ধূলিকণা উড়িয়ে বিশাল সৈন্যদল আসতে দেখে লক্ষ্মণ ভাবলেন ভরত তাঁদেরকে আক্রমণ করতে আসছেন। কিন্তু শ্রীরাম তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে ভরত আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসতে পারেন না।
ভরত শ্রীরামের সঙ্গে দেখা করে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। শ্রীরাম জানকী ও লক্ষ্মণকে পর্ণকুটিতে থাকতে দেখে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হন। শ্রীরামকে অযোধ্যায় ফিরে যেতে অনুরোধ মিনতি করেন। শ্রীরাম আবার ভরতকে সান্তনা দেন। ভরত শ্রীরামকে পিতা দশরথের ইহলোক ত্যাগের সংবাদ জানান। তাদের পিতা রাজা দশরথ তাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তারা অত্যন্ত দুঃখিত হয় এবং সকলে মিলে বিলাপ করে।
পিতার জন্য তাঁরা জলাঞ্জলি দান, পিন্ড দান প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রীরাম তার পিতার সমস্ত শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।
ভরত বারবার শ্রীরামকে অযোধ্যায় গিয়ে রাজ্য পরিচালনা করার জন্য অনুরোধ করেন এবং শ্রীরাম বারবার ভারতকে বোঝাতে থাকেন। শ্রীরাম বলেন, “সঞ্চয়ের শেষ হয় ব্যয়ে। পার্থিব উন্নতির শেষও হয় অধঃপতনে। কাকতালীয় সমাপ্তি বিচ্ছেদ এবং জীবনের শেষ মৃত্যু। (অর্থাৎ আসল সত্য জানা উচিত, বাকিটা মায়া)”
সর্বে ক্ষয়ান্তাঃ নিচয়াঃ পতনান্তা সমুচ্ছ্রায়ঃ।
সংযোগা বিপ্রয়োগন্তা মারাণান্তং চ জীবিতম্ ।।১৬॥
(অযোধ্যা কান্ড/শতং পঞ্চমম্ সর্গ)
“অতএব রাজা দশরথের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করে রাজ্য পরিচালনায় মনোনিবেশ করাই সঙ্গত হবে।”
এভাবে নানা যুক্তি দিয়ে, বোঝানোর পর শ্রীরাম ভরতকে অযোধ্যায় যেতে বলেন। ভরত তার কাছে একটাই মিনতি করেন – “শ্রীরাম দাঁড়িয়ে আমার, শ্রীরামের চরণ পাদুকা।”
ভরত বলেন,”আমি আপনার এই চরণ পাদুকা অযোধ্যার সিংহাসনে রেখে আপনার সেবক হয়ে রাজকাজ পরিচালনা করব। আপনি এই রাজ্যের অধিকারী। চৌদ্দ বছর পর ফিরে এসে আপনি এই রাজ্য পুনঃগ্রহণ করবেন।”
কোশল জনপদে ফিরে গিয়ে সেই চরণ পাদুকা অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়ে পাদুকাদের রাজ্যাভিষেক করেন এবং শ্রীরামের প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যের বিষয়গুলি দেখাশুনা করতে থাকেন।
ভরতের প্রস্থানের পর, শ্রীরাম চিত্রকূটে দেখেন যে সেখানকার তপস্বীরা চিন্তিত, ব্যথিত এবং বেদনাগ্রস্ত। কেউ কেউ চিত্রকূটও ছেড়েছেন। শ্রীরাম জিজ্ঞেস করলে ঋষি তাঁকে বলেন, ‘এখানে অসুরদের বড় আতঙ্ক। রাবণ এই সন্ত্রাসের মদতদাতা। এই এলাকায়, বনাঞ্চলে রাবণের ছোট ভাই ‘খর’ হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসের নায়ক। বিশেষ করে আপনার এখানে আগমন সংবাদে, খর এবং অন্যান্য রাক্ষস তান্ডব করছে। যাগ-যজ্ঞ শুরু হওয়ার সাথে সাথে তারা যজ্ঞকুণ্ডে জল ছিটিয়ে দেয় এবং হবন সামগ্রী নষ্ট করে।
রাবণবরজঃ কশ্চিৎ খরো নামঃ রাক্ষসঃ।
