উৎসব ছাড়া পুজো হয় নাকি! এমন প্রশ্ন উঠেছে আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে এসে যাওয়া দুর্গাপুজো নিয়ে। অনেক অবশ্য দাবি করছেন, পুজো হবে পুজোর মতো। শোকের আবহে কোনও উৎসবের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সে-ও কি সম্ভব? এমন প্রশ্নের উত্তর চার দশক আগেই দিয়েছে এই রাজ্য। হুগলির চন্দননগর দেখিয়েছিল উৎসব ছাড়াও পুজো হতে পারে।
আরজি কর-কাণ্ডের জেরে যে রাজ্যে দ্রোহের পরিবেশ, তাতে এই বিতর্কের জন্ম হয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্যের পরে। গত সোমবার নবান্নে প্রশাসনিক পর্যালোচনা বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচারে মমতা বলেন, ‘‘এক মাস তো হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করব, পুজোয় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ‘আহ্বানের সুর’ থাকলেও অনেকেই এর মধ্যে আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়ার রাজনীতি দেখেছেন। তাঁদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন রাজ্যের মানুষ উৎসবে মেতে উঠলে টানা চলতে থাকা জনগণের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। আবার উল্টো মতামতও রয়েছে। তাঁরা বলছেন, বাংলায় দুর্গাপুজোই সবচেয়ে বড় বাজার। সেই উৎসবের মরসুমে দ্রোহের পরিবেশ বজায় থাকলে মার খাবে রাজ্যের অর্থনীতি। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শপিং মল থেকে ফুটপাথের ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
উৎসব তো নয়ই, এই সময়ে পুজো করাও উচিত নয় বলে অনেকে দাবি করেছেন। যদিও সেই দাবির সমর্থন নেই বাংলার কোনও পুজো উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকেই। রাজ্য সরকারের দেওয়া ‘দুর্গার ভান্ডার’ অনুদান নেওয়া হবে কি হবে না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পুজো করার অভিমত সকলেরই। তবে উৎসব পালনে যে বড় সংখ্যার মানুষের মত নেই, তা স্পষ্ট বিভিন্ন সমাজমাধ্যমের পোস্টে। তবে অনেকের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী পুজো এবং উৎসবকে আলাদা করেছেন সামাজিক কারণেই। পুজো ‘ধর্মীয়’ কিন্তু উৎসব ‘সর্বজনীন’ বার্তা দিতেই তিনি স্লোগান তৈরি করেছিলেন, ‘‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’’ এই বিষয়ে একটি পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘‘রেড রোডে ইদে নমাজ পড়ার রেওয়াজ বাম আমল থেকে। আর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সেই রাস্তায় দুর্গাপুজোর কার্নিভ্যাল নিয়ে এসে সমতা এনেছেন। কেউ বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে বলে অভিযোগ করা যাবে না। এখন শহরে যে ভাবে বড়দিনে সর্বজনীন উৎসব হয় সেটাও অতীতে ছিল না।’’ ওই পোস্টে অবশ্য সরকারি বদান্যতায় এই সব করা উচিত কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন। আর নানা প্রশ্নে সমাজমাধ্যমে জোর চর্চা চলছে পুজো আর উৎসব নিয়ে।
এই পরিস্থিতিতে চন্দননগরবাসী স্মরণ করছেন চার দশক আগের ঘটনা। জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য বিখ্যাত যে শহর ‘আলোর নগরী’ হিসাবেও খ্যাত। সেই শহরই এক বার শোকের আবহে প্রায় নিষ্প্রদীপ পুজো পালন করেছিল। চন্দননগরে বরাবরই চার দিনের পুজো হয়। সপ্তমীতে শুরু এবং দশমীতে শেষ। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ছিল সপ্তমী। সেই সকালেই দিল্লিতে দেহরক্ষীদের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মৃত্যু হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। সপ্তমীর সকালে সেই খবর পাওয়ার পরেই চন্দননগরের কেন্দ্রীয় জগদ্ধাত্রী পুজো কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, পুজো হলেও উৎসব হবে না। এ নিয়ে চন্দননগরের বাসিন্দা বাবু পাল বলেন, ‘‘সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছিল সরকারি ভাবে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার আগেই। সব পুজো প্যান্ডেলে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু ঢাক, কাঁসরেই হয় পুজো। অষ্টমী, নবমীর পুজোও হয় একই ভাবে। সন্ধ্যায় আলোর সাজ ছিল না তিন দিনই। মণ্ডপে শুধুই হ্যালোজেনের আলো। শহরের সবাই মেনে নিয়েছিলেন। সব বারোয়ারি মিলে শোকমিছিলেও বের হয়েছিল।’’ জগদ্ধাত্রী পুজোর দশমীতে চন্দননগরের শোভাযাত্রার খ্যাতি রয়েছে রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। কিন্তু ইন্দিরা নিধনের ১৯৮৪ সালে শোভাযাত্রা ছাড়াই হয়েছিল নিরঞ্জন পর্ব। বাবু আরও বলেন, ‘‘সে বার এই শহরের বিখ্যাত পুজো বাগবাজার সর্বজনীনের ১৫০ বছর ছিল। প্রভাত ফেরিতেই উৎসব শেষ করে তারা। বাকিটা ছিল শুধুই ধর্মীয় রীতি মেনে পুজো।’’
সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে চন্দননগর শহর নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করা অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে গোটা ভারত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর চন্দননগর সঙ্গে সঙ্গেই আলোর সাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় নিষ্প্রদীপ ছিল প্রতিটি মণ্ডপ। সেই শোকের আবহে সাধারণ মানুষ ঠাকুর দেখতে বার হননি সে ভাবে। যাঁরা বার হন তাঁরাও উৎসবে নয়, পুজোয় যোগ দিয়েছিলেন শুধু রীতি মানার তাগিদে।’’ তিনি জানান, এতটা না হলেও ১৯৭৮ সালে বাংলায় বন্যা হওয়াতেও চন্দননগরের অনেক জগদ্ধাত্রী পুজো শোভাযাত্রা-সহ নানা বাহুল্য বাদ দিয়ে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের হাতে ত্রাণের অর্থ তুলে দেয়। বিশ্বনাথ বলেন, ‘‘শোক পালন করা বাঙালীর রীতি। চন্দননগরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এমন নজির আগেও দেখানো হয়েছে। ১৯৩০ সালে পুজোর আগে আগে গোন্দলপাড়ায় ব্রিটিশ পুলিশের কমিশনার চার্লস টেগার্টের গুলিতে মৃত্যু হয় বিপ্লবী মাখনলাল ঘোষালের। সে বার দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী পুজোয় প্রতিটি মণ্ডপেই প্রতিমার সঙ্গে ছিল মাখনলালের ছবি।’’ তিনি জানান, আরও একটা শোকপালনের নজির দেখিয়েছে চন্দননগর ১৯০৮ সালের ১০ নভেম্বর। বিশ্বনাথ বলেন, ‘‘চন্দননগরের সন্তান বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের ফাঁসির দিন অরন্ধন পালন করেছিল গোটা শহর।’’