না গো, আমি মৃণালিনী নই। আমি ভবতারিণী, আমি যশোরের কুলতলি গ্রামের মেয়ে। আমার বাবা বেণী রায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তায় কাজ করতেন। ওনারা ছিলেন বিরানি বামুন – মানে মুসলমানের ছোঁয়া লাগা বামুন। তাই ওদের ঘরে কেউ মেয়ে দিত না। আমার তখন মাত্র ন বছর ন মাস বয়স। ঘরে পুতুলের সংসার সাজাই আর পুকুরে দাপাদাপি করি।
হঠাৎ শুনলাম আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছোটো ছেলের সঙ্গে। আমাকে নাকি দেখতে আসবেন। তিনি আমাকে দেখতে এলেন দুই বৌঠানের সঙ্গে।
ছ ফুট দু ইঞ্চি লম্বা, শ্বেত পাথরের মত গায়ের রং , চোখ মুখ থেকে যেন জ্যোতি বেরোচ্ছে। সঙ্গের দুই বৌঠানের নাম জানবে না? মেজো বৌঠান জ্ঞানোদা নন্দিনী আর নতুন বৌঠান কাদম্বরী। জ্ঞানোদা নন্দিনীর অসামান্য রূপ আর ব্যক্তিত্বের পাশে ছোটো খাটো, রোগা পাতলা শ্যামলা রঙের কাদম্বরীকে সেদিন চোখেই লাগেনি।।
অনেক পরে আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ” আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করলেন কেনো?” উনি বললেন – ” মেজো বৌঠান বড্ডো পীড়াপীড়ি করছিলেন। আমি বললাম ঠিক আছে। যা ভালো মনে হয় কর।”
বাসর ঘরে আমি ভয়ে কেঁদে উঠেছিলাম। বাসর ঘর হয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। আমার স্বামী নাকি বলেছিলেন তিনি বিয়ে করতে কোথাও যেতে পারবেন না। বিশেষ করে কোনো কর্মচারীর মেয়েকে বিয়ে করতে তো নয়ই। আমাকে নিয়ে আসা হল জোড়াসাঁকোর জমিদার বাড়িতে। এত বড়ো বাড়ী, এত লোকজন এই প্রথম দেখলাম।এদের কথাবার্তা, আদব কায়দা সব আলাদা। আমার স্বামীর মুখে যেন এক রাগ রাগ ভাব আর সেই সঙ্গে যেন একরাশ বিষাদের ছায়া। আর সেই রাগে বাসর ঘরে যখন যখন ভাঁড় খেলা শুরু হয়েছে তখন আমার স্বামী সব ভাঁড়গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন। ছোটো কাকিমা চিৎকার করে বললেন – ” কি করছিস রবি, ভাঁড় গুলো সব উপুড় করে দিচ্ছিস কেনো?” আমার স্বামী বললেন- ” জানো কাকীমা, আজ থেকে আমার জীবনের সব কিছুই ওলোট পালোট হয়ে গেল। তাই ভাঁড় গুলো সব উল্টে দিচ্ছি।” একটু দূরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন নতুন বৌঠান আমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। সেদিন বুঝি আমার স্বামীর কথা শুনে সব মেয়ে কেনো কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে ছিলো। নতুন বৌঠানার সেই তাকিয়ে থাকা আর আমার স্বামীর সেই কথা আমার আজও মনে পড়ে।
আমার বিয়ের ঠিক চার মাসের মাথায় ঘটলো সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। দরজা খুলে দেখা গেল নতুন বৌঠান আত্মহত্যা করেছেন বিষ খেয়ে। সঙ্গে পাওয়া গেলো দুটি চিঠি – প্রথমটি আপাদমস্তক এক প্রেমের চিঠি কাদম্বরীর স্বামীর উদ্দেশ্য লেখা এক বিখ্যাত এক অভিনেত্রীর আর দ্বিতীয়টি কাদম্বরী লিখেছিলেন তার স্বামীকে ( সুইসাইড নোট)। এর আগেও নাকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন কাদম্বরী। সতেরো বছরের দেওর আর উনিশ বছরের বৌদির গোপন সম্পর্ক নিয়ে ঠাকুরবাড়ীর আনাচে কানাচে এক ঝড় উঠেছিলো। সেই ঝড় সামলাতে স্বয়ং পিতৃদেব তাঁর ছোটো ছেলেকে বিলেত পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
ইতি মৃণালিনী।।
সৌমিত্র সেন