উৎপাট্য তাপসন্সর্বাঞ্জনস্থাননিকেতনান্।।১১।।
(অযোধ্যা কান্ড/শতং ষোড়শতম সর্গ)
এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে সেই ঋষিদের দল আশ্রম ত্যাগ করছে।
শ্রীরাম ভাবেন কিভাবে এই অসুর শক্তির মোকাবিলা করা যায়। যেহেতু এখন এই এলাকায় মুনি-ঋষিরা বাস করেন না, তাই এটা নিশ্চিত যে খর এবং তার রাক্ষস দল এখানে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে আসবে না। তাই, শ্রীরাম নিজে জানকী এবং লক্ষ্মণকে নিয়ে সেই আশ্রম ছেড়ে আরও দেশান্তরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
সেখান থেকে তাঁরা ঋষি অত্রির আশ্রমে পৌঁছায়। তারা তিনজনই ঋষি অত্রি ও সতী অনসূয়ার আশীর্বাদ কামনা করেন। মা অনসূয়া সীতাকে স্বাগত জানান।
সেখানে কিছু সময় কাটানোর পর তিনি ঋষিদের কাছ থেকে পরের ভ্রমণ গন্তব্যে অনুমতি চান। ঋষিরা তাঁদের বলেন, ‘এই বনের পথে ভয়ঙ্কর ও ক্রুর দানবদের আতঙ্ক। সুতরাং তোমরা উভয় ভাই, ঐ দুষ্ট আত্মাদের এখান থেকে তাড়িয়ে দাও।’
শ্রীরাম ভাবতে বাধ্য হন । অযোধ্যার বাইরে যেখানেই গিয়েছেন, সবখানেই দেখেছেন অসুরের আতঙ্ক। মনে হয় যেন এই আতঙ্কের অন্ধকার ছায়া গোটা আর্যাবর্ত জুড়ে আছড়ে পড়ছে।
ঋষি অত্রির আশ্রম ত্যাগ করে তিনি শ্রীরাম, জানকী ও লক্ষ্মণকে নিয়ে দণ্ডকারণ্য নামক ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করতে লাগলেন। ঋষি ও তপস্বীরাও এই বনে বাস করেন। শ্রীরাম ও জানকীকে দেখে মুনি-ঋষিগণ পরম শ্রদ্ধায় তাঁদের কাছে আসেন। সেই তপস্বীরা শ্রীরাম, জানকী ও লক্ষ্মণকে আশীর্বাদ করলেন।
শ্রীরাম, জানকী এবং লক্ষ্মণ, এই ঋষিদের আশ্রমে রাতের জন্য বিশ্রাম করেন এবং তারপর তাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু করেন। এরপর তারা ‘বিরাধ’ নামে এক রাক্ষস, যে ঋষিদের রক্ত পান করে। এই দানব সীতাকে তুলে দৌড় দিলে, শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ তাঁকে আক্রমণ করলেন। যে হাত দিয়ে তিনি সীতাকে তুলেছিলেন সেই দুই হাতই তিনি কেটে ফেললেন। তবুও মারা না যাওয়ায় অসুর বিরাধ তপস্যা করে বিশেষ সাফল্য লাভ করেছিলেন। তাই, লক্ষ্মণ মাটিতে একটি বড় গর্ত তৈরি করে, যেখানে শ্রীরাম এই রাক্ষস বিরাধকে সমাধি দিয়ে শেষ করেন।
বিরাধকে হত্যা করার পর শ্রীরাম, জানকী ও লক্ষ্মণ ঋষি শরভঙ্গের আশ্রমে পৌঁছেন। শ্রীরামের সান্নিধ্যে শরভঙ্গ মুনি প্রাণ উৎসর্গ করেন। তাঁরা এই মুহূর্তে শ্রীরামের জন্য অপেক্ষা করছিল।
শরভঙ্গ মুনি ব্রহ্মলোকে যাওয়ার পর সেই আশ্রম ও আশেপাশের অনেক ঋষি ও বানপ্রস্থি শ্রীরামের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
অব্যং বায়ং ন মৃষ্যামো বিপরকরংতাপস্বিনাম্।
ক্র্যমানম বনে ঘোরং রক্ষোভির্ভীমকর্মভিঃ* ।।১৮।।
(আরণ্যকাণ্ড/ষষ্ঠ সর্গ)
এই সমস্ত তপস্বী মুনি-ঋষিরা রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য শ্রীরামকে অনুরোধ করছেন।
সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে শ্রীরাম, জানকী ও লক্ষ্মণ একত্রে সুতীক্ষ্ণ আশ্রমে পৌঁছান। সেখানে এক রাত অতিবাহিত করেন। পরের দিন আবার দণ্ডকারণ্যে অভিবাসন শুরু হয়। সীতা শ্রীরামকে ‘নিরীহ প্রাণীদের হত্যা না করার এবং অহিংসার ব্রত অনুসরণ করার’ অনুরোধ করেন।
এই বিষয়ে শ্রীরাম জনকানন্দিনী সীতাকে ব্যাখ্যা করলেন। ‘নিরীহ প্রাণীকে হত্যা না করাই তাদের জীবনের মূল্য। কিন্তু ক্ষত্রিয়রা ধনুক ধারণ করে যাতে কোন দুঃখী বা সমস্যায় পড়লে তাদেরকে রক্ষা করতে পারে।
“বিশেষ করে দণ্ডকারণ্যে বসবাসকারী এবং কঠোর ব্রত পালনকারী সমস্ত সন্ন্যাসীরা এই সমস্ত আসুরিক শক্তির কারণে চরম দুর্ভোগের মধ্যে জীবনযাপন করছে। আমি এই সমস্ত অসুর শক্তিকে নির্মূল করার অঙ্গীকার করেছি।”
এই রাক্ষসদের দেখে ভীত হয়ে ঋষিগণ মনে মনে বললেন, “হে শ্রীরাম, দণ্ডকারণ্যে অনেক ছদ্মবেশী অসুর বাস করে যারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী রূপ ধারণ করে। তারা আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক কষ্ট দিচ্ছে। তাই দয়া করে তাদের ভয়াল অত্যাচার থেকে আমাদের রক্ষা করুন।
কিম্ করোমিতি চ ময়া ব্যহৃতং দ্বিজসন্নিধৌ।
সর্বরেতৈস্সমাগম্য বাগিয়ং সুমুদাহর্তা ॥১০॥
রাক্ষসৈর্দন্ডকারণ্যে বহুভিঃ কামরূপিভিঃ।
অর্দিতাস্ম দৃঢ় রাম ভবান্নস্তত্র রক্ষতু ॥১১॥
(অরণ্য কান্ড/দশম সর্গ)
দণ্ডকারণ্যে যাওয়ার সময়, শ্রীরাম, জানকী এবং লক্ষ্মণ পম্পাসর তীর্থে গিয়েছিলেন। এই তিনজন ঋষিদের আশীর্বাদ নিয়ে বিভিন্ন আশ্রমে ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন।
কালচক্র ঘুরছিল আপন গতিতে…!
কোথাও দশ মাস, কোথাও সারা বছর; কোথাও সাত মাস, কোথাও দেড় বছর। এই কাজ করতে গিয়ে শ্রীরাম, জানকী ও লক্ষ্মণ দশ বছরেরও বেশি সময় দণ্ডকারণ্যে অতিবাহিত করেন।
এই সমগ্র স্থানে অবস্থানের সময়, শ্রীরাম ঋষি ও সাধারণ মানুষদের কষ্ট অনুভব করেন, যারা আসুরিক সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে, সর্বত্র নানা পৈশাচিক শক্তির সন্ত্রাস ইত্যাদি কিন্তু সুদূর দক্ষিণে বসে থাকা লঙ্কার শাসক রাবণ মদতপুষ্ট। এটা সরাসরি দেখা বা সহ্য করা যায় না। আর্যাবর্ত জুড়ে তাঁর আতঙ্ক স্থাপন করে আতঙ্কিত রেখেছেন।
সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে সেই আতঙ্কবাদিদের হত্যা করতে হবে। কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের প্রদত্ত আদেশ অনুসারে আর্যাবর্তকে নিষ্কন্টক করতে হলে রাবণের বিনাশ অনিবার্য।
মা কৈকেয়ী প্রদত্ত এই নির্বাসনের সুখী ফল হল সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দু প্রকাশ্যে এসেছে। আর জীবনের পরবর্তী লক্ষ্যও ঠিক করা হয়েছে- রাবণকে ধ্বংস করা..!
সমস্যা হল রাবণ এগিয়ে আসছে না। তার মোকাবেলা করা প্রয়োজন। তাই শ্রীরাম মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে রাবণ যদি এগিয়ে না আসে তবে তাকে আহ্বান করে, যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করবে শ্রীরাম।
প্রশান্ত পোল।
ক্রমশ