ট্রেনের নামবিভ্রাটেই পদপিষ্ট! দেরি কুম্ভমুখী ৩ এক্সপ্রেসেরও, দায় ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত রেল

কুম্ভমেলায় যাওয়ার জন্য নয়াদিল্লি স্টেশনে তখন পুণ্যার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। এমন পরিস্থিতি যে কেউ নিজের মতো করে দাঁড়াতেই পারছেন না এক জায়গায়। ভিড় যে দিকে ঠেলছে, সে দিকেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে! এই ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে মৃত্যু হয় অন্তত ১৮ জনের। মেয়েকে হারান এক বাবা। প্রাণ হারায় বছর সাতেকের ওই শিশু। মাথায় পেরেক গেঁথে যায় তার! শনিবার রাতে যখন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখন উত্তর রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক হিমাংশুশেখর উপাধ্যায় বলে দিলেন, কোনও পদপিষ্টের ঘটনাই নাকি ঘটেনি। রাত পেরিয়ে সকাল হতেই বয়ান বেআব্রু হল বাস্তব চিত্রে। বয়ান বদলাতে হল রেলকে। মু‌খ্য জনসংযোগ আধিকারিক স্বীকার করলেন, পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে। তবে তখনও যেন দায় এড়িয়ে যাওয়ার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা দেখা গিয়েছে তাঁর বয়ানে।

নয়াদিল্লি স্টেশনে শনিবার রাতে দৃশ্যত জনসমুদ্র তৈরি হয়েছিল। কুম্ভমেলায় যাওয়ার জন্য পুণ্যার্থীদের ভিড়। ট্রেন দেরি হওয়ার কারণে ভিড় ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল স্টেশনে। এক সময়ে তা বাঁধ ভাঙে। ভিড় এবং ধাক্কাধাক্কির মধ্যে দমবন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। পদপিষ্টের পরিস্থিতি তৈরি হয় নয়াদিল্লি স্টেশনে। প্রথমে জানা যায়, চার জন মহিলা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। তার কিছু ক্ষণ যেতে না যেতেই শোনা যায়, ১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ভোর হতে হতে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ হয়ে যায়। আহত হয়েছেন প্রচুর মানুষ। কিন্তু কতজন আহত, সেই পরিসংখ্যান সরকারি ভাবে এখনও পর্যন্ত জানানো হয়নি।

নয়াদিল্লি স্টেশন দেশের অন্যতম ব্যস্ত একটি রেল স্টেশন। দীপাবলির সময়ে বা অন্য কোনও উৎসবের সময়ে নয়াদিল্লি স্টেশনে মরসুমি ভিড় নতুন কিছু নয়। তবে এমন ভিড়ের ঠেলা শেষ কবে দেখা গিয়েছে, মনে করতে পারছেন না অনেকেই। নয়াদিল্লি স্টেশনে ১৯৮১ সাল থেকে কাজ করা এক কুলি কিংবা গত ১২ বছর ধরে প্ল্যাটফর্মে গীতা প্রেসের বইয়ের দোকান চালানো ব্যক্তি, কেউ-ই এমন ভিড় দেখেননি অতীতে। রেলের তরফে মৃতদের ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে। গুরুতর আহতদের আড়াই লক্ষ টাকা এবং বাকি আহতদের এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কী ভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হল, তা খতিয়ে দেখতে উচ্চপর্যায়ের তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছে রেল।

