সন্ধ্যা গড়ালেই খাঁ খাঁ হাসপাতাল চত্বর। অভিযোগ, বড় কোনও ঘটনা ছাড়া কার্যত অদৃশ্য পুলিশও। হাসপাতাল চত্বরই যেন বি টি রোড থেকে পাশের এলাকায় বাইক-বাহিনীর যাতায়াতের ‘মুক্তাঞ্চল’। বিনা নজরদারিতে এটাই ছিল কামারহাটি সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের রোজনামচা।
জুনিয়র ডাক্তারদের অভিযোগ, বার বার বলেও কিছু হয়নি। বি টি রোডের উপরে মূল গেট থেকে ঢুকে সামনেই বিরাট জলাশয়। তার উল্টো দিকে হাসপাতাল ভবন। সেখানে ঢুকতে জলাশয়ের সামনের অন্ধকার রাস্তা দিয়েই যেতে হয়। আবাসিক চিকিৎসকদের অভিযোগ, রাতে ওই গা-ছমছমে পরিবেশেই হস্টেলে ফিরতে হয়। একই অভিজ্ঞতা রোগীর আত্মীয়দের। আরও অভিযোগ, দুপুর ২টোয় বহির্বিভাগ শেষ হতেই কার্যত উধাও হন নিরাপত্তারক্ষীরাও। জরুরি বিভাগে কে ঢুকছেন, কত জন ঢুকছেন দেখার কেউ থাকে না। ওয়ার্ডে রোগীর বাড়ির এক দল লোক ঢুকলেও আটকানোর কেউ নেই। রোগীদের বড় অংশ স্থানীয় বাসিন্দা। এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এই হাসপাতালে কথায় কথায় ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপরে চড়াও হওয়াটাই অনেক দিনের রেওয়াজ।’’ জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি, শুক্রবার সেটাই ঘটে। তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়, ‘‘আর জি কর করে দেব!’’
রাজ্য জুড়ে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন করছে ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট। রাজ্য কিছু নির্দেশিকা জারি করলেও তা এখনও সর্বত্র পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। সাগর দত্তের ওই ঘটনা তারই প্রমাণ বলে দাবি জুনিয়র চিকিৎসকদের। প্রতিবাদে শুক্রবার থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতিতে তাঁরা। সেই চাপে রবিবার থেকে মেডিক্যাল কলেজটিতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে। জরুরি বিভাগের সামনে রয়েছে পুলিশ। দরজার সামনে র্যাফের দুই মহিলা কর্মী-সহ মোট চার জন পুলিশকর্মীকে পাহারায় রাখা হয়েছে। রোগীর সঙ্গে সর্বাধিক দু’জনকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসাধীন রোগীর ক্ষেত্রে ভিজ়িটিং আওয়ার্সে নির্দিষ্ট কার্ড পরীক্ষা করে এক জনকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। অন্য বিভাগের সামনেও রয়েছে পুলিশ। হাসপাতাল চত্বরের ফাঁড়িতে শনিবার থেকেই পুলিশকর্মী বাড়ানো হয়েছে। হাসপাতাল চত্বর জুড়ে এখন পর পর পুলিশের গাড়ির টহল।
হাসপাতাল সূত্রেও জানা গিয়েছে, সেখানে এখন ১৩৫ জন বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন। আরও ৫৭ জন বাড়ানো হচ্ছে। সে বিষয়ে স্বাস্থ্য দফতরও অনুমতি দিয়েছে বলে খবর। শুরু হয়েছে সিসি ক্যামেরা লাগানোর কাজ। সাগর দত্তের আবাসিক চিকিৎসক সংগঠনের সভাপতি মনোজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “সেপ্টেম্বরের গোড়াতেই নিরাপত্তা ও সুরক্ষা জোরদার করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিছু হয়নি। শুক্রবারের ঘটনার পরে তড়িঘড়ি নিরাপত্তা বাড়ানো হচ্ছে। তা হলে কি ওই ঘটনা পরিকল্পিত? এখনও আতঙ্ক কাটেনি।” প্রশাসনের তড়িঘড়ি পদক্ষেপ লোকদেখানো কি না, সেই প্রশ্ন তুলে সুরক্ষার বিষয়টি সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানান জুনিয়র চিকিৎসক কুণাল ধর।
চিকিৎসকদের আরও অভিযোগ, এই মেডিক্যাল কলেজের অরক্ষিত দশা কেন এত দিন কর্তৃপক্ষের নজরে আসেনি? রাত বাড়লেই হাসপাতালের মেন বিল্ডিংয়ের সামনের ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া ভাবে বাইক ও চারচাকার তালিম দেওয়া চলত। ওটাই হস্টেলের দিকে যাওয়ার রাস্তা। মনোজিতের কথায়, “ঢিলেঢালা নিরাপত্তার জন্য মাস কয়েক আগে ক্রিটিক্যাল কেয়ার থেকে রোগী পালিয়ে গিয়েছিল।” এ দিন অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান বলেন, “শনিবার স্বাস্থ্যসচিব, জেলাশাসক এসে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন। কাজও শুরু হয়েছে।”
সাপ্তাহিক ছুটির জন্য এ দিন বহির্বিভাগ বন্ধ ছিল। কিন্তু কর্মবিরতিতে রোগীদের অনেকেরই ভোগান্তি হয়েছে বলে অভিযোগ। পায়ে সংক্রমণ নিয়ে আসা এক বৃদ্ধের ড্রেসিং হয়নি। সোমবার আসতে বলা হয়েছে। তিন দিন ভর্তি থাকা বৃদ্ধাকে পরিজন নিয়ে গিয়েছেন অন্যত্র। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার, উত্তর ২৪ পরগনার জেলা (শহর) সভাপতি তাপস মজুমদার প্রমুখ দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু ‘গো-ব্যাক’ স্লোগান দেন আন্দোলনকারীরা।