স্বামীজীর চরিত্র চিত্রাঙ্কন অনেকেই করেছেন। তবে সিস্টার নিবেদিতা এবং শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর চিত্রাঙ্কনে বিবেকানন্দকে আমরা যেভাবে পাই আর কারও নিকট তা পাই না। কারণ বিবেকানন্দকে তাঁরা কেবল পর্যবেক্ষণই করেন নি, তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি পা ফেলাকে নিরীক্ষণ করেছেন তাঁরা। যে চোখে তাঁরা স্বামীজীকে দেখেছেন, যে উচ্চভাবে, অনুপম ভাষায় তা প্রকাশ করেছেন, আর কেউ বোধহয় তা পারেন নি। তাঁদের মধ্যে তাই বিবেকানন্দ যেভাবে প্রতিভাত হয়ে আছেন, তা যদি দেখা না হয়ে থাকতো, হয়তো সেই সমূদয় অনুভব অজানাই থেকে যেতো। অতএব স্বামীজীর কালীভাবনার অনুসন্ধানের মধ্যে যে তাঁদেরও যথাযথ ভাব-অনুভব উপলব্ধি করা সম্ভব হবে, তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি এই অনুসন্ধানের মধ্যে আমরা তাঁদের নিজস্ব ভাবনাও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো।
প্রস্তুত আলোচনার শুরুতে ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’ গ্রন্থে শরচ্চন্দ্র-বিবৃত স্বামীজীর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৯০১ সালে দুর্গোৎসবের পর স্বামীজী বেলুড় মঠে প্রতিমা আনিয়ে শ্যামাপূজা যথাশাস্ত্র নির্বাহিত করেছিলেন। এই পুজোর পর স্বামীজী ১৯০১ সালের নভেম্বর মাসে আপন গর্ভধারিণীর নির্বন্ধাতিশয়ে তাঁর সঙ্গে কালীঘাটে গিয়ে তাঁরই বহুপূর্বে মানত করা পূজাটি সম্পন্ন করিয়ে দেন।
শরচ্চন্দ্রের লেখাতে পাই, বাল্যকালে স্বামীজী একবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হন। তখন মা ভুবনেশ্বরী দেবী মানত করেন, আদরের বিলে আরোগ্যলাভ করলে নিজে কালীঘাটে পুত্রকে নিয়ে গিয়ে বিশেষ পূজা দেবেন এবং মন্দির চত্বরে গড়াগড়ি দিইয়ে নেবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি এবং পরিবারের অন্যান্যরা তা একদম বিস্মৃতই হয়ে যান। শেষজীবনে স্বামীজী যখন প্রচণ্ড অসুস্থ, মায়ের স্মরণে আসে সেই পূর্বেকার মানতের কথা। মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন, মঠে খবর পাঠান তিনি। স্বামীজী মায়ের ডাকে সাড়া দিলেন। মায়ের সঙ্গে কালীঘাটে গিয়ে কালীগঙ্গায় স্নান করে ভেজা পোষাকে মন্দিরে প্রবেশ করলেন তিনি। শরচ্চন্দ্রের লেখায় পাই, “…মন্দিরের মধ্যে শ্রীশ্রীকালীমাতার পাদপদ্মের সম্মুখে তিনবার গড়াগড়ি দেন। তৎপরে মন্দির হইতে বাহির হইয়া সাতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। পরে নাটমন্দিরের পশ্চিমপার্শ্বে অনাবৃত চত্বরে বসিয়া নিজেই হোম করেন। অমিত বলবান তেজস্বী সন্ন্যাসীর সেই যজ্ঞসম্পাদন দর্শন করিতে মায়ের মন্দিরে সেদিন খুব ভিড় হইয়াছিল।…জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুনঃপুনঃ ঘৃতাহুতি প্রদান করিয়া সেদিন স্বামীজী দ্বিতীয় ব্রহ্মার ন্যায় প্রতীয়মান হইয়াছিলেন।” এই আলোচনার শেষে শরচ্চন্দ্র লিখলেন স্বামীজীর সেই দীপ্ত ঘোষণার কথা, “I have come to fulfill and not to destroy.” আমি শাস্ত্রমর্যাদা নষ্ট করিতে আসি নাই, পূর্ণ করিতে আসিয়াছি। যাঁরা স্বামীজীকে শুধুমাত্র বেদান্তবাদী বা ব্রহ্মজ্ঞানী বলে নির্দেশ করেন, এই পূজানুষ্ঠান তাঁদের বিশেষরূপে ভাবিয়ে তুলেছে। জীবনের শেষভাগে এসে স্বামীজী হিন্দুর অনুষ্ঠেয় পূজাপদ্ধতির প্রতি আন্তরিক ও বাহ্য সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। এই কথাটি নিবেদিতার কলমেও পরিস্কারভাবে ফুটে উঠল ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি’ গ্রন্থে।
নিবেদিতা লিখলেন, স্বামীজীর শক্তিপূজার উল্লেখ ছাড়া তাঁর বিবরণ নিতান্তই অসম্পূর্ণ। যে স্বামীজীর কাছে ব্রহ্ম সাক্ষাৎকারই একমাত্র লক্ষ্য, অদ্বৈতদর্শন সর্বোত্তম মতবাদ, এবং বেদ ও উপনিষদ একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ; সেই স্বামীজীর মুখেই সবসময় লেগে থাকতো জগন্মাতাবোধক ‘মা’, ‘মা’ শব্দ। পারিবারে অত্যন্ত পরিচিত কারো সম্পর্কে যেমন কথা বলা হয়, জগন্মাতাকে স্বামীজী ঠিক সেই ভাবেই উল্লেখ করতেন, সবসময় তাঁর চিন্তাতেই তন্ময় থাকতেন। শুভ অশুভ যা ঘটুক সকলই যেন জগন্মাতার ইচ্ছায় সম্পন্ন হচ্ছে, আর কেউ দায়ী নন।
১৮৯৮ সালের আগষ্ট মাসে ভগিনী নিবেদিতা কাশ্মীরের ক্ষীর ভবানী মন্দির দর্শন করেছিলেন স্বামীজির সঙ্গে। দর্শন শেষে তিনি দেখেছিলেন স্বামীজির তুরীয় অবস্থা, এক প্রগাঢ় মানসিক অভিভব। সেই মৌলিক ভাবপ্রেরণায় ওই বছর সেপ্টেম্বরে লিখলেন উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শাক্ত কবিতা মৃত্যুরূপা মাতা, ‘ Kali the Mother’. তারপর এক এক করে লিখে চললেন মৃত্যুরূপা কালীর কথা; ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’, ‘My play is done’, ‘Who knows how Mother plays’. ঠিকই তো! জগজ্জননীর অনন্তলীলার কে কবে তল পেয়েছে? “কেবা সে পামর দুঃখে যার ভালবাসা?” হৃদয়কে শ্মশান করে তুলে, স্বার্থ-সাধ-মানকে চূর্ণ করে সেখানে নাচাতে চান শ্যামা-মাকে। মৃত্যু, অন্ধকার, সংগ্রাম ও দুঃখচেতনার অন্তর্নিহিতি জারিত করেছিল ভগিনীকেও। নিবেদিতার বর্ণনায় পাই, এক শিষ্যকে স্বামীজী একটি মাতৃ-প্রার্থনা শিখিয়ে দিয়ে বলছেন, মায়ের কাছে দীনহীন ভাব চলবে না। কেবল প্রার্থনা নয়, মা’কে জোর করে তা করাতে