Weather Forecast Satellites: প্রযুক্তির পর্যবেক্ষণে সূক্ষ্ম পূর্বাভাস, অবশেষে নিশ্চিন্ত জয় গোঁসাই

বৃষ্টি আর হঠাৎ নামে না। কখন বৃষ্টি আসবে, কবে আসবে, তা আগে থেকেই জানা যায়।

বছর ছ’-সাত আগেও আবহাওয়ার পূর্বাভাস ঠাট্টার বিষয় ছিল। যেমন ১৯৯৯ সালে অষ্টমীর দিন ‘সুপার সাইক্লোন’ আসবে বলে খবর রটে গিয়েছিল। তাতে পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে খুব ক্ষতির আশঙ্কার কথাও জানানো হয় আবহাওয়া দফতর থেকে। সেই প্রথম ‘সুপার সাইক্লোন’ কথাটির সঙ্গে পরিচয় এ রাজ্যের জনতার। তখনও আয়লা, আমপান, ফণি, গুলাব আসেনি। সে সময়ে কড়া সতর্কবার্তাও জারি হয়। কিন্তু ঝড় এ রাজ্যে আসেনি। ঘুরে চলে যায় ওড়িশায়।

এর পরেও বার বার হয়েছে এমন। এক বার ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্কেত আসে। আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে। সালটা ২০০৭ সাল। ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এর কথা বলা হচ্ছে। সে বার যথেষ্ট ক্ষতি হয় সেই দেশে। কিন্তু কলকাতার মানুষজনের মধ্যে হাওয়া দফতরের ঝড়ের সঙ্কেত হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। এক সময়ে বাঙালি বলত, আবহাওয়া দফতর কলকাতায় ঝড় হবে বললেই ধরে নিতে হবে তা বাংলাদেশ কিংবা নিদেন পক্ষে ওড়িশায় যাবে।

এ ধারণার ইতিহাস আরও পুরনো। ১৯৩৭ সালে যখন দুর্যোগে বদলে গেল ক্রিক খালের কপাল, সে সময়ের কথা ধরা যাক। একটি ঝড়ে যে এত কিছু হতে পারে, সে সঙ্কেত আবহাওয়া দফতর থেকে আসেনি। সারা দিন ঝিরঝিরে বৃষ্টির পর হঠাৎ সন্ধ্যায় ঝড় ওঠে। তার পর মুষলধারে বৃষ্টি। মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় গঙ্গার জল বেড়েছিল ১৫ ইঞ্চি। সেই ঝড়ে ক্রিকে ভাসা বহু বড় বড় বজরা, নৌকো ডুবে যায়। তার পরেই ঠিক হয়, সেই ক্রিক বুজিয়ে দেওয়া হবে। তৈরি হল রাস্তা।

কিন্তু আর নয়।

এক সময়ে একেবারেই পাত্তা পানননি ‘দ্য হর্ন-বুক ফর দ্য ল অব স্টর্মস ফর দ্য ইন্ডিয়ান অ্যান্ড চায়না সি’-র লেখক হেনরি পিডিংটন। তাঁর গণনাকে ভরসা করা হলে শুধু ক্রিক রো কেন, এ বঙ্গে অনেক দুর্যোগই আটকানো যেত বলে মত আবহাওয়াবিদদের।
এক সময়ে একেবারেই পাত্তা পানননি ‘দ্য হর্ন-বুক ফর দ্য ল অব স্টর্মস ফর দ্য ইন্ডিয়ান অ্যান্ড চায়না সি’-র লেখক হেনরি পিডিংটন। তাঁর গণনাকে ভরসা করা হলে শুধু ক্রিক রো কেন, এ বঙ্গে অনেক দুর্যোগই আটকানো যেত বলে মত আবহাওয়াবিদদের।

২০২০ সালের আমপানের কথায় ফেরা যাক। ঘূর্ণিঝড় আসার ঠিক পাঁচ দিন আগে সঙ্কেত মেলে। প্রায় কাঁটায় কাঁটায় মিলে যায় পূর্বাভাস। ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। কিন্তু কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। প্রাণনাশ আটকানো গিয়েছিল। আমপান হোক বা গুলাব— কিছুটা প্রস্তুতি ঝড় আসার আগে থেকেই এখন নেওয়া যায়।

কী ভাবে এমন হচ্ছে? কোন প্রযুক্তির উন্নতি পূর্বাভাস ঠিক করার সুবিধা জোগাচ্ছে?

