আইনী পর্যালোচনারও ইঙ্গিত। ৬৫ হাজার মানুষের বিড়ম্বনা মুক্তি। তবে কি কম ক্ষতিকর উপাদান রূপে বিশ্বে স্বীকৃত হতে যাচ্ছে গাঁজা?
গাঁজা অপরাধের শাস্তি থেকে সরে এল আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্ণি জেনারেলকে এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চলতি মার্কিন ফেডারেল আইনে কারাবন্দী সমস্ত মারিজুয়ানা কেসের অপরাধীকে ক্ষমা করে মুক্তি দিতে চাইলেন তিনি। গাঁজা সেবনে অথবা গাঁজা রাখার দায়ে কারো কারাবন্দী হবার সম্ভাবনা দূর হল। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের পুলিশ যখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গাঁজা-কেসে ফাঁসিয়ে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ জোর করে বন্ধ করে দিতে চায়, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে সারাবিশ্বে নতুন চর্চার বিষয় হয়ে উঠলো।
‘আমার জীবনকথা’ গ্রন্থে শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী অভেদানন্দজী গঙ্গোত্রীর পথে যাবার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন (১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবনপঞ্জির পরিচয় তিনি দেন, তা পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়। প্রথম খণ্ডের প্রথম প্রকাশ ১৯৬৪, ২০১৫ সালে ষষ্ঠ সংস্করণের ১৫৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য), “ভাটমারীচটি হইতে দুইটি পথ দুইদিকে গিয়াছে৷ একটি গঙ্গোত্রীর দিকে ও অপরটি যমুনোত্রীর দিকে। আমি ও তুলসী প্রথমে গঙ্গোত্রীর পথে চলিতে লাগিলাম। পথে মাঝে মাঝে চারিদিকে অসংখ্য সিদ্ধিগাছ দেখিলাম। আমরা মুঠা মুঠা শুকনা সিদ্ধিগাছের পাতা লইয়া মাঝেমাঝে খাইতে লাগিলাম — একটু নেশার উদ্রেক হয়।”
নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ৫৪ তম আচার্য শ্রী শ্রী ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়া বাবাজির পরামারাধ্য গুরুদেব ছিলেন শ্রী শ্রী ১০৮ স্বামী দেবদাসজী। জীবন-চরিতে কাঠিয়া বাবাজী লিখছেন, “আমার গুরুদেব একটি ছোট ঝুপড়ির ভিতরে থাকিতেন; আসনে সর্বদা উপবিষ্ট থাকিতেন। …. সাধারণতঃ তাঁহার কোন আহার ছিল না, কেবলমাত্র একবার বিভূতি জলে গুলিয়া পান করিয়া তাহা উদ্গার করিয়া ফেলিতেন এবং চরস ও গাঁজার ধুম সময় সময় পান করিতেন।”
[মহন্ত মহারাজ সন্তদাস বাবাজী ব্রজবিদেহী প্রণীত ব্রজবিদেহী মহন্ত মহারাজ শ্রী ১০৮ স্বামী রামদাস কাঠিয়া বাবাজির জীবন-চরিত, দ্বাদশ সংস্করণ ২০০৯, কাঠিয়া বাবার আশ্রম, সুখচর, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২১]
গাঁজা কি আদৌ খুব ক্ষতিকারক এবং সর্বনেশে ড্রাগ, যাকে মারণ সামগ্রীর তালিকায় ধরতে হবে? নাকি হিন্দু ধর্মের সাধু সন্ন্যাসীরা এই ভেষজ আবহমান কাল ধরে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করতেন বলেই তার উপর নেমে এসেছে বিশ্বব্যাপী এই নিষেধাজ্ঞা? আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ শতাংশ বাড়িতে কেন গাঁজা থাকে? গাঁজা সেবনে তারা কতটা মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত হন? বাংলার সমাজ জীবনে ‘গাঁজা-কেস’ মানে কেন বামপন্থী-কাল থেকে আশ্রিত রাজনৈতিক এক নির্যাতনের নাম? এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসবে। গাঁজা নিয়ে নিরপেক্ষ বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও বক্তব্যই আগামী দিনে বিশ্ববাসী শুনতে চায়৷
গাঁজাগাছকে ড্রাগের লিস্টে জ্বলজ্বল করিয়ে ভগবান শিবকে এবং ভারতীয় সাধুসন্তকে হেয় প্রতিপন্ন করা একটি দীর্ঘ বামপন্থী প্রচেষ্টা। গাঁজাগাছ অবশ্যই ভেষজ গাছ, কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর সিন্থেটিক ড্রাগের সমতুল্য নয়। এই সহজ সত্যটা হয়তো ছড়িয়ে যাওয়ার সময় আসন্ন। গাঁজাগাছকে ওই পর্যায়ে ফেলেছে কাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা সেই ষড়যন্ত্র প্রকাশের দিনও আসন্ন। কিছু ভারতীয় বায়োকেমিস্টদের ধূর্ততা এবার হয়তো ধরে ফেলবেন সদর্থক চিন্তাশীল মানুষ৷ বিশ্বব্যাপী গবেষণা প্রকল্প দাবী করবেন তারা, ডিপ্রেশনের এই অধুনা বিশ্বে সবচাইতে কার্যকরী, সুলভ ওষুধ তৈরি হতে পারে কিনা হিবিসকাস ক্যানাবিস?