ট্রেন ধরতে হুড়োহুড়ি

নয়াদিল্লি থেকে কুম্ভমেলার যাত্রীদের জন্য প্রয়াগরাজমুখী স্পেশাল ট্রেন চালাচ্ছে রেল। এ ছাড়া অন্য একটি প্রয়াগরাজমুখী ট্রেনও রয়েছে। আরও তিনটি ট্রেন রয়েছে যেগুলি নয়াদিল্লি থেকে কুম্ভ হয়ে অন্য গন্তব্যের দিকে যায়। তবে শনিবার রাতে বেশ কয়েকটি ট্রেন দেরিতে চলছিল বলে অভিযোগ যাত্রীদের। এই অবস্থায় রাত ৮টার পর থেকেই স্টেশনে থিকথিকে ভিড় হয়েছিল। বহু মানুষ অপেক্ষা করছিলেন কুম্ভমেলায় যাওয়ার ট্রেনের জন্য। তাঁদের দাবি, রাত ১০টা নাগাদ একটি ট্রেনের ঘোষণা হয়। তার পরেই ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রয়াগরাজমুখী একটি ট্রেন ধরার জন্য যাত্রীদের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। কুম্ভমেলায় যাঁরা যেতে চান, প্রত্যেকেই এই ট্রেনের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন, এত মানুষ একটি ট্রেনে উঠতে পারবেন না। প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে ট্রেনটিতে উঠতে চেয়েছিলেন। ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের পাশাপাশি ১২ এবং ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকেও মানুষ ছুটে আসেন। ভিড়ের ঠেলায় অনেকে ফুটওভার ব্রিজে, সিঁড়িতে পড়ে যান। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, যাঁরা পড়ে গিয়েছেন, তাঁদের মাড়িয়েই ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বাকিরা। যে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের অধিকাংশই হয় বিহার (ন’জন), অথবা দিল্লির বাসিন্দা (আট জন)। এক জন কেবল হরিয়ানার বাসিন্দা রয়েছেন। মৃতদের তালিকায় সাত বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭৯ বছরের বৃদ্ধাও রয়েছেন।

রেল পরিষেবা নিয়ে ক্ষোভ

প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, নয়াদিল্লি স্টেশনের ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘প্রয়াগরাজ স্পেশ্যাল’ ছাড়ার কথা ছিল। আচমকাই ঘোষণা করা হয় ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে ট্রেনটি। ফলে ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ধরার জন্য যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন এবং যাঁরা স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এর ফলে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। এ ছাড়া আরও একটি অভিযোগ উঠে আসছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ অভিযোগ তুলছেন, পর পর দু’টি ট্রেন সঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছোয়নি। ট্রেনগুলির সময় পিছিয়ে গিয়েছিল বেশ খানিকটা। এই দু’টি ট্রেনে যে যাত্রীদের ওঠার কথা ছিল, স্টেশনের ১২, ১৩ এবং ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন। সময়ে ট্রেন না-আসায় ভিড় বাড়তে থাকে।

রেলের দায় এড়ানোর চেষ্টা

শনিবার ঘটনার পর উত্তর রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক প্রথমে জানান, কোনও পদপিষ্টের ঘটনাই ঘটেনি। তখনও অবশ্য মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। পুরোটাই সে সময়ে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিতে চান তিনি। পরে মৃত্যুর তথ্য জানাজানি হতেই ওই একই আধিকারিকের বয়ান বদলে যায়। সংবাদ মাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’কে তিনি বলেন, “১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রচুর যাত্রী ফুটওভার ব্রিজ ধরে ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময়েই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রচুর পুণ্যার্থীর এক সঙ্গে হঠাৎ হুড়োহু়ড়ির ফলে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে।” তবে ওই সময়েও তিনি জানান, কোনও ট্রেনের নির্ধারিত প্ল্যাটফর্ম বদল হয়নি। কোনও ট্রেন বাতিলও হয়নি। রেলের দাবি, নির্ধারিত সূচি মেনেই সব ট্রেন চলছিল। যাত্রীরা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা যে ‘ভুল ঘোষণা’র অভিযোগ তুলছেন, তা পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়েছে রেল।

কোথায় বিভ্রান্তি, কী দেখল পুলিশ?

রেল বলছে, কোনও ট্রেন নির্ধারিত প্ল্যাটফর্মের বদলে অন্য প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করেনি। এমন কোনও ঘোষণার কথাও মানতে চাইছে না রেল। তবে দিল্লি পুলিশ প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর জানতে পারে, রেলের ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই যাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। প্রয়াগরাজ যাওয়ার দু’টি ট্রেনের নাম প্রায় একই! একটির নাম ‘প্রয়াগরাজ স্পেশাল’ এবং অন্যটি ‘প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস’। এর জেরেই গোলযোগের সূত্রপাত বলে মনে করছে পুলিশ। নয়াদিল্লি স্টেশনের ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল ‘প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস’। এরই মধ্যে রেল ঘোষণা করে, ‘প্রয়াগরাজ স্পেশাল’ ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। ফলে যে যাত্রীরা ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে উঠতে পারেননি, তাঁরা মনে করেন ‘প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। এর ফলে শেষ মুহূর্তে মালপত্র নিয়ে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার জন্য যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই কারণেই পদপিষ্টের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

