তর্কাতিত ভাবে এই মুহূর্তে ক্রিকেট দুনিয়ার সেরা ব্যাটার। ভারতের প্রথম ১০জনের তালিকায় অনায়াসে জায়গা করে নেবেন। ১০৯ টেস্টের ১৮৫ ইনিংসে ৮৪৭৯ রান। গড় ৪৮.৭২। স্ট্রাইক রেট ৫৫.৩৪। সঙ্গে রয়েছে ২৮টি শতরান ও সম সংখ্যক অর্ধ শতরান। ২০১৫ থেকে ২০২২। অধিনায়ক বিরাট কোহলির (Virat Kohli) আমলে টিম ইন্ডিয়া (Team India) দেশে-বিদেশে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে দাপট দেখিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল বিরাট কি ব্যাটার হিসেবে আইসিসি (ICC) ইভেন্টের নক-আউট মঞ্চে, বিশেষ করে বিশ্ব টেস্ট ফাইনালে (ICC World Test Championship Final) বোলারদের উপর চড়াও হতে পারছেন? উত্তর খুব সোজা। না। পারেননি বিরাট। আইপিএল (IPL) জগতে স্বঘোষিত ‘কিং’, চাপের মুখে লাল বলের ক্রিকেটে শাসন করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। ২০২১ সালের পর এবারও অফ ফর্মের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন মহাতারকা। আর তাই তাঁকে ছাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ‘ফ্যাব ফোর’-এর বাকি তিনি স্টিভ স্মিথ (Steve Smith), জো রুট (Joe Root) ও কেন উইলিয়ামসন (Kane Williamson)।
বিরাটের নেতৃত্বে লাল বলের ক্রিকেটে উথান দেখার মতো। শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঘরে ও বিদেশে সিরিজ জয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রোটিয়াসদের বিরুদ্ধে টেস্ট জয়। ইংল্যান্ডকে তাদের ভূমিতে মাটি ধরিয়ে দেওয়া। গত কয়েক বছর ‘মেন ইন ব্লু’ ব্রিগেডের উল্লাসের ছবি বারবার ধরা পড়েছে। তাঁর নেতৃত্বে নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ব টেস্ট ফাইনালে হারলেও, বিরাটের দিকে কেউ আঙুল তোলার সাহস দেখাতে পারেননি। তবে এ বার রোহিত শর্মার নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আরও একটা বিশ্ব টেস্ট ফাইনাল হারতেই বিরাটের ব্যাটিং ফর্ম, অফ স্টাম্পের বাইরে তাঁর বছরের পর বছর ধরে দুর্বলতা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে পোস্টমর্টেম। গত বিশ্ব টেস্ট ফাইনালে কিউইদের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে বিরাটের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৩২ বলে ৪৪ ও ২৯ বলে ১৩ রান। আর এ বার তাঁর ব্যাট থেকে এল ৩১ বলে ১৪ ও ৭৮ বলে ৪৯ রান।
এবারের ফাইনালের দুই ইনিংসে তাঁর আউট হওয়ার ধরণ দেখুন। প্রথম ইনিংসে মিচেল স্টার্কের গুড লেংথ থেকে দুরন্ত একটা লাফিয়ে ওঠা ডেলিভারি ভারতীয় স্বপ্নের সমাধি করে দেয়। কাঁটার ওপর নুনের ঘায়ের মতো স্লিপে ক্যাচ ধরেন বিশ্ব ব্যাটিং হল অফ ফেমে তাঁর নিকটতম প্রতিপক্ষ স্টিভ স্মিথ। অনেকে সেই আউটের পরেও বিরাটকে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ দিয়েছিলেন। তবে সুনীল গাভাসকর সুযোগ পেয়েই উগরে দিলেন ক্ষোভ। ধারাভাষ্যকার ‘আনপ্লেয়বেল ডেলিভারি’ বলে উঠতেই গাভাসকর চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘মিথ্যা কথা বলো না! বিরাট ব্যাকফুটে খেললে এই ডেলিভারি ম্যানেজ করে নিত। কিন্তু অহেতুক ফ্রন্টফুটে চলে আসার জন্যই ও আউট হল!’ বেশ বোঝা গেল দুই বছর আগের আইপিএল চলার সময় অনুষ্কা শর্মার তরফ থেকে পাওয়া অপমান সানি এখনও হজম করতে পারেননি।
