রাজ্য জুড়ে দখলমুক্তি অভিযান অব্যাহত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধমক খেয়ে মঙ্গলবারের পর বুধবারও তৎপর রাজ্যের পুর প্রশাসনগুলি। বুধবার সারা দিন ধরেই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় চলে ‘সাফাই’ অভিযান। বেদখল হয়ে যাওয়া বহু জমি থেকে দখলদারদের সরানো হল। দখলদারদের সরাতে কোথাও মাইক নিয়ে প্রচার করা হয়। আবার কোথাও সরাসরি বুলডোজ়ার বা পেলোডার নিয়ে অবৈধ দোকানপাট এবং নির্মাণ ভেঙে দেওয়া হয়। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, এ নিয়ে বৃহস্পতিবার নবান্নে বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি কী নির্দেশ দেবেন, তার দিকে তাকিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই। অন্য দিকে, এই দখলমুক্তি অভিযানের প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি নিয়ে রাজ্য সরকারের দিকে তোপ দেগেছে বিজেপি।
পানীয় জল, আবাসন, পরিচ্ছন্নতা-সহ একাধিক পরিষেবার নিরিখে রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভার উপর রুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এ নিয়ে সোমবার নবান্ন সভাঘরে বৈঠক ডেকে পুরসভাগুলির চেয়ারম্যান, পুরনিগমগুলির মেয়র এবং প্রশাসনিক আধিকারিকদের ধমক দেন তিনি। সরকারি জমি বেহাত হয়ে যাওয়া নিয়েও ক্ষোভপ্রকাশ করেন। মমতার ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় মন্ত্রী-বিধায়কদেরও। এর পর থেকেই তৎপর পুর প্রশাসন। মঙ্গলবার রাজ্যের একাধিক জায়গায় পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় প্রশাসনের তরফ থেকে। বুধবারও সেই তৎপরতা লক্ষ করা গেল। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বুধবার কোন পুরসভা কী কী পদক্ষেপ করল—
কলকাতা পুরসভা:মঙ্গলবারের পর বুধবারও সকাল থেকে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি দখলদারদের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে পুলিশ এবং পুরসভা। সোমবার রাতেও অভিযান চালানো হয়। কলকাতার প্রায় সর্বত্রই বেআইনি দখল সরাচ্ছে পুলিশ। বাজেয়াপ্ত হয়েছে অনেক সামগ্রীও। কলকাতার বেশ কিছু এলাকার ফুটপাথের দোকান সরাতে অভিযান চালায় পুলিশ। বেহালায় বুলডোজার চালিয়ে বেশ কয়েকটি বেআইনি দোকান ভাঙা হয়েছে। ইএম বাইপাস, শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে এনআরএস হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকাতেও অভিযান চলে। এ ছাড়াও আনন্দপুর এলাকার খালের ধারে রাস্তা দখল করে দেওয়া দোকানও সরিয়ে দেওয়া হয়। রাজাবাজারেও উচ্ছেদ অভিযান চলে। উচ্ছেদ অভিযান চলে চিড়িয়াখানা সংলগ্ন এলাকাতেও। বুধবার যাঁদের দোকান ফুটপাথ বা রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের ছবিও দেখা গিয়েছে। বেআইনি দখল নিয়ে বুধবার কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গয়াল বলেন, ‘‘অভিযান চলছে। এর পরেও চলবে। যেখানে যেখানে ফুটপাথে বেআইনি ভাবে হকাররা বসে আছেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হবে।’’
বিধাননগর পুরসভা:মুখ্যমন্ত্রীর ধমকের পরদিনই, মঙ্গলবার সকালে সল্টলেকে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে নেমেছিল পুলিশ এবং পুরসভা। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিধাননগর পুরসভার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড এবং সেক্টর ফাইভে বুলডোজ়ার নিয়ে একাধিক দোকানের কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় নয়ানজুলির মধ্যেও বাঁশের মাচা করে টিনের কাঠামো দিয়ে দোকান তৈরি করা হয়েছিল। সে সবও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বুধবারও সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত। স্থানীয় সূত্রে খবর, বুধবার সিটি সেন্টার-১ সংলগ্ন এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় পুর প্রশাসন। ভেঙে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি অবৈধ ঝুপড়ি। নিউ টাউনেরও বেশ কয়েকটি বেআইনি খাবার দোকান ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