হবে৷ নিবেদিতা উল্লেখ করেছেন, মা কালীর চিন্তা করতে করতে স্বামীজী বলে উঠতেন, “তাঁর শাপই বর।” মায়ের ডান হাত বরাভয় প্রদানের জন্য উত্তোলিত, বামহাতে ধৃত খড়গ। বলতেন, “আমি ভয়ঙ্করা রূপের উপাসক।” শিষ্যদের মতামত চাপিয়ে না দিয়েও স্বামীজী আহ্বান করতেন, ভয়ঙ্করা মায়ের জন্যই যেন আমরা তাঁর ভয়ঙ্করা মূর্তির উপাসনা করি। বলতেন, এটা ভুল ধারণা যে, সকলেই সুখের আশায় কর্মে প্রবৃত্ত হন, বহুলোক জন্মাবধি দুঃখকে খুঁজে বেড়ান। তাঁরা আজন্ম মায়ের অসি-মুণ্ড বরাভয় মূর্তির উপাসক। ভাবাবেগে বলতেন, “অন্তরঙ্গ ভক্তগণের নিভৃত হৃদয়কন্দরে মায়ের রুধিররঞ্জিত অসি ঝকমক করে।” এই ভাবনা পোষণ করতেন ব’লেই স্বামীজী লিখতে পেরেছিলেন মৃত্যুরূপা মাতা, Kali the Mother, “Who dares misery love,/And hug the form of Death,/Dance in Destruction’s dance,/To him the Mothet comes.” (সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,/কাল-নৃত্য করে উপভোগ,/মাতৃরূপা তারি কাছে আসে)। এ যে ভয়ঙ্করের পুজো! এ মৃত্যুর পুজো, এ যে কাপুরুষের আত্মহত্যা নয়! এ যে শক্তিমানের মৃত্যু সম্ভাষণ! তাঁর ভাষা কঠোর, “জীবন না চাহিয়া মৃত্যুকে অনুসন্ধান করিতে হইবে, নিজেকে তরবারিমুখে নিক্ষেপ করিতে হইবে, চিরকালের জন্য ভয়ঙ্করা মূর্তির সহিত একাত্ম হইতে হইবে।” ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীরা তাঁর এই ভাব গ্রহণ করেই শক্তিমান হয়েছিলেন।
একবার নিবেদিতা মন্দিরের পশুবলি সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে স্বামীজীর কাছে উপস্থিত হলেন। বিরুদ্ধ যুক্তিগুলি শুনে স্বামীজী স্পষ্টভাবে উত্তর দিলেন, “চিত্রটি নিঁখুত করবার জন্য হলোই বা একটু রক্তপাত!” ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’-এও শরচ্চন্দ্রকে তিনি বলছেন (১৯০১ সালে), “এবার ভাল হয়ে মাকে রুধির দিয়ে পুজো করব! রঘুনন্দন বলেছেন, নবম্যাং পূজয়েৎ দেবীং কৃত্বা রুধিরকর্দমম– এবার তাই করব। মাকে বুকের রক্ত দিয়ে পুজো করতে হয়। তবে যদি তিনি প্রসন্না হন। মার ছেলে বীর হবে — মহাবীর হবে! নিরানন্দে, দুঃখে, প্রলয়ে, মহাপ্রলয়ে মায়ের ছেলে নির্ভীক হয়ে থাকবে।”
শরচ্চন্দ্রের বর্ণনায় আছে, এক অমাবস্যায় কালীপূজার দিন বেলুড় মঠে জানালা দিয়ে পূর্বাকাশে তাকিয়ে অন্ধকারের অদ্ভুত গম্ভীর শোভা আর তিমিররাশি দেখতে দেখতে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন স্বামীজী। গাঢ় তিমিরাবগুণ্ঠিত বহিঃপ্রকৃতির নিস্তব্ধতা স্বামীজীর মধ্যে আনলো এক অদৃষ্টপূর্ব গাম্ভীর্য। এই আবহে স্বামীজী ধীরে ধীরে গাইতে লাগলেন, “নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে অরূপরাশি।” আর বলতে লাগলেন, মা, মা, কালী, কালী। পরে গাইলেন, “কখন কি রঙ্গে থাক মা শ্যামা সুধা-তরঙ্গিণী।” সঙ্গীত শেষ করে সেদিন শিষ্যকে বললেন গভীর তাত্ত্বিক কথা, “এই কালীই লীলারূপী ব্রহ্ম। ঠাকুরের কথা, সাপ চলা, আর সাপের স্থির ভাব।”
