প্রথম সাক্ষাৎ (১৮৮৪ সালের ৬ ই ডিসেম্বর)-এর পর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হবার সুযোগ থাকলেও হয় নি, কারণ তারপর শ্রীরামকৃষ্ণ দেড় বছরের মধ্যে ‘মহাসমাধি’ লাভ করেন (১৬ ই আগস্ট, ১৮৮৬)। তবে বঙ্কিমের ইচ্ছে ছিল, শ্রীরামকৃষ্ণকে নিজের বাড়িতে আনার। প্রথম সাক্ষাৎ -এর পর বেরিয়ে আসার পূর্ব মুহূর্তে (শোভাবাজারে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধর সেনের বাড়ি থেকে) তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে নিজের কুটিরে একবার পায়ের ধুলো দেবার নিমন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু আর দেখা হয় নি। তবে পরস্পর সম্পর্কে আগ্রহ বজায় ছিল, তার প্রমাণ হল —
১. বঙ্কিমের সঙ্গে দেখা হবার পরে পরেই তিনি বঙ্কিম লিখিত ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে বর্ণিত গীতার নিষ্কাম কর্ম সম্পর্কে নির্বাচিত অংশের পাঠ শুনেছিলেন (১৮৮৪ সালের২৭ শে ডিসেম্বর)।
২. শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশায় তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ গিরিশ ঘোষ ও মাস্টারমশাই (শ্রীম)-এর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং তাদের সঙ্গে বসে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে আলোচনাও করেছেন।
অর্থাৎ, বিষয়টি এমন নয়, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করার পর তাকে একেবারেই ভুলে গেলেন তিনি। আর ভোলার কথাও তো নয়! বঙ্কিম তখন সাহিত্য সৃজণের তৃতীয় তথা অন্তিম পর্বে হিন্দু সমন্বয় ভাবনার প্রচারে মগ্ন হয়েছেন; ইতোমধ্যে লেখা শুরু করেছেন ‘কৃষ্ণচরিত্র’। আর তারপরেই লিখবেন ‘ধর্মতত্ত্ব’।
বঙ্কিম ও শ্রীরামকৃষ্ণের হিন্দুত্বে কোনো সংঘাত ছিল না, নির্ভরতা ছিল আলাদা; বঙ্কিমের যুক্তিনির্ভর হিন্দুত্ব আর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তিনির্ভরতা।
তাঁদের দু’জনের সাক্ষাত না হবার অন্যতম কারণ প্রথম সাক্ষাৎকারের মধ্যেই তো নিহিত আছে!
বঙ্কিমকে জিজ্ঞাসা করছেন, তিনি বাঁকা কেন?
বঙ্কিম রসিকতা করে বলছেন, “আর মহাশয়! জুতোর চোটে, সাহেবের জুতোর চোটে।”
ব্রিটিশের গুডবুকে ছিলেন না বঙ্কিম, বারে বারে তাঁকে বদলী করা হত, আর বাচিক সংঘাত ঘটত সাহেব আধিকারিকদের সঙ্গে। অর্থাৎ কাজের চাপ ছিল, তাঁর কর্মস্থলও কলকাতা ছিল না যে যখন তখন দৌড়ে তাঁর কাছে আসতে পারবেন। তার উপর লেখালেখির পাশাপাশি (এই সময় তিনি প্রকাশ করেছেন ঈশ্বর গুপ্তের জীবনচরিত, পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছেন ‘কৃষ্ণচরিত্র’, শুরু করেছেন শ্রীমদ্ভাগবত গীতার বাংলা টীকা লেখা) এই দেড় বছর সময়কালের মধ্যে অপর একটি নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বঙ্কিম, তা হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হওয়া (১৮৯৫ সালে)। তার জন্য সময় বরাদ্দ তাঁকে করতে হয়েছে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে এই সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। যদিও বঙ্কিম তাতে সচেতনভাবে সামিল হন নি, কিন্তু রাজনৈতিক সমস্ত খবর রাখতেন তিনি। তাছাড়া বঙ্কিম সম্ভবত ভাবতেও পারেন নি এত অল্প সময়ের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের নশ্বর শরীর চলে যাবে।
তবে এটা ঘটনা যে গ্রাম্য সরল-সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমের বক্তব্যের মধ্যের রসিকতা বুঝতে পারেন নি, যদিও তিনি নিজেও বহুসময় রসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা বলতেন। আর অধর সেন, মাস্টারমশাই ও সেদিন উপস্থিত অন্যান্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটরা সম্ভবত বঙ্কিমের রচনা সম্পর্কে সঠিকভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গেছে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ এবং দেবী চৌধুরাণী উপন্যাস, নইলে যে কথোপকথন বঙ্কিম বনাম শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে ঘটেছিল, তাতে যে সূক্ষ্ম রসবোধ যোগ করেছিলেন বঙ্কিম, তা শ্রীরামকৃষ্ণ সকাশে প্রকাশে অক্ষম ছিলেন উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা সম্মিলিতভাবে শ্রীরামকৃষ্ণকে বুঝিয়ে দিতে অক্ষম হয়েছিলেন বঙ্কিমের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
কল্যাণ চক্রবর্তী।