নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে সমস্ত আধ্যাত্মিক পুনরুত্থান আমাদের জাতীয়তার জাগরণে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি অবদান রেখেছে।ভক্তি আন্দোলন এবং পরবর্তী আধ্যাত্মিক পুনরুত্থান আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এই বর্ণনাটি নিয়ে সম্প্রতি হৈ চৈ শুরু হয়েছে। অনেক স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী যুক্তি দেন যে এই সমস্ত ভক্তি আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণরূপে আধ্যাত্মিক প্রকৃতির; জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহের মতো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সামাজিক জাগরণ এবং নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ ইত্যাদির মতো সামাজিক সংস্কারের সাথে সম্পর্কিত। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে এগুলোর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক থাকতে পারে না।নারী আন্দোলনের বেশিরভাগই হয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক আগে, তাই এক্ষেত্রে সে রকম প্রভাব দেখা যায় নি।
যদি এই পৃথিবীতে এমন কোন দেশ থাকে, যাকে ‘পুণ্যভূমি’ নামে বিশেষিত করা যেতে পারে, যদি এমন কোন স্থান থাকে…..যেখানে মানুষের ভেতর ক্ষমা, দয়া, পবিত্রতা, শান্তভাব প্রভৃতি সদ্ গুণের বিকাশ সবচেয়ে অধিক পরিমাণে হয়েছে, যদি এমন কোন দেশ থাকে, যেখানে সর্বাপেক্ষা অধিক আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ হয়েছে, তবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সে আমাদের মাতৃভূমি এই ভারতবর্ষ। ” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা,৫ম খণ্ড)।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, প্রকৃত অর্থে জাতীয়তাবাদীদের অবশ্যই ইসলামী বিধি-বিধানকে বিদেশী নিয়ম হিসাবে বিবেচনা করা উচিত হয়, কিন্তু আমরা যারা উপরে উল্লিখিত আখ্যানে বিশ্বাস করি, তারা স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী নই বা একই বলে দাবি করি না। আমরা হয়তো অজ্ঞ, কিন্তু আমরা যদি এই স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের যুক্তিকে মঞ্জুরি হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে আমাদের এই উপসংহারে আসতে হবে যে নেতাজি সুভাষও একজন অজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। কারণ আমাদের অনেক আগে, তিনি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছিলেন যে রামমোহন থেকে শ্রী রামকৃষ্ণ – বিবেকানন্দ সকলেই তাদের আধ্যাত্মিক প্রচার ও শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের জাতীয় জাগরণে সরাসরি অবদান রেখেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত “ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিল।”তরুণের স্বপ্ন” শীর্ষক বইতে তিনি কি লিখছেন,দেখা যাক- “১৫ বছর আগে, বিবেকানন্দের আদর্শ বাঙালি ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই প্রভাবে বাঙালিরা সকল প্রকার দূষণ, মনের স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হয়ে এবং আধ্যাত্মিক শক্তির ভিত্তিতে ছয়টি অশুভ ইন্দ্রিয়ের (ষড়রিপু) উপর জয়লাভ করে ধার্মিক জীবনযাপনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। জাতি গঠনের মূলে রয়েছে- ব্যক্তিত্ব বিকাশ। তাই স্বামী বিবেকানন্দ সবসময় বলতেন- ‘ম্যান মেকিং আমার মিশন’।যদিও তিনি (বিবেকানন্দ) ব্যক্তিত্বের বিকাশকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তিনি কখনই জাতির গুরুত্বকে ভুলে যাননি। তিনি কর্ম বা কর্মবিহীন সন্ন্যাসে বিশ্বাস করতেন না এবং ক্ষীণ-হৃদয়ের নিয়তিতে বিশ্বাস করতেন না। শ্রীরামকৃষ্ণ অনন্তকালকে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর আজীবন সাধনার মাধ্যমে সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের একতা। এটাই ছিল স্বামীজির জীবনের মূল অনুপ্রেরণা বা মন্ত্র, যা ছিল ভবিষ্যত ভারতের জাতীয়তার ভিত্তি। এই পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহনশীলতা যদি – সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত না হত, তাহলে জাতি গঠন আমাদের এই ভিন্নধর্মী বা বৈচিত্র্যময় দেশে সম্ভব হতো না।