এক সময়ে যেমন একেবারেই পাত্তা পানননি ‘দ্য হর্ন-বুক ফর দ্য ল অব স্টর্মস ফর দ্য ইন্ডিয়ান অ্যান্ড চায়না সি’-র লেখক হেনরি পিডিংটন। তাঁর গণনাকে ভরসা করা হলে শুধু ক্রিক রো কেন, এ বঙ্গে অনেক দুর্যোগই আটকানো যেত বলে মত আবহাওয়াবিদদের। কিন্তু এখন আর শুধু গণনা-নির্ভর নয় হাওয়া অফিসের কাজ। প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। নানা ধরনের উপগ্রহ (স্যাটেলাইট) সাহায্য করছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের আবহাওয়ার খবর আনতে। প্রায় প্রতি দেশে জাতীয় উপগ্রহ বসানো হয়েছে। এই সব উপগ্রহ পৃথিবীর চার ধারে যেমন ঘুরপাক খায়, তেমনই কিছু আবার হয় ‘জিয়ো স্টেশনারি’। সেগুলি ভূমিতে বসেই নজরদারি চালায় নানা জিনিসের উপর। ‘রিমোট সেন্সিং’ যত উন্নত হচ্ছে, তত নিখুঁত তথ্য মিলছে এ সব উপগ্রহ থেকে। আকাশের ছবি তুলছে, সমুদ্রের নীচের ছবিও তুলে আনছে। কম্পন বুঝে বলে দিচ্ছে বিপদ আসছে কি না। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কাজে যুক্ত উপগ্রহ যেমন খবর পাঠায় কোথায় কবে ঝড় আসতে পারে, তেমনই জানান দেয় তাপমাত্রা ওঠা-নামার কথাও। এখন সে সবের উপর নির্ভর করে নানা ধরনের কাজ করা হয়।

বহু দিন ধরেই ধীরে ধীরে যন্ত্রনির্ভর হচ্ছে বিভিন্ন কাজকর্ম। প্রযুক্তি যেমন বহু ক্ষেত্রে মানুষের খাটুনি কমাচ্ছে, তেমনই করছে আবহাওয়ার উপগ্রহও। গত পাঁচ দশকে ‘রিমোট সেন্সিং’ ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে পর্যবেক্ষণের ধারণা। এমনই দাবি করা হয়েছে ২০২১ সালে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন রিমোট সেন্সিং’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে। সেখানে গবেষকদের বক্তব্য, এ সময়ে রিমোট সেন্সিং আরও উন্নত। সবচেয়ে বেশি তা ব্যবহৃত হচ্ছে আবহাওয়া এবং অরণ্যের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে। আর কাজে লাগছে বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়।

আবহাওয়ার ক্ষেত্রে ধরা যাক সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপের কথা। এ মাসের শুরুতেই খবর এসেছে যে, ছ’টি নতুন উপগ্রহ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকার ‘নাসা’। তার মধ্যে দু’টি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস সূক্ষ্ম ভাবে ধরতে পারবে বলে দাবি সে দেশের বিজ্ঞানীদের। অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চলে আমপানের মতো অন্য কোনও বড় ঘূর্ণিঝড় এলে তা আরও আগে থেকে জানা যাবে। সতর্ক তো হওয়া যাবেই, সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমানো যাবে।

তবে আমেরিকায় আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনেক দিন ধরেই প্রায় নিখুঁত। সে দেশের উপগ্রহের তথ্য কি এ দেশের সাধারণের রোজের জীবনে উন্নতি ঘটায়? নাকি এখানেও এখন তেমন ব্যবস্থাই হয়েছে? আমেরিকা কি সে সব তথ্যের জোগান দেয়?

‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন’ (ইসরো)-র নিজস্ব কিছু উপগ্রহ রয়েছে। তা অবশ্য আজ থেকে নয়। বেশ কিছু দিন ধরেই কাজ করছে ইনস্যাট, ওশনস্যাটের মতো উপগ্রহ। সে সব উপগ্রহের উপরেই কি নির্ভর করছে সব?

পশ্চিমবঙ্গে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলের প্রধান সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে এ দেশে হাওয়া দফতরের সব প্রযুক্তিই। তার সঙ্গে গণিতও এগিয়েছে। ফলে যে গণনার মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যায়, তা-ও আগের চেয়ে ভাল হচ্ছে। তার সঙ্গেই সঞ্জীববাবুর বক্তব্য, ‘‘এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভাল। আগে আবহাওয়ার খবর পাওয়ার জন্য সংবাদমাধ্যমের উপর নির্ভর করতে হত। কিন্তু এখন তো তা নয়। ইন্টারনেটের যুগে সবটাই নিজের মতো করে জেনে নেওয়া যায়। আর আবহাওয়া দফতরের কর্মীদের মধ্যেও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। তাই এখন সব অঞ্চলের খবর আমরা দ্রুত পাই। সার্বিক প্রযুক্তির উন্নতির কারণে তা সকলকে জানিয়েও দেওয়া যায় দ্রুত।’’

উন্নত উপগ্রহ ব্যবস্থা কি তবে উন্নততর পূর্বাভাসের কারণ নয়? সঞ্জীববাবু বলেন, ‘‘উপগ্রহ আবহাওয়ার খবর দেয়। কিন্তু তা আগে থেকে বলতে পারে না। এখন আকাশে মেঘ আছে কি নেই, এ ধরনের খবর পাওয়া যায়। পাঁচ মিনিট পর সেই মেঘ কোন দিকে যেতে পারে, সে তথ্যও মেলে। কিন্তু পর দিন আকাশে মেঘ কতটা থাকবে, তার জন্য গণনাই বেশি জরুরি। এখন সে গণনার পদ্ধতি আরও উন্নত হয়েছে। এবং আমাদের দফতরের নানা বিভাগের মধ্যে তথ্য পাঠানোর প্রযুক্তি অনেক দ্রুত হয়েছে।’’


তবে তাঁর বক্তব্য, উপগ্রহ এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতেই পূর্বাভাস আগের চেয়ে ভাল করা সম্ভব হচ্ছে।

এ বিষয়ে অবশ্য পুরোপুরি একমত নন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণায় যুক্ত শহরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধিকর্তা দীপায়ন দে। তাঁর বক্তব্য, গোটা পৃথিবীতেই এখন আবহাওয়ার খবর সম্পূর্ণ ভাবে উপগ্রহ-নির্ভর। এ দেশের উপগ্রহ ব্যবস্থা এখন অনেকটাই উন্নত বলে মত দীপায়নের। তিনি বলেন, ‘‘রিমোট সেন্সিং এখন অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ব্যবস্থা। এই দেশের উপগ্রহ যথেষ্ট সূক্ষ্ম ভাবেই খবর জোগাড় করে।’’ তবে আমেরিকা কিংবা বিলেতের উপগ্রহ আরও বেশি উন্নত। আর উন্নত হল চিন, জাপানের উপগ্রহ। দীপায়নের বক্তব্য, ‘‘সে সব দেশের উপগ্রহের তথ্য যদি পাওয়া যেত, তবে আরও সূক্ষ্ম ভাবে মিলত এ দেশের আবহওয়ার রিপোর্ট। কিন্তু আমেরিকার ‘ন্যাভস্টার’ উপগ্রহের কিছু তথ্য জানতে হলে যতটা অর্থ ব্যয় করতে হয়, তা দেশের পক্ষে সব সময়ে সম্ভব নয়।’’

