তিন দশক পেরিয়ে নতুনকে দিশা দেখাচ্ছে সিমা গ্যালারি, জীবনকৃতি সম্মান তিন শিল্প-চিন্তককে

সৃষ্টি এক কথা। শিল্পীর সেই সৃষ্টিকে সম্মান জানাতে পারা, আর এক। সম্মানের অভাবে বহু জনের শিল্প নানা ভাবে থেকে যায় আড়ালে। আবার লুপ্তপ্রায় শিল্পও সহৃদয় চিন্তকের চেষ্টায় ফিরে আসে সকলের মাঝে। গত তিন দশক ধরে সিমা গ্যালারি সেই কাজটিই করে চলেছে অক্লান্ত ভাবে। আর এত বছরের সেই নিষ্ঠার সঙ্গী হয়ে গিয়েছেন বহু শিল্পী ও শিল্প-চিন্তক।

গ্যালারির তিরিশ বছরের উদ্‌যাপন পর্বে তেমনই সকলকে নতুন করে কাছে টেনে নিল সিমা। জীবনকৃতি সম্মান জানাল তিন শিল্প-চিন্তককে। এত বছরের পথ চলায় সঙ্গী থেকেছেন বহু গুণী জন। কেউ প্রথম থেকে পথ বেছে নিতে সাহায্য করেছেন, কেউ বা চলার পথে সঙ্গী হয়ে উঠেছেন। তাঁদের কারও অবদানই কম নয় বলে মনে করেন সিমা গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকার। তারই উৎসাহে রবি-সন্ধ্যায় শহরের এক হোটেলে আয়োজন হল বিশেষ অনুষ্ঠানের। সেখানে সম্মান জানানো হল প্রয়াত শিল্পী সুষেণ ঘোষ, শিল্পী রুবি পালচৌধুরী এবং শিল্প-চিন্তক ও লেখক অলকা পাণ্ডেকে। শিল্প জগতে সারা জীবনের অবদানের জন্যই সংবর্ধনা দেওয়া হল তাঁদের।

CIMA art gallery felicitates three contributors to the art world on its thirtieth anniversary

৯০ পেরিয়েও রীতিমতো উৎসাহের সঙ্গে কাজ করে চেলেছেন রুবি পালচৌধুরী। সরকারি আর্ট কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে পাড়ি দেন বিলেতে। সেখানে পেন্টিং ও ইলাস্ট্রেশন নিয়ে বিশেষ চর্চা শুরু। পরে দেশে ফিরে অবশ্য বেশি মন দেন নানা প্রান্তের শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের এগিয়ে নিয়ে চলার কাজে। হস্তশিল্পের পুনরুজ্জীবনের কাজেই নিযুক্ত রাখেন নিজেকে। দেশের ক্রাফ্‌টস কাউন্সিল তৈরি হওয়ার পর থেকেই যুক্ত থেকেছেন তার সঙ্গে।

CIMA art gallery felicitates three contributors to the art world on its thirtieth anniversary

প্রায়াত শিল্পী সুষেণ ঘোষও নিজের কাজের পাশাপাশি কলা-জগতকে উন্নত করায় ব্যস্ত থেকেছেন আজীবন। লেখাপড়া বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে। কিছু দিনের মধ্যেই বিলেত পাড়ি দেন। ১৯৬৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ডস্মিথ কলেজে আবার লেখাপড়া শুরু। বিদেশি শিল্পীদের সঙ্গে কাজ। কয়েক বছর সেখানেই বসবাস। বিদেশে যাওয়ার আগেই পড়াতে শুরু করেন সুষেণবাবু। ১৯৭০ সালে যখন দেশে ফিরে আসেন, তার পর থেকে আজীবন কলা ভবনের সঙ্গেই যুক্ত থেকেছেন শিল্পী। ছিলেন সেখানকার অধ্যক্ষও। নিয়মিত সঙ্গীতচর্চা এবং দর্শন নিয়ে লেখাপড়াও করতেন শিল্পী। ভাস্কর্যে ফুটে উঠত সে অভ্যাসের প্রভাবও। রবিবার শিল্পীর কন্যা মহুয়া ঘোষ তাঁর হয়ে সম্মান গ্রহণ করলেন।

শিক্ষক, লেখক ও শিল্প-চিন্তক অলকা পাণ্ডের গবেষণা ভারতীয় শিল্প ভাবনা নিয়ে। ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে অর্ধনারীশ্বরের ধারণায় বিশেষ জোর দিয়েছেন তাঁর গবেষণায়। চণ্ডীগড়ের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, সেখানকার ‘মিউজ়িয়াম অব ফাইন আর্টস’-এর অধিকর্তাও ছিলেন। বর্তমানে দিল্লির ‘ইন্ডিয়া হ্যাবিটাট সেন্টার’-এর শিল্প পরামর্শদাতা তিনি। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন নবীন প্রজন্মকে পড়ানোর কাজও। ‘ভয়সেস অ্যান্ড ইমেজেস’, ‘মাস্টার পিস অফ ইন্ডিয়ান আর্ট’, ‘লীলা’-র মতো বেশ কিছু বই লিখেছেন ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে।

CIMA art gallery felicitates three contributors to the art world on its thirtieth anniversary

সিমা গ্যালারি এমনই চিন্তকদের কাছে টেনেছে বরাবর, যাঁরা শিল্পের জগতে উন্নয়ন নিয়ে ভেবে চলেছেন। তিন চিন্তকের সম্মান-অনুষ্ঠান উপলক্ষে গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকার রবিবার বলেন, ‘‘১৯৮৬ সালে প্রথম কিউরেশনের কাজ করি। তখন অনেকে বলেন আরও গুছিয়ে কাজ শুরু করতে। আরও সাত বছর পর শুরু হয় সিমা গ্যালারি। সেই থেকে শিল্প সংক্রান্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’’

রবিবারের অনুষ্ঠানে কলা, শিক্ষা, বিনোদন, রাজনীতি ও সমাজের নানা ক্ষেত্রের কাজে যুক্ত গুণীজনেরা উপস্থিত ছিলেন। সকলের জন্য ছিল স্যাফায়ার গোষ্ঠীর নাচের অনুষ্ঠান।

তিরিশ বছর পূর্তির উদ্‌যাপন উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনীরও পরিকল্পনা করেছে সিমা গ্যালারি। ইতিমধ্যেই সূচনা হয়েছে গণেশ পাইন, সুষেণ ঘোষ, অর্পিতা সিংহ ও শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়ের কাজ নিয়ে প্রদর্শনীর। পরের দু’টি প্রদর্শনীতে থাকবে যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, লালুপ্রসাদ সাউ, সোমনাথ হোড়, শর্বরী রায়, সনৎ কর, মীরা মুখোপাধ্যায়, জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের কাজ। এ ছাড়া, আরও একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে সিমা। নাম ‘ফ্যান্টাস্টিক রিয়্যালিটিস অ্যান্ড বিয়ন্ড এগ্‌জিবিশন’। ফেব্রুয়ারি মাসে তা প্রথমে দেখানো হবে দিল্লির ভিজ়ুয়াল আর্টস গ্যালারিতে। তার পরে আগামী এপ্রিল মাসে সিমা-য় তা দেখানো হবে। বারো দশকের শিল্প, ৩৬ জন শিল্পীর কাজের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে তাতে। গত কয়েক দশকে এ দেশে শিল্পের বির্বতন কী ভাবে ঘটেছে, তা-ই ফুটিয়ে তোলা উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.