নিবেদিতার কাছে স্বামীজী স্বীকার করেছেন, “মা-কালী ও তাঁর লীলাকে আমি কি ঘৃণাই করেছি! ছ-বছর ধরে ঐ নিয়ে সংগ্রাম করেছি, কিছুতেই তাঁকে মানব না। শেষে কিন্তু আমাকে মানতেই হলো! শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আমাকে তাঁর কাছে উৎসর্গ করেছিলেন, আর এখন আমি বিশ্বাস করি, অতি সামান্য কাজেও সেই মা আমাকে পরিচালনা করছেন, আমাকে নিয়ে যা,খুশি তাই করছেন!” কেন তাঁকে মানতে হলো, তা অত্যন্ত গুহ্য ব্যাপার, জীবনে কাউকে তা বলেন নি। তখন তাঁর ‘অতি দুঃসময়’, ‘মা সুবিধা পেলেন’, তাঁকে গোলাম করে ফেললেন। ঠাকুরও যে তাঁকে মায়ের হাতেই সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। ঠাকুরের নিজ মুখে কথা, ‘তুই মায়ের গোলাম হবি।’
স্বামীজীর মতে ভাবীযুগ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসকে মা-কালীরই অবতার বলবে। মা তাঁর নিজ প্রয়োজন সিদ্ধির উদ্দেশ্যে শ্রীরামকৃষ্ণশরীরে আবির্ভূতা হয়েছিলেন। নিবেদিতা লিখেছেন, “আমার ক্ষুদ্র বিদ্যালয়টি আরম্ভ হয় কালীপূজার দিন। শ্রীশ্রীমা স্বয়ং প্রতিষ্ঠাকালীন পূজাদি সম্পন্ন করিলেন। পূজান্তে তিনি মৃদুস্বরে বিদ্যালয়ের ভাবী ছাত্রীগণের উদ্দেশ্যে আশীর্বাণী করিলেন; গোলাপ-মা স্পষ্ট করিয়া উহা সমবেত সকলকে শুনাইয়া দিলেন, ” শ্রীশ্রীমা প্রার্থনা করছেন, যেন এই বিদ্যালয়ের ওপর জগন্মাতার আশীর্বাদ বর্ষিত হয়, এবং এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েরা যেন আদর্শ বালিকা হয়ে ওঠে।”
স্বামীজীর কাছ থেকে বহুপূর্বে নিবেদিতা শুনেছিলেন, “ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের অস্পষ্ট কুহেলিকার মধ্যে দিয়ে দেখলে নির্গুণ ব্রহ্মই সগুণরূপে প্রতিভাত হন।” ব্রহ্ম ও কালী বিষয়ে বহু আলোচ্য বিভেদের মীমাংসা পাই স্বামীজীর আরও একটি কথায়, “কোথাও এমন এক মহাশক্তি আছেন, যিনি নিজেকে প্রকৃতি-সত্তা বলে মনে করেন। তাঁরই নাম কালী, তাঁরই নাম মা! … শরীর মধ্যস্থিত অসংখ্য কোষ (cells) মিলিত হয়েই এক ব্যক্তি সৃষ্টি করে না কি? এক নয়, বহু মস্তিষ্ককেন্দ্রই কি মনের অভিব্যক্তি ঘটায় না? বহু বৈচিত্র্যের মধ্যেই একত্ব — এই আর কি! তবে ব্রহ্মের বেলায় অন্যরূপ হবে কেন? ব্রহ্মই একমাত্র সৎ পদার্থ, তিনি অদ্বিতীয়, কিন্তু তিনিই আবার দেবদেবীতে পরিণত!”
