেকে মুক্ত হতে আটমাস পরেও ‘নববর্ষের পণ’ মনে রাখবো।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.