ভারতীয় রাজনীতিতে ‘ফ্রি’-এর অঙ্ক কষে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা কম বেশি সব রাজনৈতিক দলই করে থাকে। দক্ষিণী রাজ্যে খুল্লাম খুল্লা টিভি, ফ্রিজ দিয়ে ভোট ‘কেনা’র চেষ্টা বহুবার দেখেছে ভারত। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের জেরে সেই সব ক্ষেত্রে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এই কারণেই ‘ফ্রি’-এর নীতি এখন থাকে সরকারি প্রকল্পের মোড়কে। উত্তরপ্রদেশেও এই ‘ফ্রি’-এর রাজনীতি চলে আসছে বহু বছর ধরে। যেই রাজ্যে ভোট হয় জাতপাতের অঙ্কে, সেখানেও ‘ফ্রি’-এর লোভ দেখিয়ে অন্য দলের ‘ভোট ব্যাঙ্কে’ থাবা বসানোর ছক কষতে দেখা গিয়েছে বিরোধী দলগুলিকে। উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারও পিছিয়ে থাকেনি জনগণের হাতে ‘ফ্রি’-এর জিনিস তুলে দিতে। তা সে পড়ুয়াদের ট্যাব হোক, গরিব পরিবরকে রেশন। এরকমই একাধিক ‘ফ্রি’-এর স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনী ইস্তেহারও প্রকাশ করেছে গেরুয়া শিবির। তবে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি কি কাজে দেয়?
কোভিড আবহে বিগত দিনে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার অধীনে উত্তরপ্রদেশের ১৫ কোটি মানুষ বিমানূল্যে রেশন পেয়েছেন। তাছাড়াও একাধিক প্রকল্পের আওতায় কম সুদে ঋণ পেয়েছেন সেরাজ্যের যুব সমাজ, মহিলা, ঘরে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকরা। পাশাপাশি বেশ কিছু স্বাস্থ্য প্রকল্পও চালু হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে। এই সবই জনসাধারণের কষ্ট লাঘবের লক্ষ্যে চালু করা প্রকল্প। তবে এর নেপথ্যে লুকিয়ে আছে সূক্ষ্ম ভোট সমীকরণও।
ভোটমুখী উত্তরপ্রদেশে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকেই অন্ত্যোদয়া কার্ড হোল্ডাররা ‘দ্বিগুণ’ রেশন পাচ্ছেন। একবার রাজ্য সরকারের তরফে পরিবার পিছু ৩৫ কেজি করে খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে অন্ত্যোদয়া কার্ড হোল্ডারদের। আবার কেন্দ্রের তরফেও একই পরিমাণ খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। অন্যদিকে ‘প্রায়োরটি’ রেশন কার্ড হোল্ডাররাও দুই দফায় কেন্দ্র ও রাজ্যের থেকে পাঁচ কেজি করে মোট ১০ কেজি খাদ্যশস্য পাচ্ছেন। তবে এই রেশন বিতরণের বিষয়টি মেনে নিতে পাচ্ছেন না অনেক বিজেপি নেতাই। এই বিষয়ে বিজেপি নেতা প্রয়াগরাজ জেলার ধারাওঁ গজপত গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিদ্যাকান্ত শুক্লা হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, ‘এভাবে বিনামূল্যে দিতে থাকলে মানুষজনের অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।’
এদিকে শুধু বিনামূল্য রেশন নয়, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের অধীনে অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের। কৃষকের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে ঢুকছে প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি যোজনার আওতায়। আবার ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে নিবন্ধিত দোকানদার, দৈনিক মজুরি, ই-রিক্সা চালক, নাপিত এবং নৌকাওয়ালাদের ভরণপোষণ ভাতা হিসাবে ১০০০ টাকা করে দিচ্ছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, হর ঘর নল যোজনা (বুন্দেলখণ্ডের অঞ্চলের লোকেদের বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করার জন্য বাস্তবায়িত করা হচ্ছে), আয়ুষ্মান ভারত এবং উজ্জ্বলার (রান্নার গ্যাস) মতো আরও কিছু প্রকল্প যা সরাসরি উপকার করেছে আম জনতার। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশ সরকার ২০২১ সালে উৎসবের মরশুম থেকে বিনামূল্যে অনেক কিছুই দেওয়া শুরু করেছিল। সম্প্রতি প্রায় ৬৫ লক্ষ শিক্ষিত যুবকদের বিনামূল্যে স্মার্টফোন এবং ল্যাপটপ বিতরণ শুরু করে সরকার। ১৩ লক্ষ ব্যক্তিগত নলকূপের জন্য প্রযোজ্য বিদ্যুতের শুল্ক ৫০ শতাংশে কমিয়ে আনার জন্য ভর্তুকি বৃদ্ধি করে যোগী সরকার।
প্রসঙ্গত, আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ দরিদ্র। এই আবহে সমাজের অধিকাংশ মানুষ এমন সব ত্রাণ বা সুবিধা পাচ্ছেন যা তাঁদের জীবনকে কিছুটা হলেও সহজ করে তুলছে। ভারতের অধিকাংশ মানুষ স্বল্পমেয়াদের সুযোগ সুবিধা দেখে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। সমাজের দরিদ্র অংশ এই ধরনের সাহায্য পেয়ে যে কোনও নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা দলকে ভোট দিতে পারে। সেখানে জাতপাতের সমীকরণ খুব একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াবে না। বরং সেখানে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে ওঠে সেই সরকারি প্রকল্পের সুবিধাগুলি। এর আগে অখিলেশ যাদবও সরকারে থাকাকালীন ল্যাপটপ বিলিয়েছিলেন। তবে বিজেপি এর থেকে অনেক বড় মাত্রায় এবং বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে দিচ্ছে তাদের প্রকল্পগুলির সুবিধা।
তবে বিজেপির এই ‘ফ্রি’-এর অঙ্কের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছে বিরোধী সমাজবাদী পার্টি। সাইকেল বাহিনীর জাতীয় মুখপাত্র তথা সেরাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায়, ‘বিজেপি অবশ্যই ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য সরকারি তহবিলের অপব্যবহার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে ভোটবাক্সে কোনও ফারাক হবে না।’ এদিকে এই ইস্যুতে কংগ্রেসও তোপ দেগেছে গেরুয়া শিবিরকে। উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি পঙ্কজ শ্রীবাস্তব এই বিষয়ে বলেন, ‘কংগ্রেস খাদ্যের অধিকার এনেছে। তারা (বিজেপি সরকার) দাবি করছে যে ১৫ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হচ্ছে। রাজ্যের এত বিপুল সংখ্যক মানুষ কীভাবে নিজেদের জন্য খাদ্য উপার্জনের অবস্থায় নেই তারই প্রতিফলন এটি। এটি উত্তরপ্রদেশের দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিরও প্রতিফলন।’
যদিও উত্তরপ্রদেশ বিজেপির মুখপাত্র অবনীশ ত্যাগী এই বিষয়ে বলেন, ‘বিনামূল্যে রেশন এবং অন্যান্য ত্রাণ বিতরণ কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষকে সাহায্য করেছে। এতে নতুন কিছু নেই। কারণ ২০২২ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ঘোষণার অনেক আগেই জনগণকে এই সহায়তা দেওয়া শুরু হয়। এই ত্রাণ জনগণকে সাহায্য করার জন্য দেওয়া হচ্ছে, ভোটের প্রলোভন হিসাবে