এখন তাই মূলত নিজেদের দেশের উপগ্রহের তথ্যের উপরেই নির্ভর করে চলছে পূর্বাভাসের ব্যবস্থা। ‘ইনস্যাট’ বা ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল স্যাটেলাইট সিস্টেম’ মূলত এ দেশের আবহাওয়ার খবর দেয়। তা যত উন্নত হবে, তত বেশি তাড়াতাড়ি মিলবে আবহাওয়ার খবর। এমনই মত দীপায়নের। আর তার উন্নতিতে নিয়মিত কাজ চলছে বলে জানা যাচ্ছে ইসরো-র বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে। ২০১৫ সালে যে বন্যার পূর্বাভাস ঠিক ভাবে করতে পারেনি ইসরো, ২০১৮ সালে তেমনই ধরনের বন্যার জন্য তারা প্রশাসনকে আগে থেকে প্রস্তুত করতে পেরেছে বলে দাবি সেখানকার কর্তাদের।

কিন্তু এই অঞ্চলের যে সব আবহাওয়া সংক্রান্ত খবর পাচ্ছে বিদেশি উপগ্রহ, সে সব তথ্য কাজে লাগে না দেশের? সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে নতুন উপগ্রহ কেন বসাল ‘নাসা’? আবহাওয়া নিয়ে গবেষণায় মগ্নদের বক্তব্য, মূলত নিজেদের কিছু কাজেই সারা বিশ্বে উপগ্রহ বসিয়েছে আমেরিকা। তবে কঠিন সমস্যার সঙ্কেত পেলে যে কখনওই সে খবর আদানপ্রদান হয় না, তা নয়। দীপায়নের উত্তর, ‘‘সে সব তথ্য মূলত কিনেই নিতে হয়। যা আমাদের দেশ সব সময়ে কেনে না।’’ তাই যেমন এ দেশে এখনও সুনামির সঙ্কেত সহজে ধরা যায় না বলে বক্তব্য দীপায়নের।

তবে সুনামির সঙ্কেত মেলে কী ভাবে?

তা মেলা সহজ নয়। সঞ্জীববাবু জানাচ্ছেন, সুনামি মূলত তৈরি হয় সামুদ্রিক কোনও অঞ্চলে ভূমিকম্পের প্রভাবে। তিনি বলেন, ‘‘ভূমিকম্প আগে থেকে ধরা পড়ে না এখনও। কিন্তু কোথাও ভূমিকম্প হলে তা কী ভাবে ছড়াতে পারে, কোন উপকূলে কী ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, তার সঙ্কেত পাওয়া যায়।’’ ফলে সুনামি আসার সতর্কবার্তা জানানো হয় তখন। কোথাও পৌঁছয় আধ ঘণ্টা আগে, কোথাও এক ঘণ্টা আগে। ভূমিকম্প শুরুর জায়গাটি থেকে সেই উপকূলের দূরত্ব কত, তার উপর বিষয়টি নির্ভর করছে। যেমন সঞ্জীববাবু বোঝান, বঙ্গোপসাগরে একটি অস্থিরতা তৈরি হলে তার প্রভাব যত তাড়াতাড়ি আন্দামানে পড়বে, ততটা দ্রুত চেন্নাইয়ে পড়বে না। তাই আন্দামানের তুলনায় চেন্নাই প্রস্তুতি নেওয়ার সময় খানিকটা বেশি পাবে।

দীপায়ন আবার জানাচ্ছেন, কিছু কিছু দেশের মধ্যে তথ্য কেনাবেচার সম্পর্ক যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে তথ্য আদানপ্রদানের বোঝাপড়াও। যার উপগ্রহে আগে ধরা পড়ে কোনও সমস্যা, তারা অন্য দেশকে জানিয়ে দেয়। অন্য দেশটিরও সে কাজই করা বাধ্যতামূলক। আপাতত ভারতের যেমন সেই সম্পর্ক রয়েছে আমেরিকার পাশাপাশি জার্মানি এবং ফ্রান্সের সঙ্গেও।

এক সময়ে জয় গোস্বামী লিখেছিলেন, ‘সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল খাতার উপর, আজীবনের লেখার উপর।’ এখন আর সে আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

লাভ আমাদের। যদিও কবিতার ক্ষতি হতেই পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.