দ্বিতীয় ইনিংসেও ফের সমালোচনার মুখে পড়েন বিরাট। ৪৪৪ রান চেজ করতে গিয়ে অহেতুক আগ্রাসী শট খেলে আউট হন তিনি। দায়িত্বজ্ঞানহীন শট নিয়ে বিরাটের উপর ক্ষোভ উগরে দেন একাধিক কিংবদন্তিরা। স্কট বোল্যান্ডের ফিফত স্টাম্পে থাকা বাইরে যাওয়া ডেলিভারিতে অহেতুক ব্যাট বাড়িয়ে দেন। ডান দিকে শরীরকে ছুঁড়ে ফের একবার তাঁর ক্যাচ ধরেন স্মিথ। তবে এই তো প্রথম নয়। লর্ডস থেকে ওভাল, সেঞ্চুরিয়ান থেকে নেপিয়ার। বদলেছে প্রতিপক্ষ। তবে অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দেওয়ার রোগ তাঁর সারেনি। জেমস অ্যান্ডারসন থেকে কাগিসো রাবাদা কিংবা ন্যাথান লিও থেকে মইন আলী। সবার টার্গেট বিরাটের দুর্বল জায়গা। আর তাই তাঁর টেস্ট ৫১ থেকে নেমে গড় ৪৮.৭২-এ দাঁড়িয়েছে। আইসিসি নক-আউট পর্বে তো পরিসংখ্যান আরও খারাপ।
আরও একটা গা শিউরে দেওয়া পরিসংখ্যান রয়েছে। গত চার-পাঁচ বছরে বিদেশে ভারতীয় টপ অর্ডার ব্যাটারদের পারফরম্যান্স আরও ভয়াবহ। গত ২৫-৩০ ইনিংসে এক একজন মহারথীর ব্যাটিং গড় ২০ কিংবা ২২! সেই তালিকায় বিরাটও রয়েছেন। সেটা মেনেও নিয়েছেন হেড কোচ রাহুল দ্রাবিড়। তবে এটাও জানিয়ে গেলেন যে অন্যান্য ভেন্যু, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার পিচ থেকে ওভালের এই পিচের অবস্থা অনেক ভালো ছিল। তবুও বিরাট আপনি পারলেন কোথায়?
সেই দিক থেকে রুট সবার উপরে। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবে সাফল্য না পেলেও, রুটের ব্যাটিংয়ে এর প্রভাব দেখা যায়নি। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ৪৯ টেস্টে তাঁর রান ৪২৮৬। গড় ৫২.২৬। মেরেছেন ১৩টি শতরান ও ১৭টি অর্ধ শতরান। এরমধ্যে শ্রীলঙ্কা ও ভারত সফরে এসে রুট শতরান করেছিলেন। বিরাট কিন্তু বিদেশে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।
প্রাক্তন অজি অধিনায়কও দলের স্বার্থে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। গত অ্যাশেজে ৭৭৪ রান করেছিলেন। সঙ্গে ছিল তিনটি শতরান। এবারের বিশ্ব টেস্ট ফাইনালে তাঁর ১২১ রান ট্রফি জিততে অনেকটা সাহায্য করেছিল। চতুর্থ উইকেটে ট্রাভিস হেডের সঙ্গে যোগ করেছিলেন ম্যাচ উইনিং ২৮৫ রান। বদলে গিয়েছিল ম্যাচের ভাগ্য। এখনও পর্যন্ত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ৩৩ টেস্টে তাঁর রান ২৭৪৮। শতরান ১০ ও অর্ধ শতরান ১৪।
লাল বলের ক্রিকেটে কেন উইলিইয়ামসনের ব্যাটিং গড় ৬০। দুই বছর আগে বিশ্ব টেস্ট ফাইনাল জিততে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রাক্তন কিউই অধিনায়ক। দুই ইনিংসে অর্ধ শতরান করে বদলে দিয়েছিলেন ম্যাচের ভাগ্য। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ২২ টেস্টে রান করেছেন ১৯৮৫। সঙ্গে রয়েছে আটটি শতরান ও তিনটি অর্ধ শতরান।
২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। ‘ফ্যাব ফোর’-এর এই তালিকার সবার নীচে বিরাট। এখনও পর্যন্ত ৩২ ম্যাচে বিরাটের রান ১৮৬৬। গড় একেবারেই বিরাট-সুলভ নয়। মাত্র ৩৬। সঙ্গে রয়েছে মাত্র তিনটি শতরান। আটটি অর্ধ শতরান।
সচিন তেন্ডুলকর পরবর্তী যুগে আজও চার নম্বর জায়গা তাঁর জন্যই রিজার্ভ করা রয়েছে। সচিন তাঁর অস্ত্র নিয়ে সাজঘর থেকে ক্রিজে দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই গ্যালারি থেকে চিল-চিৎকার শুরু হয়ে যেত। বিরাটের ক্ষেত্রেও তো তাই। তাঁর ব্যাটিং বিক্রম দেখার জন্যই তো আকুল হয়ে থাকে ক্রিকেট পাগলের দল। কিন্তু এহেন বিরাট মস্তানি আর কোথায় দেখাচ্ছেন! আইসিসি ইভেন্ট এলেই চাপে চুপসে যান। আর আইপিএল-এর বাইশ গজে চলে তাঁর দহরম মহরম। যেন তিনি আইপিএল নামক সার্কাসের ‘কিং’!