কয়েক দফার মধ্যে অন্যতম একটি দাবি ছিল আরজি কর-কাণ্ডে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। সেই দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি কলকাতার সিপির হাতেই জমা দিতে চেয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কিন্তু সোমবার তাতে বাদ সেধেছিল ৯ ফুট উঁচু ‘লৌহকপাট’। আন্দোলনকারীদের রাস্তা আটকাতে কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের অদূরে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের উপর দেওয়া হয়েছিল ওই ব্যারিকেড। ফিয়ার্স লেনের মুখেই বসে পড়েন জুনিয়র ডাক্তারেরা। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সেই লৌহকপাট সরিয়ে দিল পুলিশ। লালবাজারে গিয়ে কমিশনারের হাতেই স্মারকলিপি তুলে দিল জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল। তার পরেই আন্দোলনকারীরা ফিরে যান আরজি হাসপাতালের ক্যাম্পাসে। জানিয়ে দেন, সেখান থেকেই চলবে আন্দোলন।
সোমবার বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে মঙ্গলবার সকাল, তার পর বিকেল— প্রায় ২২ ঘণ্টা ধরে লৌহকপাটের এক পাশে আন্দোলনকারীরা। অন্য পাশে পুলিশ। বার তিনেক কথাবার্তা হয়েছে দু’পক্ষের। প্রথমটায় বরফ গলেনি। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার বিকেল নাগাদ অনুমতি মেলে লালবাজারের ভিতরে প্রবেশ করে কমিশনার বিনীতের হাতে স্মারকলিপি জমা দেওয়ার। সেই স্মারকলিপি জমা দেওয়ার পাশাপাশি একটি প্রতীকী শিরদাঁড়াও বিনীতের হাতে তুলে দেন আন্দোলনকারীরা। জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে জানানো হয়েছে, বিনীত তাঁদের জানিয়েছেন, নিজের কাজে তিনি খুশি। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি তাঁকে সরিয়ে দেন, তবে তা হাসিমুখে মেনে নেবেন। এর পরেই জুনিয়র ডাক্তারেরা বাইরে বেরিয়ে এসে জানিয়ে দেন, তাঁদের আন্দোলন চলবে। তবে রাস্তায় নয়, ক্যাম্পাসে।
কলকাতার সিপির পদত্যাগের দাবিতে ‘লালবাজার অভিযান’-এর ডাক দিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সোমবার দুপুর ২টোয় কলেজ স্কোয়্যার থেকে মিছিল করে লালবাজারের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা ছিল তাঁদের। কলেজ স্কোয়্যার যখন চলছিল হোর্ডিং, প্ল্যাকার্ড লিখন, মিছিলের প্রস্তুতি, তখন প্রস্তুতি সারছিল কলকাতা পুলিশও। কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলেছিল লালবাজার চত্বর। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে প্রায় ন’ফুট উঁচু ব্যারিকেড তুলে নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি তৈরি করে পুলিশ। লোহার গার্ডরেলের পিছনে বসানো হয় বাঁশের ব্যারিকেডও। সেখানে বন্ধ করে দেওয়া হয় যান চলাচল। গোটা ফিয়ার্স লেনে তখন গিজগিজ করছে পুলিশ। আকাশে চলছে ড্রোনের নজরদারি। দুপুর ২টো ৫৫ মিনিট নাগাদ কলেজ স্কোয়্যার থেকে মিছিল শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। এক ছাত্রীর হাতে ছিল প্রতীকী ‘শিরদাঁড়া’। সকলের মুখে মুখে তখন ঘুরছিল স্লোগান, ‘ছিনিয়ে নিতে ন্যায়বিচার/ গোলাপ হাতে লালবাজার।’ আন্দোলনকারীদের কারও হাতে ছিল গোলাপ, কারও হাতে ছিল রজনীগন্ধার তোড়া। উদ্দেশ্য ছিল, লালবাজারে পৌঁছে পুলিশের হাতে ফুল তুলে দেবেন তাঁরা।
