‘এখানেই শেষ নয়’, সত্যি গল্পের সিনেমা বানালেন কলকাতার চিকিৎসক, প্রায় পঙ্গু অভিষেক এখন সুস্থ

সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে হয় তো সারা জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে কাটাতে হত বছর তিরিশের অভিষেক স্বামীকে। বিছানায় পড়ে থাকতে হবে বুঝে মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েছিলেন। সেই জায়গা থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন অভিষেক। চাকরি করছেন। একটা সময়ে নিয়মিত ম্যারাথনে দৌঁড়তেন অভিষেক। পাহাড়ে চড়তেন। সে সব এখন আর না পারলেও হুইলচেয়ারে বসেই কাজে ফিরেছেন। হতাশার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে জীবন ক্রমশ স্বাভাবিকের আলো পাচ্ছে। আর এই গোটা পর্ব নিয়ে ছবি তৈরি করলেন কলকাতার চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তুরি চলচ্চিত্র উৎসবে যাচ্ছে সেই ‘দিস ইজ নট দ্য এন্ড’ নামের স্বল্পদৈর্ঘের ছবিটি।

সিনেমা নয়, অভিষেকের কাহিনির শুরুটা ২০২০ সালে। বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থায় চাকরি করতেন। কিন্তু সেই সংস্থার বেতন অনিয়মিত হয়ে যায় ২০১৬ সাল থেকেই। প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরে এমবিএ পড়া অভিষেক একটি বেসরকারি তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি নিয়ে চলে যান হায়দরাবাদে। করোনার সময়ে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে। বাড়ি অসমের করিমগঞ্জে। নিভৃতবাস পর্ব শেষ হয় ১৮ অগস্ট। আর তার পরের দিনই অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে এক তলার ছাদ থেকে মাটিতে পড়ে যান অভিষেক। মাথায় ও কোমরে চোট নিয়ে ভর্তি হন স্থানীয় হাসপাতালে। চিকিৎসকদের কথায় বুঝতে পারেন সব স্বপ্ন শেষ। আর উঠে দাঁড়ানো যাবে না।

সদ্যই বাবা অবসর নিয়েছেন। বোন তখনও কলেজে পড়ছে। সংসার কী করে চলবে? সেই সব ভাবনাও কি মনে আসত? অভিষেক বললেন, ‘‘আমি তখন কিছুই ভাবার অবস্থায় নেই। খালি একটাই চিন্তা, আর কি কখনও বিছানা থেকে উঠতে পারব না?’’ দিন আটেক পরে করোনাকালের সেই কঠিন পরিস্থিতিতে কলকাতায় আসেন অভিষেক। মল্লিকবাজারের কাছে স্নায়ুরোগ সংক্রান্ত বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। সুষুম্নাকাণ্ডে (স্পাইনাল কর্ড)-এ অপারেশন হন। সে সব ঠিক করে হলেও উঠে দাঁড়ানোর মতো পায়ের জোর ছিল না অভিষেকের। ছিল না মনের জোরও।

অতীত ভুলে বর্তমান নিয়ে এগিয়ে চলতে চান অভিষেক।

এর পরেই শুরু হয় আসল চিকিৎসা। উঠে দাঁড়ানোর লড়াই। সে দিন যে চিকিৎসকের নেতৃত্ব কাজটা হয়েছিল তিনিই এ বার অভিষেকের উঠে দাঁড়ানোর কাহিনিকে সেলুলয়েডে নিয়ে এসেছেন। মিনিট পাঁচেকের ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার কাহিনি। অভিষেক এখন রাজারহাটের বাবলাতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। বহুজাতিক সংস্থায় চাকরিও করেন। বেশিটাই হুইলচেয়ারে করতে হলেও নিজে গাড়িও চালাতে পারেন। তবে সবটাই নিয়ম মেনে। ঠিক যেমন নিয়ম মেনে এখনও তাঁর নতুন করে হাঁটা শেখার চিকিৎসা বা প্রশিক্ষণ চলছে।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর চিকিৎসা পর্ব পরিচালনার পরে সেই কাহিনি নিয়ে ছবির পরিচালনা কেন? সুপর্ণর কথায়, ‘‘অনেক রোগীই আমাদের কাছে আসেন। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু অভিষেকের কাহিনিটা সত্যিই অন্যদের প্রেরণা জোগানোর মতো। একটা দুর্ঘটনা যে এক জন যুবকের স্বপ্ন কেড়ে নিতে পারে না তারই প্রমাণ এই কাহিনি। আশা করি, অনেককে প্রেরণা জোগাবে। তাই তো ছবির নাম ‘দিস ইজ নট দ্য এন্ড’। বোঝাতে চেয়েছি, যে কোনও প্রতিকূলতা কাটিয়েই ফিরে আসা যায়।’’ এই ধরনের চিকিৎসা যে কলকাতাতেও হয় সেটাও এই ছবির মধ্যে দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক সুপর্ণ।

আর এই ছবি নিয়ে কী বলছেন নিজের জীবনের কাহিনি নিয়ে ক্যামেরার সামনে আসা অভিষেক? আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘একটা সময় এই আমি বিছানায় এ পাশ, ও পাশ করতে পারতাম না। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনেও চোট লেগেছিল। ভাঙা শরীরের মতো ভাঙা মনটাও এখন সুস্থ। সবাইকে আমার জীবনের কাহিনি শুনিয়ে বলতে, চাই ভরসা রাখুন। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করান। ফিরে পান জীবন।’’

প্রতিবন্ধকতা পুরোপুরো কাটেনি। এখনও হুইলচেয়ার বা কৃত্রিম পা ব্যবহার করতে হয় হাঁটার জন্য। তবুও সুপর্ণর কথায়, ‘‘অভিষেক এখন স্বনির্ভর। নিজের কাজ নিজেই করতে পারেন। কারও সাহায্য দরকার হয় না।’’ যে টুকু নির্ভরতা তা নিয়েও আফসোস নেই অভিষেকের। বললেন, ‘‘যা রয়েছে তাই নিয়েই আমি সন্তুষ্ট। এখন হয় তো আর পাহাড়ে চড়তে বা আগের মতো সাঁতার কাটতে পারব না। অতীত নিয়ে ভাবিও না। ম্যারাথনে ছোটা হবে না কিন্তু হুইলচেয়ারের ম্যারাথনে তো যোগ দিতে পারব।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.