বিবেকানন্দ-যুগের আগে আমাদের দেশে যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল তার পথপ্রদর্শক ছিলেন রামমোহন। রামমোহন ধর্মের নামে সংঘটিত সমস্ত উপদ্রবকে ধ্বংস করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আবর্জনা এবং কুসংস্কার যা হিন্দু সমাজকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছে। রামমোহন আমাদের মননে যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন তা ধীরে ধীরে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। কেশবচন্দ্রের যুগে সামাজিক সংস্কার গতি লাভ করে। নতুন বার্তা প্রদানের ফলে সমগ্র দেশে একটি নতুন জাগরণ শুরু হয়। কিছু বছর পর যখন ব্রাহ্মসমাজ হিন্দু সমাজ থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং হিন্দু সমাজের মধ্যেও জাগরণ শুরু হয়, তখন ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।রামমোহনের যুগ থেকে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পাচ্ছে। উনিশ শতকে, এই আকাঙ্ক্ষা আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়া এবং সমাজে স্পষ্ট ছিল কিন্তু আমাদের জাতীয় অঙ্গনে তা ছিল না কারণ দাসত্বের মহান ঘুমে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়ে ভারতীয়রা ধরে নিচ্ছিল যে ভারতে ব্রিটিশদের বিজয় একটি ঐশ্বরিক ইচ্ছার সমান। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকে, শ্রী রামকৃষ্ণ – বিবেকানন্দের চিন্তাধারায় স্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য রূপের অস্পষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ‘স্বাধীনতা, স্বাধীনতা প্রাণের গান’। যখন এই বার্তাটি স্বামীজির হৃদয়ের বন্ধ দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে, তখন এটি প্রায় সমগ্র দেশবাসীকে মন্ত্রমুগ্ধ এবং অত্যন্ত উত্তেজিত করে তোলে। তাঁর সাধনা, আচার-আচরণ, কথা ও বক্তৃতার মধ্য দিয়ে এই সত্য প্রকাশ পেয়েছে।সুভাষ চন্দ্র বসুর উদ্দীপক-চিন্তা বিশ্লেষণ অব্যাহত রয়েছে, “স্বামী বিবেকানন্দ সকলকে সকল প্রকার বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে খাঁটি মানুষ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং অন্যদিকে তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রচারের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। রামমোহন রায় ভেবেছিলেন যে ব্যক্তিগত ঈশ্বরের মতবাদ (সাকারবাদ) বাতিল করে এবং বেদান্তের নিরঙ্কুশতা (নিরাকারবাদ) প্রতিষ্ঠা করে তিনি আমাদের জাতিকে একটি সার্বভৌম ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হবেন। ব্রাহ্মসমাজও সেই পথ অনুসরণ করেছিল, কিন্তু ফলস্বরূপ, হিন্দু সমাজ এরপরে শ্রী রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ স্বতন্ত্র দ্বৈতবাদ (বিশেষদ্বৈতবাদ) বা দ্বৈত-অনন্দ্যবাদ (দ্বৈতদ্বৈতবাদ) এবং সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতার সত্য প্রচার করে জাতিকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন।নিজের আত্মজীবনী “ভারতপথিক”-এ সুভাষ বলছেন:
“আমাদের এক আত্মীয়(সুহৃৎচন্দ্র মিত্র)নতুন কটকে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁর ঘরে বসে বই ঘাঁটছি হঠাৎ নজরে পড়ল স্বামী বিবেকানন্দের বইগুলোর উপর। কয়েক পাতা উল্টেই বুঝতে পারলাম এই জিনিসই আমি এতদিন ধরে চাইছিলাম। বইগুলো বাড়ি নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। পড়তে পড়তে আমার হৃদয়মন আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগল। প্রধান শিক্ষকমশাই আমার মধ্যে সৌন্দর্যবোধ,নৈতিকবোধ জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন-জীবনে এক নতুন প্রেরণা এনে দিয়েছিলেন কিন্তু এমন আদর্শের সন্ধান দিতে পারেননি যা আমার সমগ্র সত্তাকে প্রভাবান্বিত করতে পারে। এই আদর্শের সন্ধান দিলেন বিবেকানন্দ। দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল,আমি তাঁর বই নিয়ে তন্ময় হয়ে রইলাম। আমাকে সবচেয়ে বেশী উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁর চিঠিপত্র এবং বক্তৃতা। তাঁর লেখা থেকেই তাঁর আদর্শের মূল সুরটি আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলাম। “আত্মন: মোক্ষার্থম্ জগদ্ধিতয়া”-মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি-এই ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। আদর্শ হিসেবে মধ্যযুগের স্বার্থসর্বস্ব সন্ন্যাসীজীবন কিংবা আধুনিক যুগের মিল ও বেন্থামের “ইউটিলিটারিয়ানিজ্ম” কোনোটাই সার্থক নয়। মানবজাতির সেবা বলতে বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝেছিলেন। তাঁর জীবনীকার ও প্রধান শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা লিখে গেছেন,”মাতৃভূমিই ছিল তাঁর আরাধ্য দেবী। দেশের এমন কোনো আন্দোলন ছিল না যা তাঁর মনে সাড়া জাগায়নি। “একটি বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেছিলেন,”বল ভারতবাসী,ভারতবাসী আমার ভাই,মূর্খ ভারতবাসী,দরিদ্র ভারতবাসী,চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই। “তিনি বলতেন যে ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য,একে একে সকলেরই দিন গিয়েছে,এখন পালা এসেছে শূদ্রের-এতদিন পর্যন্ত যারা সমাজে শুধু অবহেলাই পেয়ে এসেছে। তিনি আরো বলতেন,উপনিষদের বাণী হল,’নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য:’-চাই শক্তি,নইলে সবই বৃথা। আর চাই নচিকেতার মতো আত্মবিশ্বাস।নেতাজী যে এক অর্থে স্বামীজীর মানসপুত্র তাহাতে সন্দেহ নাই;একজনের হৃদয়ে যাহা বীজরূপে ছিল আর একজনের জীবনে তাহাই বৃক্ষরূপ ধারণ করিয়াছে। তত্ত্বজ্ঞান বা মুক্তিতত্ত্বকেও গৌণ করিয়া যে সাক্ষাৎ-মুক্তি স্বামীজীর অন্তরে একটি প্রবল শক্তিরূপে বিরাজ করিত,নেতাজীও সেই মুক্তিকে অন্তরে লাভ করিয়াছিলেন-দুইজনের প্রেমও সেই মুক্ত-প্রাণের পরার্থ-প্রীতি। স্বামীজীর যে হৃদয়-সঙ্কুচিত নয়-আপনাকে দমন করিয়া,যে-কামনাকে চরিতার্থ করিতে চায় নাই,সেই বিশাল হৃদয়ের নিপীড়িত কামনাই নেতাজীর মধ্যে অকুণ্ঠ আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। স্বামীজী যদি গেরুয়া ত্যাগ করিতেন তবে সে আর কিছুর জন্য নয়-ঐ আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের “নেতাজী” হইবার জন্য।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা সহজভাবে উপসংহারে আসতে পারি যে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, যিনি ভারত মাতার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং যিনি শক্তি ও ত্যাগের জ্বলন্ত প্রতীক – নিজেই স্বীকার করেছেন যে সেই সমস্ত আধ্যাত্মিক পুনরুত্থানের সরাসরি অবদান ছিল আমাদের জাতীয় জাগরণের পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলন। সেগুলি প্রকৃতির নিছক আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সংস্কার ছিল না। সুতরাং, যখন আমরা একই কথা বলছি, এটি নতুন নয়, কেবল তার উপলব্ধি এবং চিন্তা-উদ্দীপক বিশ্লেষণের প্রতিধ্বনি। আমরা হয়তো অজ্ঞ হতে পারি, তবে এই বিষয়ে নেতাজির উচ্চতার একজন ব্যক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং দক্ষতা সন্দেহের বাইরে কারণ সুভাষ নিছক তথাকথিত স্বঘোষিত এবং পরিশীলিত বুদ্ধিজীবীদের নমুনা নয় যারা কেবল তাদের কর্মজীবনের জন্য তাদের বুদ্ধি ব্যবহার করে। , পুরস্কার, বিলাসবহুল জীবন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে নাম ও খ্যাতি ইত্যাদি। তাঁর সমগ্র জীবন, কর্ম ও চরিত্র ছিল বিশুদ্ধ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির প্রকাশ ও মূর্ত প্রতীক।
“ভারতবর্ষের ইতিহাস,ঐতিহ্য,পরিবেশ ও সংস্কৃতির বুনিয়াদে গড়ে তুলতে হবে আজিকার ভারতের জীবনবেদ। আমাদের জীবন গড়ে তুলতে হবে আধুনিককালে এবং আধুনিক পরিবেশে। কিন্তু আমি তাদের দলভুক্ত নই যারা আধুনিকতার উৎসাহে অতীতের গৌরবকে ভুলে যায়। অতীতের বুনিয়াদে আমাদের দাঁড়াতে হবে। ভারতের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে,যাকে ভারতের নিজস্ব ধারায় বিকাশোন্মুখ করে তুলতে হবে। এককথায় আমাদের একটি সমন্বয়ে আসতে হবে। একদিকে আমাদের বেদের যুগে ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে,অন্যদিকে আধুনিক ইউরোপের অর্থহীন বিলাস ও পরিবর্তনের লালসার প্রতিরোধ করতে হবে। ….আমাদের অতীত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে আমরা একটি নূতন ও আধুনিক জাতি গড়ে তুলতে চাই। “
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
– সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য
Source :