যদিও লালবাজারে আর পৌঁছনো হয়নি আন্দোলনকারীদের। ফিয়ার্স লেনে তাঁদের আটকে দেয় পুলিশ। রাস্তায় ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড, আর তা ঘিরে রেখেছেন পুলিশ কর্মীরা। দমার পাত্র নন আন্দোলনকারীরাও। রাস্তায় তাঁরা আগুন ধরান বিনীতের কুশপুতুলে। তার পর সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ বসে পড়েন সেই রাস্তাতেই। আন্দোলনকারীরা জানিয়ে দেন, মিছিল এগোতে না দিলে সেখানেই বসে থাকবেন তাঁরা। কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত যত মিছিল হয়েছে, সব ফিয়ার্স লেনেই আটকানো হয়েছে। এটাই নিয়ম। এই মিছিলও এগোতে দেওয়া হবে না। ওঁরা যদি শান্তিপূর্ণ অবস্থান করতে চান, করুন।’’ পুলিশের তরফে এ-ও জানানো হয়, জুনিয়র চিকিৎসকদের কথা মতো ২০ জনের প্রতিনিধি দলকেই ভিতরে যেতে দেওয়া হবে। আন্দোলনকারীরা নাছোড় হয়ে ওঠেন। তাঁদের দাবি, মিছিল এগোতে দিতে হবে, নয়তো সিপিকে এসে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কোনওটাই না হলে, অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি কিঞ্জল নন্দ অবস্থানরত সকলের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘‘বন্ধুরা, সিপি যত ক্ষণ না আসছেন কিংবা পদত্যাগ করছেন, আমরা এখান থেকে এক পা-ও নড়ব না।’’ তিনি আরও দাবি করেন যে, আগে পুলিশ জানিয়েছিল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট এবং বিবি গাঙ্গুলি ক্রসিং পর্যন্ত মিছিল যেতে দেওয়া হবে। কিন্তু এখন তা দেওয়া হচ্ছে না। যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) রূপেশ কুমার দাবি অস্বীকার করে বলেন, ‘‘এই এলাকায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৬৩ ধারা জারি রয়েছে। তা ছাড়া এমনিতেও অতীতে সব মিছিল বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটেই আটকানো হত।’’
এই বাদানুবাদের মাঝে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন অতিরিক্ত কমিশনার (৫) অশেষ বিশ্বাস। তাঁর প্রস্তাব ছিল, ‘‘লালবাজারে এসে কথা বলুন।’’ কিন্তু বিনীতের ইস্তফার দাবিতে অনড় আন্দোলনকারীরা। তাঁদের দাবি, যত দূর মিছিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তত পর্যন্তই যেতে দিতে হবে মিছিল। নয়তো আসতে হবে স্বয়ং কমিশনারকে। তাঁরা সাফ বলে দেন, ‘‘৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করে আমরা অভ্যস্ত। রাত জাগতে সমস্যা নেই! যত ক্ষণ না ওঁরা দাবি মানছেন, এক পা-ও নড়ব না এখান থেকে।’’ প্রায় এক ঘণ্টা পর ছাত্রদের কাছে আবার একই প্রস্তাব নিয়ে যান যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক)। মানেননি আন্দোলনকারীরা। এই আবহেই সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। সেই খবরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন পড়ুয়ারা। আন্দোলনকারী এক চিকিৎসক অনিকেত মাহাতো বলেছিলেন, ‘‘সকল আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের কুর্নিশ। তবে সন্দীপ স্যর গ্রেফতার হলেও আন্দোলন চলবে।’’ রাত সাড়ে ১০টারও পরে আন্দোলনস্থলে যান কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা বর্তমান বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে দেখেই ‘গো ব্যাক’ স্লোগান তোলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ফিরে যেতে বাধ্য হন তিনি।
সোমবার রাতে আন্দোলনকারীদের অবস্থানে পৌঁছন অভিনেত্রী চৈতি ঘোষাল, দেবলীনা দত্ত এবং সুদীপ্তা চক্রবর্তী। রাত গড়ালেও থামেনি আন্দোলন। খাওয়াদাওয়ার পর পথেই ত্রিপল, প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে পড়েন আন্দোলনকারীদের অনেকে। বাকিরা স্লোগান তোলেন, ‘‘বিচার চাই।’’ মাঝে লৌহকপাট। শুধু পুলিশ বা চিকিৎসকেরাই নন, রাত জাগেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়-সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা। তবে রাতে লালবাজারে ছিলেন না বিনীত।
