বিপত্তারিণী ব্রত –তেরোর দেবীকে তেরো ফল আর তেরো ফুল।

তেরো মানেই কী ‘অপয়া’? পাশ্চাত্যে ‘আনলাকি থার্টিন’ বলে কথা চালু আছে। বাঙালি ব্রিটিশকে নকল করতে গিয়ে তেরোর গেঁড়োয় দিয়েছে পা। বাঙালির ‘বারো মাসে তেরো পার্বন’ যখন, তাহলে তো ‘তেরো’ পবিত্র, সৌভাগ্যের প্রতীক হবারই কথা! বাঙালির চেতনায় ‘তেরো’ মানে ‘অনেক’, ‘তেরো’ মানে প্রাচুর্যেভরা জীবনচর্যার সংসার; তাতে ভাগ্য বিড়ম্বনার কোনো সম্ভাবনাই নেই! কোনোদিন ছিলও না। খ্রিস্টান ইংরেজের রক্তে তেরো-কে নাকচ করার সংস্কার আছে। বেড়াল রাস্তা কাটে এও তো ব্রিটিশ কুসংস্কার। অথচ বাংলায় কালো বিড়াল ষষ্ঠীর বাহনরূপে স্বীকৃত। ১৩ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতাখানি প্রকাশিত হয়। ১৩ টি গিঁট দিয়ে তৈরি পবিত্র আশীর্বাদী হলুদ সুতো পরিবারের সদস্যরা ধারণ করেন বিপত্তারিণী পূজার দিন।

বাঙালির বিপত্তারিণী ব্রত ইদানীং বাড়ছে। হিন্দু বাঙালির ঘরে-বাইরে নানান বিপদ, তার উপর দুর্নামের কপাল, চাকরিও নেই। বিপদভঞ্জন করতে দেবীপূজায় আচারে তেরোর আধিক্য। একদিকে বাংলার প্রচলিত প্রবাদ, “বারো মাসে বারো ফল/না খেলে যায় রসাতল।” সে না হয় বারো ফল খেলাম শরীর সুস্থ রাখতে, ভিটামিন-মিনারেল-অ্যন্টিঅক্সিডেন্ট-ফাইটোকেমিকেলের যোগান পেতে! তা’বলে এই তেরো ফলে বিপত্তারিণী পূজার আইডিয়া এলো কোত্থেকে?

রথ আর উল্টোরথের মাঝে শনিবার-মঙ্গলবারে অনুষ্ঠিত হয় বিপত্তারিণী ব্রত। বাংলার মায়েরা এদিন সন্তান ও সংসারের মঙ্গল কামনায় এবং যাবতীয় বিপদ দূরে রাখতে আয়োজন করেন এই ব্রতের। গ্রীষ্মের নানান মরশুমী ফলের থোকা ডালায় সাজিয়ে, ১৩ গিঁটের সুতলি উৎসর্গ করে, তেল-সিঁদূর, তেরো রকমের ফুল নিয়ে উপস্থিত হন শক্তিপীঠ ও দেবীর থানে। ফুলগুলিও সব দেশীয়। জবা, নীলকন্ঠ, টগর, বেল, জুঁই, স্বর্ণচাঁপা, শ্বেতচাঁপা, কাঁঠালী চাঁপা, কাঠচাঁপা, পদ্ম, অতসী, কল্কে, মালতীলতা ইত্যাদির তেরো ফুল, সঙ্গে দূর্বাদল। ফলের মধ্যে গোটা হিমসাগর বা ল্যাংড়া আম, কলা, কালোজাম, কাঁঠালের কোয়া, জামরুল, কাঠলিচু বা আঁশফল, ফলসা, বুনো খেজুর, করমচা, গোলাপজাম, নোনা, তালশাঁস, আর আতা দিয়ে সাজানো হয় ডালি। কখন অপ্রাপ্তিতে থাকে আতা, শশা, তরমুজ, বা ফুটি। সবগুলিই গ্রীষ্মকালে মেলে। প্রায় সবই দেশীয় ফল। দু’এক শতক ধরে এর কোনোটির অভাবে পেয়ারা, সবেদা, পেঁপে — এইরকম বিদেশ থেকে ভারতে আসা ফল উৎসর্গ করতে দেখা যাচ্ছে। এসব এখন ভারতের সম্পদ হয়ে উঠেছে। একক ফলের চাইতে যে মিশ্রফলের পুষ্টিমূল্য অধিক, তা ব্রত-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে লোকসমাজ ও আম-জনতা জানতে পেরেছে। রকমারি ফল পেতে তাই গ্রামে লাগাতে হবে ফল বৈচিত্র্য, গ্রামবাসীদের দৃষ্টি এড়াতো না। কোথাও কোথাও আরও স্থানীয় ফলের রমরমা। সব মিলিয়ে এক দারুণ দেশীয় ঐতিহ্য আর মায়েদের মিলন মেলা।

কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.