ছি ছি এত্তা জঞ্জাল! বাংলার জঙ্গলে নিজের ঘরের বর্জ্য জড়ো করছে সিকিম, অতিষ্ঠ জনতা, পড়ুয়া ও বন্যপ্রাণ

হঠাৎ এত জঞ্জাল এল কোথা থেকে? ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ রচিত ‘আলিবাবা’ নাটকে বিরক্ত মর্জিনার গলায় শোনা গিয়েছিল— ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!’ সেই পরিচিত লব্জই এখন শিলিগু়ড়ির অদূরে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলঘেঁষা গ্রামের বাসিন্দাদের মুখে মুখে।

গ্রামবাসীদের অভিযোগ, নিজের রাজ্যের জঞ্জাল বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলে এনে জমা করছে সিকিম। যার জেরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে গোটা এলাকায়। সামনেই বাচ্চাদের স্কুল। বিশ্রী গন্ধের চোটে শিশুরাও স্কুলে যেতে পারছে না। বনাঞ্চলে এ ভাবে বর্জ্য কার অনুমতিতে ফেলা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিবেশপ্রেমী ও বন্যপ্রাণ সংগঠনগুলি। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটেও বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে তারা। এর মধ্যে বর্জ্য ফেলার চারটি গাড়িও আটকেছেন গ্রামবাসীরা। অভিযোগ, গাড়িগুলি সিকিম থেকে এসেছিল। খবর পেয়ে আমবাড়ি থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। গাড়িচালকদের কাছে অনুমতিপত্র দেখতে চায় তারা। কিন্তু চালকেরা তা দেখাতে পারেননি। এর পরেই চারটি গাড়ি আটক করা হয়।

ওই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরেই সিকিম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার অনলাইন। সিকিমের নগরোন্নয়ন দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি জিতেন্দ্র রাজি বলেন, ‘‘সিকিম সরকার বর্জ্য রিসাইকল (পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার প্রক্রিয়া)-এর জন্য যে সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে, এটা তাদের গাফিলতি হতে পারে। যে বর্জ্য নিয়ে ঝামেলা, তা সিকিমেই প্রথম দফায় পরিশোধিত হয়। তার পর বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হয় বিহারের সিমেন্ট তৈরির কারখানায়। ওই সংস্থাই হয়তো কোনও সমস্যায় পড়ে শিলিগুড়ির বৈকুন্ঠপুর বনাঞ্চলে বর্জ্য ফেলেছিল। তবে ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। গোটা বিষয়টি মিটেও গিয়েছে।’’

Sikkim dumping garbage in Bengal forests, wildlife organisations shows protest in Siliguri

শিলিগুড়ির ফাড়াবাড়ি মোড়ে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের অংশ রয়েছে। তার পাশেই বসতি। জঙ্গল থেকে ১৫ ফুট দূরত্বে প্রাচীরে ঘেরা একটি ফাঁকা জমিতেই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বর্জ্য জমা করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। খোঁজখবর করে তাঁরা জানতে পারেন, ওই আবর্জনা সিকিমের লোয়ার মারতাম ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকে এনে ফেলা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জ্যোৎস্নাবালা রায় বলেন, ‘‘ওই জমির গেট খোলাই থাকত। আমরা এত দিন তা-ই দেখে এসেছি। কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখছি গেট বন্ধ। মাঝেমাঝেই গাড়ি আসে। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ত্রিপলে মোড়া। গাড়িতে কী আছে বুঝতে পারতাম না। ওই জমিতে ফেলে দিয়ে চলে যেত আবার। পরে যখন গন্ধ বেরোতে শুরু করল, তখন টের পেলাম এত দিন ধরে ওখানে আবর্জনা ফেলা হয়েছে!’’

