এ বার বিচারের দাবিতে সরব হলেন আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে মৃত যুবকের মা কবিতা দাস। অভিযোগ, হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে ২২ বছরের বিক্রম ভট্টাচার্যের। বিক্রমের মা জানালেন, চিকিৎসকের মৃত্যুর বিচার তিনিও চান। কিন্তু তাঁর একমাত্র পুত্র যে ভাবে কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছেন, তার বিচার কে করবেন? কবিতার প্রশ্ন, তবে কি চিকিৎসকেরা সাধারণ মানুষের উপর ‘প্রতিশোধ’ নিচ্ছেন?
কোন্নগরের যুবক বিক্রম লরি দুর্ঘটনার মুখে পড়েন। গুরুতর জখম হয় তাঁর পা। প্রথমে তাঁকে শ্রীরামপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে তাঁকে রেফার করা হয়। কবিতার অভিযোগ, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে জরুরি বিভাগ এবং আউটডোরের মধ্যে শুধু দৌড়ে বেরিয়েছেন চিকিৎসার জন্য। কোথাও কোনও চিকিৎসক ছিলেন না। কবিতার কথায়, ‘‘কোনও চিকিৎসক আসেননি। এক জন গুরুতর আহত রোগীকে কোনও পরিষেবা দিতে পারেনি হাসপাতাল। একটা ডাক্তার নেই। আমার ছেলেটা চোখের সামনে চিকিৎসা না পেয়ে তড়পে তড়পে মরেছে। শেষে হার্ট ফেল করল।’’ এর পরেই বিচার চেয়েছেন কবিতা। তিনি বলেন, ‘‘এই ডাক্তারদের বিচার কে করবে? আমার ছেলেটা এত যন্ত্রণা পেয়ে মরল।’’ তবে কবিতা জানিয়েছেন, তিনিও এক জন মা। তিনিও চান আরজি করের চিকিৎসক বিচার পান। কিন্তু তা বলে পরিষেবা কেন বন্ধ থাকবে, সেই প্রশ্নই তুললেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা কি চাই না একটা মেয়ের বিচার হোক? একটা মেয়ের যে ভাবে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে, আমরা কি চাই না, তার বিচার হোক? আমরাও তো মা। কিন্তু আজ আমার সন্তান চলে গেল বিনা চিকিৎসায়। ডাক্তারদের বিচার চাইছি। কেন পরিষেবা দিচ্ছে না? ওরা কি প্রতিশোধ নিচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর?’’
শুক্রবার আরজি কর হাসপাতালে আহত ছেলেকে নিয়ে গিয়ে কী পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে, তা-ও জানিয়েছেন কবিতা এবং তাঁর মা ভারতী মালাকার। এক বার জরুরি বিভাগ, এক বার আউটডোরে দৌড়েছেন তাঁরা। কবিতার কথায়, ‘‘আমরা করিডিয়াম বিল্ডিংয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, চিকিৎসক রয়েছেন কি না। এক ম্যাডাম বললেন, নেই। এর পর আউটডোরে নিয়ে গেলাম। টিকিট করলাম। সেখানে চেম্বারের দরজা ধাক্কা দিলাম। এক জন ম্যাডাম বেরিয়ে এসে বললেন, ডাক্তার নেই। অপেক্ষা করুন। ছেলের পা দিয়ে তখন রক্তপাত হচ্ছে।’’ মৃতের মায়ের অভিযোগ, সে সব দেখার পরেও দীর্ঘ ক্ষণ কোনও চিকিৎসক আসেননি। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা পর আউটডোরে ডাক্তার এলেন। নির্দেশ দিলেন, সেলাই করো, ব্যান্ডেজ করো। তার পর আবার জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। চিকিৎসক পায়ে ব্যান্ডেজ করেন। তার পর আবার আউটডোরের বিল্ডিংয়ে চিকিৎসককে সই করাতে যাই। কেউ নেই। এক বার ইমার্জেন্সি, এক বার আউটডোরে দৌড়ে বেড়িয়েছি। এ দিকে ছেলের রক্তপাত হয়েই চলেছে।’’
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবি, শুক্রবার সকাল ৯টা-১০টা নাগাদ ওই যুবককে ভর্তি করানো হয়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পাশাপাশি পায়ের এক্স-রে, মাথার সিটি স্ক্যান করা হয়। চিকিৎসায় বিক্রম সে ভাবে সাড়া দিচ্ছিলেন না। যদিও বিক্রমের মা দাবি করেছেন, তাঁর ছেলের সিটি স্ক্যান করানো হয়নি। এক্স-রে করাতে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনই অসাড় হয়ে আসছিলেন তিনি। কবিতার কথায়, ‘‘ব্যান্ডেজ করার পরেও রক্তপাত বন্ধ হয়নি। এক্স-রে রুমে নিয়ে গেলাম। দেখলাম নিঃশ্বাস নিচ্ছে। একটু চোখ সরালাম। দেখলাম আর নেই।’’ আর এ জন্য তিনি হাসপাতালের পরিষেবার দিকেই আঙুল তুলেছেন। কবিতা বলেন, ‘‘ছেলেটার শরীর সাদা হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার নেই। ডাকছি, কেউ আসছেন না। কোনও ডাক্তার আসেননি। যাঁরা আন্দোলন করছিলেন, কেউ আসেননি। চোখের সামনে চলে গেল ছেলেটা। ওর কী দোষ? এত কষ্ট পেল। ওর যন্ত্রণা আমার হচ্ছে। অনেক সময় দিয়েছে ছেলেটা, কিন্তু কোনও পরিষেবা ছিল না।’’ যুবকের দিদা বলেন, ‘‘ঘরে মিটিং হচ্ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কেউ রোগী দেখলেন না। এক জন নার্স এসে উল্টে আমাকে মুখ করলেন। এক জনের জন্য হাজার মায়ের কোল খালি হোক, চাইব না। এটা বিচার নয়। ডাক্তার চিকিৎসা না করলে কোথায় যাব? আমাদের তো টাকা নেই। আমরাও বিচার চাই।’’
কোন্নগর পুরসভার চেয়ারম্যান স্বপন দাস বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য পরিষেবা বন্ধ হলে কী করে চলবে? সাধারণ মানুষ কোথায় যাবেন? দাবি নিয়ে বক্তব্য নেই। আপনারা আন্দোলন করুন, কিন্তু মানুষের জীবন চলে গেলে কাকে নিয়ে আন্দোলন করবেন?’’ এই নিয়ে শুক্রবার সরব হয়েছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি আন্দোলনকারীদের আবারও কাজে ফেরার আহ্বান জানান। তাঁর কথায়, ‘‘জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ন্যায্য। তবে তাঁদের এমন ভাবে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানাই, যাতে পরিষেবা ব্যাহত না হয়।’’