বদলে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বেতার সম্প্রচারের ঘরানা। দীর্ঘ ৬৩ বছরের পথ চলা শেষ। আর দু’দিন বাদেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ভয়েস অব আমেরিকার (ভিওএ) বাংলা বিভাগের বেতার সম্প্রচার কার্যক্রম। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা বিভাগের বেতার সম্প্রচার আগেই বন্ধ করে দিয়েছে জার্মানির আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ডয়েচে ভেলে’। অনুষ্ঠান কাঠামোর আমূল বদল এনেছে তারা।
১৭ জুলাইয়ের পর আর বেতারে ভিওএর বাংলা সম্প্রচার শোনা যাবে না বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এই আন্তর্জাতিক সম্প্রচার মাধ্যম।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভয়েস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বেতারে শ্রোতাগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দর্শক-অনুসারীর সংখ্যা বাড়ায় তারা বাংলা এফএম ও শর্টওয়েভে বেতার সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একইসঙ্গে তারা টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা দর্শক-শ্রোতাগোষ্ঠীর জন্য নতুন অনুষ্ঠান ও প্রচার বাড়াবে।
জার্মান বেতার তরঙ্গ ‘ডয়চে ভেলে’-র বাংলা বিভাগ চালু হয় ১৯৭৫ সালে৷ নেপথ্যে মূলত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। এই প্রতিবেদক নব্বইয়ের দশকে কয়েক বছর সেখানে বাংলা বিভাগের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেসময়ে ভারত ও জার্মান সরকারের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে এই নিয়োগ হত। এশিয়ার ছ’টি দেশের রাষ্ট্রভাষার দৈনিক বেতার সম্প্রচার হত। জার্মানির কোলনে রাইন নদীর ধারে, সুদৃশ্য এক বহুতলে ছিল সংস্থার সদর কার্যালয়ে। পরবর্তীকালে ওই দফতর স্থানান্তরিত হয় বন শহরে।
দীর্ঘকাল শর্ট ওয়েভে ডয়চে ভেলের বাংলা অনুষ্ঠান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শ্রোতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল৷ ২০১০ সাল থেকে দিনে দু’টি করে অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো এফএম ব্যান্ডে বাংলাদেশ বেতারের সহযোগিতায়, যা চলে ২০১৩ সালের ৮ই মার্চ অবধি৷ ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ডয়চে ভেলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘অন্বেষণ’ বাংলা ভাষাতেও প্রচার শুরু হয়৷ বাংলাদেশে আরটিভি ও ভারতে ডিডি বাংলায়
নিয়মিত প্রচার হচ্ছে এই অনুষ্ঠান৷
ডয়চে ভেলের বরিষ্ঠ সম্পাদক সঞ্জীব বর্মন এই প্রতিবেদককে জানান, “ডয়চে ভেলে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ রেডিও বহুকাল আগেই বন্ধ হয়ে গেছে৷ যুগের দাবি মেনে এখন অনলাইন, ভিডিও, সোশাল মিডিয়াই হয়ে উঠেছে কাজের কেন্দ্রবিন্দু৷“ বাংলা বিভাগের ওয়েবসাইটে রাজনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, পরিবেশ, সমাজ, অর্থনীতি, খেলাধুলা, উচ্চশিক্ষা ও লাইফস্টাইল সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা হয়৷
বাংলাভাষী জনগণের জন্যই মূলত বাংলায় সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে ডয়েচে ভেলে ও ভয়েস অব আমেরিকার মত সম্প্রচার সংস্থা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বাংলাভাষীরা এদের মূল শ্রোতা।
ভিওএর অনুষ্ঠান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জন লিপম্যান বলেন, “১৯৫৮ সালে ভয়েস অব আমেরিকা যখন বাংলায় সম্প্রচার কার্যক্রম শুরু করে, তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হিসেবে পরিচিত ভূখণ্ডটি সামরিক শাসনের অধীনে ছিল এবং কোনও বেসরকারি টেলিভিশন বা বেতার ছিলো না সেখানে। ভিওএর স্বল্প তরঙ্গ বেতার সম্প্রচার সেখানকার বাংলাভাষী জনগণের জন্য স্বতন্ত্র উৎস থেকে সংবাদ ও তথ্য পাওয়ার একটি ‘লাইফলাইন’ হিসেবে কাজ করেছে।”
গত জুনে বিভাগীয় কর্মীদের এক সভায় ভিওএ বাংলা পরিষেবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শতরূপা বড়ুয়া বলেন, “যে সময় বেতারই ছিল সংবাদ পাওয়ার মুখ্য উৎস, সে সময় থেকেই ভিওএ বাংলা রেডিও সম্প্রচার বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা তার শ্রোতামণ্ডলীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় একটি বড় অংশজুড়ে ছিল এই বেতার সম্প্রচার, ঘরে ঘরে সুপরিচিত ছিল ভিওএ। এই পরিচিতির ধারাবাহিকতা ধরে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এখনকার দিনে শর্টওয়েভ ও মিডিয়াম ওয়েভ রেডিওর তুলনায় যেসব মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতা বেশি সক্রিয়, সেখানে উপস্থিতি আরও বাড়িয়ে তুলব আমরা।”
ডয়েচে ভেলেরও আগে বাংলা সম্প্রচার শুরু করে
ভয়েস অফ আমেরিকা (ভিওএ)। সংস্থার প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪২ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টেলিভিশন বাজারে এলেও তখন বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম বলতে সবাই বেতারকেই চিনত, বেতারই শুনত। এ খবর জানিয়ে ‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’ লিখেছে, ১৭ জুলাইয়ের পর আর বেতারে ভিওএর বাংলা সম্প্রচার শোনা যাবে না। যে সব দেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নেই বা জনগণ সীমিত সংবাদ পায়, তাদের কাছে ভিওএ ৪০টিরও বেশি ভাষায় খবর প্রচার করে বলে এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।
বেতার সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ, বাংলা সামাজিক মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বর্তমানে ভিওএর শর্টওয়েভ সার্ভিসের শ্রোতা এক শতাংশেরও কম, অথচ বেড়েছে সামাজিক মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতা।
গত বছর ভিওএর বাংলা টুইটার অ্যাকাউন্টে ব্যবহারকারীদের সংযোগ বেড়েছে ৫৪ শতাংশ, আর একই সময়ে ইনস্টাগ্রামে ভিডিওর দর্শক বেড়েছে ২৭৪ শতাংশ।
সম্প্রচারের শেষ দিনগুলোতে ভিওএর বাংলা সার্ভিস অতীতের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানমালা পুনঃপ্রচার করবে এবং এর মধ্যদিয়ে ১৯৫৮ থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই বেতার সম্প্রচার কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা তুলে ধরা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
তবে এই পরিবর্তনের কারণে ‘লাইফলাইন’ নামের বেতার অনুষ্ঠানের সম্প্রচার বন্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য রোহিঙ্গা ভাষায় প্রচারিত ৩০ মিনিটের এই বেতার অনুষ্ঠান চালু থাকবে। এটি শুরু হয়েছে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে।
অশোক সেনগুপ্ত