স্বামীজীর মতে মা যেন একখানি মহাগ্রন্থ; মা-কালীই হবেন ভারতের ভাবীযুগের বংশধরের একমাত্র উপাস্য। তাঁকে পাঠ করে মাতৃভক্তগণ নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন, এবং তাঁর নাম নিয়ে অভিজ্ঞতার শেষ সীমায় উপনীত হবেন৷ স্বামীজীর এই মাতৃ-ভাবনাকে নিবেদিতা গ্রহণ করেছেন। গীতার শ্লোক ব্যাখ্যা করে তাই তিনি বলেছেন, কর্ম আরম্ভ না করে কোন ব্যক্তি নৈষ্কর্ম্য লাভ করতে পারেন না। অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই অন্তিমে সত্যের সাক্ষাৎকার ঘটে। শক্তির মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মে উপনীত হতে হয়। নতুন জীবন, নতুন নতুন জ্ঞান, অসংখ্য পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই আমরা আত্মারূপী চিরধামে পৌঁছে যাই। সেখানে সবটাই এক অখণ্ড সত্তা উপস্থাপিত, এক পরিপূর্ণ শান্তি। স্বামীজীর সঙ্গে নানান আলোচনা, কথাবার্তা ও ভাষণ, কালীমূর্তির ব্যাখ্যা উপলব্ধি করে নিবেদিতার ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, স্বামীজী জীবনচর্যায় এবং মানসচর্চায় অভিজ্ঞতারূপ মহাগ্রন্থের পাতাগুলি উল্টিয়ে গেছেন, যে মহাগ্রন্থটিই আসলে মা-কালী, এবং গ্রন্থের শেষ শব্দটি পড়া হওয়ামাত্র তিনি চলার ক্লান্তিতে শ্রান্ত শিশুর মতো মা-কালীর ক্রোড়ে শয়ন করে মহাসমাধিতে মগ্ন হয়েছেন। এই সমাধিতে, আপনার শুভ মুহূর্ত উদয়ের কালে তাঁর জ্ঞান হয়েছে, এই অনন্ত বৈচিত্র্যময় জীবন স্বপ্নমাত্র।
১৮৯৯ সালের নভেম্বরে স্বামীজির সঙ্গে পাশ্চাত্যে যাত্রাকালে নিবেদিতা গভীরভাবে জেনে নিয়েছিলেন কালীদর্শন। আর তিনিও লিখলেন, ‘Kali the Mother’, এ যেন মনোময়ী কালী, একেবারেই নিবেদিতার নিজস্বতার ছোঁয়ায়। তার আগেই স্বামীজি নিবেদিতাকে দিয়ে বঙ্গদেশে কালীতত্ত্ব প্রচার করিয়ে নিয়েছেন। ১৮৯৮ সালের ১১ ই মার্চ কলকাতার স্টার থিয়েটারে নিবেদিতা বক্তা, ১৮৯৯ সালের ১৩ ই ফেব্রুয়ারি অ্যালবার্ট হলে, ১৮৯৯ সালের ২৮ শে মে কালীঘাট মন্দিরে। গুরুকৃপায় নিজের উপর নিবেদিতার বিশ্বাস যখন পুরোদমে, তখনই লিখলেন Kali the Mother. তাঁর কালী ভাবনার মধ্যে ফুটে উঠলো মানুষের মনের বিপুল শক্তির আলোড়নের প্রতিচ্ছবি, কালী-সদাশিবের তত্ত্ব। লিখতে পারলেন এই জন্যই যে, ততদিনে “তার খ্রিস্টিয় সংস্কারে ওপরে কালীর ঐ কৃষ্ণছায়াপাত”-এর সূচনা হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যের পরত সরে যাচ্ছে তাঁর কাছে, যেন কোনো লাস্যময়ীর লীলাচাতুরির হাল্কা ওড়নার ঢাকা সরে যাচ্ছে।
সৃষ্টির মিলন কোথায়? শায়িত ঈশ্বর বা শিবের আবেগগ্রস্ত দৃষ্টির সঙ্গে দেবীর নয়নের মিলন। পদদলিত হয়েও প্রেমাবিষ্ট নয়নে দেখছেন শায়িত ঈশ্বর। যে শিবকালী সাধনাকে জাতি-গঠনের কাজে লাগানোর কথা বলেছেন স্বামীজি , সেই শিব-কালীকে ভারতের চৈতন্য হিসাবে রূপায়িত করলেন নিবেদিতা। ভয়ঙ্করী কালী যেন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ নারীর ভয়ঙ্কর বাসনা-সৃষ্টি!
ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
ছবি: শীর্ষ আচার্য।