কৃষ্ণনগরে নিহত তরুণীর দেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে বৃহস্পতিবার। এখনও সেই রিপোর্ট আসেনি। বৃহস্পতিবার রাতেই নবদ্বীপ শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। তবে খুনের আগে তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না, এখনও সেই প্রশ্নের জবাবে রয়ে গিয়েছে ধোঁয়াশা। প্রথম থেকেই তরুণীর পরিবার দাবি করছে, গণধর্ষণ করে তাঁকে খুন করা হয়েছে। তবে পুলিশের তরফে তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানানো হয়নি। এমনকি, খুন না আত্মহত্যা, তা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছিল। বৃহস্পতিবার কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সৌম্যজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, জীবিত অবস্থাতেই তরুণীর গায়ে আগুন ধরানো হয়েছিল। ময়নাতদন্তে সেই প্রমাণ মিলেছে। তবে তরুণী ধর্ষিতা হয়েছিলেন কি না, তার জবাব এখনও মেলেনি। স্পষ্ট করে তা নিয়ে কিছু জানাননি ওই চিকিৎসক।
ADVERTISEMENT
ওই ঘটনায় তরুণীর প্রেমিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁকে বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করানো হয়েছিল। বিচারক সাত দিনের জন্য তাঁকে পুলিশি হেফাজতে পাঠিয়েছেন। রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, পুলিশ বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে তদন্ত করছে। রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইডি)-এর সাহায্যও নেওয়া হচ্ছে। তবে পুলিশের উপর ভরসা নেই, জানিয়ে দিয়েছেন নিহত তরুণীর বাবা-মা। তাঁরা সিবিআই তদন্ত দাবি করেছেন। তরুণীর মা জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি হাই কোর্টেও যেতে রাজি আছেন। অন্য দিকে, অভিযুক্ত যুবকের পরিবারের দাবি, তিনি নির্দোষ। মঙ্গলবার যুবক সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন তাঁর মা। জানিয়েছেন, বাড়ি ফিরে তাঁর পুত্র ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। বৃহস্পতিবার আদালতে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের দেখে ধৃত যুবকও দাবি করেন, তিনি নির্দোষ। ঘটনাস্থলে তিনি ছিলেন না বলে বার বার দাবি করেছেন ওই যুবক।
বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) এবং এডিজি (সিআইডি)। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও সেখানে গিয়েছিলেন এবং একাধিক নমুনা সংগ্রহ করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া গিয়েছে একটি ঠান্ডা পানীয়ের বোতল। তাতে তরলের অবশিষ্টাংশ পড়ে ছিল। সেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিলেছে দেশলাইয়ের বাক্স এবং কাগজের একটি খালি গ্লাস। সেখান থেকে হাতের ছাপ সংগ্রহ করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। রাতে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তরুণীর দেহ। তাতে পচন ধরতে শুরু করে। দেহ দেখে তরুণীর বাবা সংজ্ঞা হারান। পরে নবদ্বীপের শ্মশানে নিয়ে গিয়ে তরুণীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, মেয়েটির সঙ্গে বেশ কয়েক মাস ধরে সম্পর্ক ছিল অভিযুক্ত যুবকের। ওই যুবক ভিন্রাজ্যে একটি হোটেলে কর্মরত ছিলেন। দুই পরিবারের সম্মতিতে তাঁদের বিয়ে হবে বলেও স্থির হয়। ওই যুবকের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই যেতেন ওই তরুণী। তার পরেও এমন ঘটনা কেন, সেটাই ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের।
সিবিআই চাই
কৃষ্ণনগরে ‘নির্যাতিতা’ তরুণীর মা বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, পুলিশের তদন্তে তাঁদের আস্থা নেই। তাঁরা সিবিআই তদন্ত চান। তিনি বলেছেন, ‘‘গত কাল সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত যে ঘটনাপ্রবাহ দেখেছি, তার পরে আর পুলিশের উপরে আস্থা রাখতে পারছি না। পুলিশ এক জনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এটা এক জনের কাজ হতে পারে না। বাকিদের ব্যাপারে পুলিশের কোনও উৎসাহ নেই কেন?” এর পরেই তিনি বলেন, ‘‘নিরপেক্ষ তদন্ত এবং যথোপযুক্ত সাজার জন্য মেয়ের খুনের তদন্ত করুক সিবিআই। সম্ভবত বৃহস্পতিবারই আইনজীবীর মাধ্যমে কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন জানাব। প্রয়োজনে বাড়ি বিক্রি করে এই লড়াই চালিয়ে যাব।”
কী বলছেন অভিযুক্তের মা?