রাত জাগার পর মঙ্গলবার সকালে আবার স্লোগান তোলেন পড়ুয়ারা। কড়া রোদ উপেক্ষা করে রাজপথে বসে পড়েন তাঁরা। দাবি তোলেন, সিপি-কে এসে দেখা করতে হবে। নয়তো মিছিলকে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ও বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের সংযোগস্থল পর্যন্ত যেতে দিতে হবে। লৌহকপাটের অন্য পাশে নড়েচড়ে বসে পুলিশও। বেলা যত গড়ায়, বৃদ্ধি পেতে থাকে আন্দোলনকারীদের ভিড়। এরই মধ্যে লালবাজারে পৌঁছন সিপি।
মঙ্গলবার বেলা ১২টা নাগাদ অবস্থানরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সন্তোষ পাণ্ডে। চিকিৎসক কিঞ্জল-সহ অন্যান্য প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। অনুরোধ করেন রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। একটি প্রতিনিধি দল যাতে সেখান থেকেই স্মারকলিপি লালবাজারে জমা দিয়ে আসে, সে কথাও বলেন সন্তোষ। আন্দোলনকারীরা মানেননি। দুপুর ২টো নাগাদ ফিয়ার্স লেনে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সঙ্গে ফের এক দফা কথা বলে পুলিশ। এ বার রূপেশ কথা বলেন কিঞ্জলদের সঙ্গে। ব্যারিকেড সরিয়ে দিলে কত দূর এগোবেন চিকিৎসকেরা, তার পর কী করবেন, সে বিষয়ে জানতে চান যুগ্ম পুলিশ কমিশনার। আন্দোলনকারীরা জানিয়ে দেন, কোনও ব্যারিকেড রাখা যাবে না। তাঁরা মানববন্ধন করে ভিড় সামলাবেন।
এর পরেই মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ লৌহকপাট সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে কলকাতা পুলিশ। একে একে খোলা হয় তালা, চেন। সরানো হয় ন’ফুটের লোহার ব্যারিকেড। পুলিশ জানায়, মিছিল আরও ১০০ মিটার এগোতে পারবে। সেখান থেকে ২২ জনের প্রতিনিধি দল লালবাজারে প্রবেশ করবে। ব্যারিকেড সরতেই মানববন্ধন করে এগিয়ে যান জুনিয়র ডাক্তারেরা। কণ্ঠে গান, ‘আমরা করব জয়’। হাতে সেই প্রতীকী শিরদাঁড়া। ১০০ মিটার এগোনোর পর থামে মিছিল। সামনের সারিতে মানববন্ধন করে দাঁড়িয়ে থাকেন আন্দোলনকারীরা। সেখান থেকে ২২ জন আন্দোলনকারী বিনীতের সঙ্গে দেখা করতে চলে যান। হাতে সেই প্রতীকী শিরদাঁড়া।
কমিশনারের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা কথা বলার পর প্রতিনিধিদল বেরিয়ে এসে জানায়, ১৪ তারিখ ও ১২ তারিখের ঘটনা প্রসঙ্গে কমিশনার মেনে নিয়েছেন, এটি পুলিশি ব্যর্থতা। কিন্তু আলোচনার কোনও সদুত্তর তাঁরা পুলিশ কমিশনারের থেকে পাননি। এক প্রতিনিধির কথায়, ‘‘আমরা আমাদের দাবিতে এখনও অনড়। নৈতিক দায় নিয়ে সিপির পদত্যাগ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।” তিনি জানিয়ে দেয়, অবস্থান-বিক্ষোভ তুলে নিলেও বিচারের দাবিতে আন্দোলন একই ভাবে চলবে। তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘পুলিশ কমিশনারকে আমরা প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি এই ঘটনায় নৈতিক দায়ভার নিচ্ছেন কি না! জবাবে সিপি জানিয়েছেন, তিনি নিজের কাজে সন্তুষ্ট। তবে যদি তাঁর কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনে করেন, তিনি নিজের কাজে ব্যর্থ এবং তাঁকে যদি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়— সেটিও তিনি হাসিমুখে মেনে নেবেন।” বিনীতকে সেই প্রতীকী শিরদাঁড়াও দিয়ে আসে প্রতিনিধি দল।
ফিয়ার্স লেনে তত ক্ষণে আন্দোলনকারীরা কাটিয়ে ফেলেছেন প্রায় ২৪ ঘণ্টা। তাঁরা জানিয়ে দেন, পথে আর নয়, এ বার আন্দোলন চলবে ক্যাম্পাসে। তবে আগের ২৪ ঘণ্টার ‘আস্তানা’ তাঁরা সে ভাবে ফেলে রেখে যাননি। যাওয়ার আগে রীতিমতো ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করে গিয়েছেন ফিয়ার্স লেন। সরিয়ে দিয়েছেন আবর্জনা। সেই সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছেন, বিচারের দাবি থেকে সরছেন না।