প্রয়াগরাজমুখী তিনটি ট্রেনের দেরি

রেল বলছে, প্ল্যাটফর্ম বদল হয়নি। ট্রেন বাতিলও হয়নি। তবে প্রয়াগরাজগামী অন্য ট্রেনগুলি যে দেরিতে চলছিল, সে বিষয়ে বিশেষ কিছু বলছে না রেল। নয়াদিল্লি থেকে প্রয়াগরাজ যাওয়ার জন্য ওই সময়ে চারটি ট্রেন ছিল। তার মধ্যে তিনটি ট্রেনই দেরিতে চলছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ অনুসারে, প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস রাত ১০টা ১০ মিনিটে নয়াদিল্লি থেকে ছাড়ার কথা ছিল। বাকি তিনটি ট্রেনই দেরিতে চলছিল। ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে মগধ এক্সপ্রেস কিছুটা দেরিতে আসে। ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসার কথা ছিল ‘স্বতন্ত্রতা সেনানী’ এক্সপ্রেসের। সেটিও দেরিতে চলছিল। ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ভুবনেশ্বর রাজধানী এক্সপ্রেসও দেরিতে চলছিল। দেরিতে থাকা এই তিনটি ট্রেনেরই যাত্রাপথ কুম্ভের উপর দিয়ে।

জেনারেল টিকিটের ভিড়

নয়াদিল্লি স্টেশনে যাত্রীদের অতিরিক্ত ভিড়ের নেপথ্যে অন্যতম কারণ হিসাবে উঠে আসছে জেনারেল টিকিট বিক্রির তত্ত্ব। অনেকেই দাবি করছেন, প্রচুর সংখ্যায় জেনারেল টিকিট বিক্রি করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই অনুপাতে ট্রেন ছিল না। রেলের একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান রিপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদমাধ্যম ‘আজ তক’ জানিয়েছে, ওই সময়ে প্রয়াগরাজ যাওয়ার জন্য প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৫০০টি জেনারেল টিকিট বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ট্রেন দেরি করায় সব জেনারেল টিকিটের যাত্রীর ভিড় গিয়ে পড়ে একটি ট্রেনের উপরেই!

রেলের ভূমিকায় প্রশ্ন, রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি

শনিবার রাতের ঘটনায় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের পদত্যাগের দাবি তুলেছে কংগ্রেস। কুম্ভের পুণ্যার্থীদের সুরক্ষা দিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ কংগ্রেসের। রাহুল গান্ধীর কথায়, “এটি রেলের ব্যর্থতা এবং এই সরকারের অসংবেদনশীলতার প্রমাণ।’’ প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদবও বিঁধেছেন কেন্দ্রকে। তাঁর দাবি, এই ঘটনার দায় নিতে হবে রেলমন্ত্রীকে। নয়াদিল্লি স্টেশনের ঘটনায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠে আসছে বিরোধী শিবির থেকে। সমাজবাদী পার্টি, আপ আদমি পার্টি এবং তৃণমূলও এই ঘটনায় সরব হয়েছে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, “এই ঘটনা আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিল, নাগরিকদের সুরক্ষার প্রশ্নে সঠিক পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা কতটা জরুরি।”

নতুন অঘটন এড়াতে সতর্কতা

রবিবার সকালে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্টেশন তো বটেই, বিহারের একাধিক স্টেশনেও বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়। এই সমস্ত স্টেশন থেকে প্রয়াগরাজের ট্রেন ধরার জন্য জড়ো হন পুণ্যার্থীরা। নয়াদিল্লির মতো ঘটনা যাতে আর না-ঘটে, তা নিশ্চিত করতে চায় প্রশাসন। তবে রবিবার সকালেও নয়াদিল্লি স্টেশনের ছবি খুব একটা বদলায়নি। অভিযোগ, সকাল থেকে সেখানে একইরকম ভাবে ভিড় করেছেন মানুষ। প্রয়াগরাজের ট্রেনে একই রকম ভিড় হচ্ছে। ভিড় ট্রেনের জানলা দিয়ে এক বৃদ্ধাকে ভিতরে ঢুকতে দেখা গিয়েছে। তার ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। যদিও ওই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.