অভিযুক্ত যুবকের মায়ের দাবি, তাঁর পুত্র নির্দোষ। তিনি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ তাঁর ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসেন। ছেলে তাঁকে জানিয়েছিলেন, তিনি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। এর পর খেয়ে তাঁর ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, দাবি মায়ের। তিনি আরও জানিয়েছেন, রাত ৮টা নাগাদ তরুণীর মায়ের ফোন আসে যুবকের মোবাইলে। তরুণীর মাকে পরে ফোন করার কথা বলেন যুবক। আবার রাত ১০টা নাগাদ ফোন আসে। তরুণীর মায়ের ফোন পেয়ে যুবক বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, জানিয়েছেন তাঁর মা। ঘণ্টাখানেক পর ফিরে আসেন। তার পর শুতে চলে যান।
তরুণীর মায়ের পাল্টা
ধৃত যুবকের মায়ের সমস্ত দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন নিহত তরুণীর মা। তাঁর পাল্টা দাবি, যুবক ফোনে তাঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর কন্যা ওই বাড়িতেই রয়েছেন। যুবকের মায়ের কথায় অসঙ্গতি রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
‘আমি ছিলাম না’
বৃহস্পতিবার ধৃত যুবককে আদালতে হাজির করিয়েছিল পুলিশ। আদালতে প্রবেশের আগে সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। সংবাদমাধ্যমকে অভিযুক্ত জানান, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেনই না। অর্থাৎ, তিনি নির্দোষ। যুবককে বার বার বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আমি ছিলাম না। ওখানে অন্য ছেলে ছিল।’’ অভিযোগ উঠেছে, কৃষ্ণনগরের কলেজ মাঠে ঘটনার রাতে গিয়েছিলেন যুবক। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘কলেজ মাঠে আমরা দু’জন বন্ধু ছিলাম। আর কেউ ছিল না।’’
মুখোমুখি জেরা
যুবকের বাবা-মাকেও একাধিক বার জেরা করেছে পুলিশ। তাঁদের তিন জনকে আলাদা করে একাধিক বার জেরা করা হয়। সেই বয়ান রেকর্ড করে পুলিশ। তার পর তিন জনকে মুখোমুখি বসিয়েও একই প্রশ্ন করা হয়। এ ভাবে বয়ান মিলিয়ে দেখেন তদন্তকারীরা।
ময়নাতদন্ত সম্পন্ন
কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালে বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগরের তরুণীর দেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ময়নাতদন্তের সময় উপস্থিত ছিলেন। এখনও সেই রিপোর্ট জানা যায়নি।
কী বললেন চিকিৎসক
এত দিন জল্পনা ছিল, খুনের পর প্রমাণ লোপাটের জন্য তরুণীর গায়ে অ্যাসিড ঢেলে পোড়ানো হয়েছিল। নিহতের পরিবারও সেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জেএনএম হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে জানান, জীবিত অবস্থায় তরুণীর গায়ে আগুন ধরানো হয়েছিল। ময়নাতদন্তে তেমনই প্রমাণ মিলেছে। অ্যাসিড ঢালার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরও কিছু পরীক্ষা বাকি আছে বলে জানান ওই চিকিৎসক। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের আরও কিছু কাজ বাকি আছে। সব কাজ মিটলে তদন্তকারী আধিকারিককে আমরা জানিয়ে দেব। অ্যাসিডে পোড়ানোর কোনও প্রমাণ আমরা পাইনি। যা পেয়েছি, তা ‘অ্যান্টিমর্টেম বার্ন’ (জীবিত অবস্থায় পোড়া)।’’
ধর্ষণ রহস্য অধরাই
কী ভাবে তরুণীকে খুন করা হয়েছিল, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের বক্তব্যে তার একটা ইঙ্গিত মিললেও খুনের আগে আদৌ তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না, তরুণী গণধর্ষিতা হয়েছিলেন কি না, সেই রহস্য এখনও অধরা। তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রসঙ্গে ময়নাতদন্তকারী ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘কিছু রাসায়নিক পরীক্ষা আমাদের এখনও বাকি আছে। তা না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারছি না। আগুনে পুড়ে গেলে এমনিতেই দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে ক্ষরণ হয়। আমরা সে সব সংরক্ষণ করেছি।’’
কী বললেন এডিজি?
বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগরের ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম এবং এডিজি (সিআইডি) সোমা দাস। সাংবাদিক বৈঠক করে সুপ্রিম জানান, কৃষ্ণনগরকাণ্ডে সিট (বিশেষ তদন্তকারী দল) গঠন করেছে রাজ্য পুলিশ। ওই ঘটনার তদন্তে সিআইডির সাহায্যও নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের উপর তরুণীর পরিবারের অনাস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘পরিবার এখন শোকগ্রস্ত। তারা সন্তান হারিয়েছে। এটি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। তাঁদের দাবির প্রতি আমাদের পূর্ণ মর্যাদা রয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মৃত্যুর সঠিক কারণ কী, তা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট যত ক্ষণ হাতে না আসছে, তত ক্ষণ নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তদন্ত চলছে।’’ এর পরেই সুপ্রতিম জানান, এই ঘটনার তদন্তের জন্য সিট গঠন করা হয়েছে। সিটের নেতৃত্বে রয়েছে কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার অমরনাথ কে। তিনি বলেন, ‘‘ঘটনার নেপথ্যে সব সম্ভাব্য কারণ আমরা খতিয়ে দেখছি। সিআইডির সাহায্য নিচ্ছি। ঘটনাস্থলে এডিজি (সিআইডি) এসেছেন দল নিয়ে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞেরা এসেছেন। আমরা আশাবাদী, সত্য প্রকাশ পাবে।’’
ঘটনাস্থল থেকে কী কী উদ্ধার?
ঘটনাস্থলে বৃহস্পতিবার গিয়েছিল ফরেন্সিক দল। সেখান থেকে পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের উপস্থিতিতে একাধিক নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পাওয়া গিয়েছে প্লাস্টিকের তৈরি একটি ঠান্ডা পানীয়ের বোতল। সেই সঙ্গে ফাঁকা কাগজের গ্লাস এবং স্বল্প ব্যবহৃত দেশলাই উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞেরা। সংগ্রহ করা হয়েছে, বোতলে থাকা তরলের নমুনাও।
বোতলে কি কেরোসিন?
ঘটনাস্থল থেকে যে প্লাস্টিকের বোতলটি পাওয়া গিয়েছে, তাতে তরলের অবশিষ্টাংশ ছিল। সেই তরলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। কী ভাবে তরুণীর গায়ে আগুন ধরানো হয়েছিল, কেরোসিন ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাই ওই বোতলের তরল আসলে কী, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, বোতলে কেরোসিন ছিল কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
হাহাকার বাবার
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগরে তরুণীর দেহ নিয়ে আসা হয়। দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর বাবা। তার পরেই জ্ঞান হারান। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। পরে কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় তরুণীর দেহ। সেখানে রাত ৮টা নাগাদ শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, গঙ্গার ধারের শ্মশানে মৃতার শেষকৃত্য করতে কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপে দেহ নিয়ে যাওয়া হয়।