এলাকার বাসিন্দা নয়ন সরকারের কথায়, ‘‘সিকিমে একটা বোতল রাস্তায় ফেললে জরিমানা করা হয়। আর তারাই এখন নিজেদের ঘরের আবর্জনা এখানে এনে ফেলছে! কাদের অনুমতিতে এই কাজ হচ্ছে আমাদের জানা নেই। এখানে মানুষ এবং বন্যপ্রাণী উভয়েরই বসবাস। আবর্জনা ফেলে দুয়েরই ক্ষতি করছে এরা! এটা হতে দেওয়া যাবে না। এর পর আমরাই একজোট হয়ে আবর্জনার গাড়ি আটকানোর সিদ্ধান্ত নিই।’’

গত সোমবার সকালে আবর্জনা ভর্তি চারটি ট্রাক এলাকায় পৌঁছতেই সেগুলিকে আটকে দেন গ্রামবাসীরা। পুলিশ এসে গাড়িগুলিকে আটকও করে। স্থানীয় সূত্রে খবর, এলাকাবাসীর ক্ষোভের মুখে পড়ে চালকেরা স্বীকার করে নেন, গাড়িগুলি সিকিমের ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকেই এসেছে। তাঁদেরই এক জন শিবা ছেত্রী বলেন, ‘‘সিকিমের ডাম্পিং গ্রাউন্ড থেকেই আবর্জনা আনা হয়েছে। এখানেই তা ফেলার নির্দেশ ছিল। আবার এখান থেকে এই আবর্জনা বিহারে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে।’’

প্রশ্ন উঠেছে, বর্জ্য ফেলার নির্দেশ কে বা কারা দিলেন? এলাকাবাসীদের একাংশের দাবি, যে জমিতে আবর্জনা ফেলা হয়েছে, সেই জমির মালিকই মুনাফার লোভে বর্জ্য ফেলায় অনুমতি দিয়েছেন। জমির মালিক দীপক পাল অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, তিনি কাউকে কোনও অনুমতি দেননি। দীপকের কথায়, ‘‘আবর্জনা ফেলার কোনও অনুমতিই দিইনি। বন দফতর বা রাজ্য সরকারেরও কোনও অনুমতিপত্র পাইনি আমি। বেআইনি ভাবেই বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। আমিই পরিষ্কার করে দেব।’’

বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই সরব হয় বন্যপ্রাণ সংগঠনগুলি। এলাকায় বিক্ষোভও দেখান তাঁরা। বন্যপ্রাণ সংগঠন ‘স্ন্যাপ’-এর কর্ণধার কৌস্তভ চৌধুরী বলেন, ‘‘সিকিম নিজেকে গ্রিন সিটি বলে। কেন্দ্র এর জন্য ওদের কত কত টাকা দেয়! ওরাই এখন ঘরের আবর্জনা অন্য জায়গায় ফেলছে। ওখানে মেডিক্যাল ওয়েস্ট থেকে শুরু করে নানা ধরনের বর্জ্য রয়েছে। এটা নিয়ে আমরা পুলিশ প্রশাসন এবং বনবিভাগকে জানিয়েছি।’’

‘শিলিগুড়ি গ্রিন এনভায়রনমেন্ট প্রিজার্ভেশন সোসাইটি’র সম্পাদক দেবব্রত চক্রবর্তীও বলেন, ‘‘এখানকার এলাকাবাসীই জানিয়েছেন যে, সিকিম থেকে বর্জ্য নিয়ে এসে ফেলা হচ্ছে। কী করে একটা জনবসতি ও বনাঞ্চলের মাঝে একটা ডাম্পিং গ্রাউন্ড গড়ে উঠতে পারে? শিলিগুড়ি এর আগে মারণ জ্বর দেখেছে। এই ধরনের আবর্জনা থেকেই কিন্তু তার জন্ম হয়েছিল। এর জন্য পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনই সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং বন্যপ্রাণীদের।’’

গোটা বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। বৈকুণ্ঠপুর ডিভিশনের এডিএফও রাজীব লামা বলেন, ‘‘ম্যাপ অনুযায়ী জমিটা আমাদের সীমানার বাইরে হলেও তা বন বিভাগের জমির সামনেই। সে ক্ষেত্রে আদৌ কোনও অনুমতিপত্র রয়েছে কি না, আমরা খতিয়ে দেখব। কারণ, ওখানে হাতির করিডর রয়েছে। সেটাই সবচেয়ে চিন্তার।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.