ইদানীং একটি বিশেষ ভাবনা আমাদের ক্রমাগত ভাবায়। National Institute of Drug Abuse -এর ওয়েবসাইটে Cannabis নামটি আসার পিছনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে কি? ভারতীয় সরকারি ওয়েবসাইট গুলিতে গাঁজার মতো একটি দরকারি মেডিসিনাল প্ল্যান্ট মোটেই মান্যতার আসনে বহাল নেই। ভারতের শৈব-মাসগুলিতে বিশেষভাবে আমাদের ভাবাচ্ছে। শ্রাবণমাস, চৈত্রমাস শৈব উপাসকদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার মাস, আরাধনার মাস। চৈত্রমাসে গাজন সন্ন্যাসীরা অনন্য কৃচ্ছসাধন করেন। এইমাসেই হয় চড়কপূজা। এই মাসেই হিন্দু মায়েরা তাদের সন্তানদের সার্বিক মঙ্গলের জন্য শিবের উপাসনা করেন নীলপূজার মধ্য দিয়ে।
বহুদিন ধরেই ভগবান শিব সম্পর্কে নঞর্থক একটি ন্যারেটিভ তৈরির সূক্ষ্ম মানসিকতা নিয়েছে বামপন্থী সেকুলার বুদ্ধিজীবী মহল। তারা শিবকে সনাক্তকরণ করেছেন গাঁজাখোর, সিদ্ধি-ভাঙ নেশার এক দেবতা হিসাবে। সারাবিশ্বের বামপন্থী বিজ্ঞানীদের কনসার্ট হয়তো গাঁজার মতো একটি উপকারী ভারতীয় ভেষজ উদ্ভিদকে তালিকাভুক্ত ড্রাগ হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছে। সিন্থেটিক ড্রাগের কুপ্রভাবের বিপ্রতীপে হিবিসকাস ক্যানাবিস-এর মতো এক বিশেষ উপকারী উদ্ভিদকে এক পংক্তিতে ফেলে তারা আসলে ভারতের শৈবসাধনা ও আধ্যাত্মিক জগৎকে কলুষিত করতে চায়। এর পিছনে যতটা না বিজ্ঞান আছে, তার চেয়েও বেশি আছে ইজমে বিশ্বাসী সেকুলার বিজ্ঞানীর ইচ্ছে। এটা হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বিজ্ঞানীরা এইসব কথা বলার জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা নেন কিনা লোকসমাজ এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
চিকিৎসা শাস্ত্রে হিবিসকাস ক্যানাবিস -এর উপযুক্ত ব্যবহার ডিপ্রেশনের মতো একটি ভয়ংকর বিশ্বব্যাধিকে নির্মূল করতে পারে বলে আমাদের ধারণা। তা হয়েও এসেছে বহুকাল। মনঃসংযোগ প্রক্রিয়ায় এক উল্লেখযোগ্য ভেষজ হতে পারে কিছু ভারতীয় উদ্ভিদ, যাদের আমরা এখনও ভয়ঙ্কর ড্রাগ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছি। এই ধারণার সপক্ষে, মতাদর্শের বুলি-কপচানো মানুষদের কথা না মেনে, যুক্তিসঙ্গত গবেষণা শুরু হোক বিজ্ঞানীদের তরফেও। বিশ্বের নানা প্রান্তে এই উদ্ভিদ এবং আরও কিছু ভেষজ যা আধ্যাত্মিক শক্তি-সমন্বিত মানুষেরা ব্যবহার করে এসেছেন হাজার হাজার বছর ধরে, তাদের কার্যকারিতা দেখেছেন, তাদের লোকায়তিক ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করেছেন, তারই সুফলগুলি আজ নতুন করে দেখা দরকার। ভবিষ্যত মেডিসিন হিসাবে এগুলির ব্যবহারে সদর্থক দিকগুলি দেখতে হবে। এবং সর্বোপরি মিথ্যার আবরণ সরিয়ে, যুক্তিজালে শৈবসাধনা ও দর্শনের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে ব্রতী হতে হবে।
বাংলায় ভগবান শিবকে এক পেটমোটা, তিন কন্যা সম্প্রদান করা, অলস-মেজাজের কৃষিদেবতা করে রাখলে সেকুলারদের এবং বিধর্মীদের বিশেষ সুবিধা হয়। যেমন সুবিধা হয় ভগবান কৃষ্ণকে কেচ্ছাকলিতে চুবিয়ে গল্প লেখা হলে। ভগবান শিবের রুদ্ররূপের তাৎপর্য বুঝিয়ে দেবার এবং হিন্দুদের মনে তা জারিত করে দেবার প্রয়োজনে উপযুক্ত কলম ধরার সময় এখন৷ সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য তাই লিখুন, সত্যান্বেষণে সহায়তার জন্য লিখুন। ভগবান শিবকে শ্রদ্ধা জানানোর এর চাইতে মহতী-পুষ্প এই মুহূর্তে আর নেই।
সৌকালীন মাঝি এবং কল্যাণ গৌতম।