হাওড়া পুরসভা: নড়েচড়ে বসেছে হাওড়া জেলা প্রশাসনও। হাওড়া রানিহাটি মোড়ের কাছে ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে বেআইনি ‘দখলদারি’র বিরুদ্ধে উচ্ছেদ চালাল প্রশাসন। বুধবার দুপুরে সাঁকরাইল থানার পুলিশ, পঞ্চায়েত এবং ন্যাশানাল হাইওয়ে অথরিটির যৌথ উদ্যোগে এই অভিযান চলে। বড় বড় বুলডোজার নিয়ে রাস্তার ধারের বেআইনি দোকান ভাঙা হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী। স্থানীয় সূত্রে খবর, জাতীয় সড়কের ধারে ১৫টিরও বেশি দোকান ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর পাশাপাশি, বুধবার বেআইনি পার্কিং নিয়েও অভিযান চালায় হাওড়া পুলিশ। বেআইনি পার্কিংয়ের অভিযোগে দীপক ছেত্রী নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে লিলুয়া থানার পুলিশ।
বিষ্ণুপুর পুরসভা: পুর পরিষেবা এবং সরকারি জমি দখল হওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের দু’দিন পর পদক্ষেপ করল বিষ্ণুপুর পুরসভাও। বিষ্ণুপুর পুরসভার তরফে বুধবার বেআইনি ‘দখলদার’ উচ্ছেদের নোটিস দেওয়া হয়। পুর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যবাহী লালবাঁধের পাড় দখল করে গজিয়ে ওঠা একের পর এক দোকানের মালিককে জমি খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্দেশ পালন না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিষ্ণুপুর পুরসভার পুরপ্রধান গৌতম গোস্বামী বলেন, ‘‘বিষ্ণুপুরের রাজাদের খনন করা লালবাঁধের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের সমৃদ্ধ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। যার টানে প্রতি বছর এই বাঁধে অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন। বাঁধের পাড় দখল করে এখন বেশ কিছু অস্থায়ী দোকান তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে আমরা ওই ব্যবসায়ীদের যত দ্রুত সম্ভব জমি খালি করার নোটিশ দিয়েছি। আগামী দিনে পুরসভার তরফে শহরের সমস্ত এলাকাকেই দখলমুক্ত করা হবে।’’
তারকেশ্বর পুরসভা: তারকেশ্বরের বিভিন্ন এলাকার ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে বুধবার পুলিশি অভিযান চলে। অভিযানে শামিল হয়েছিলেন হুগলি জেলা গ্রামীণ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কৃষাণু রায়, সিআই তারকেশ্বর প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়, তারকেশ্বর থানার ওসি-সহ একাধিক উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘তারকেশ্বর মন্দির চত্বর এবং পুরসভা এলাকার রাস্তার উপর বেআইনি ভাবে অনেকগুলি দোকান তৈরি হয়েছিল। তাতে পথচারীদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। আমি অনেক সময়ই অভিযোগ পাই। বুধবার আমরা তারকেশ্বর থানার পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে গেলাম। রাস্তার উপর থেকে দোকান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। সামনে শ্রাবণী মেলা আসছে। বহু ভক্তের সমাগম হবে তারকেশ্বরে। সেই কারণে আগে থেকেই আমরা একটা প্রস্তুতিও নিয়ে রাখলাম। দু’-তিন দিন পর আমরা আবার এসে দেখব ব্যবসায়ীরা কথা শুনেছেন কি না। না শুনলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।’’ তারকেশ্বর পুরসভার পক্ষ থেকে বুধবার জবরদখল করে রাখা ফুটপাত রাস্তা ফাঁকা করে দিতে মাইকিং করা হয়।
সিউড়ি পুরসভা: সিউড়ির অন্তর্গত যে সমস্ত দোকান ফুটপাথ দখল করে তৈরি বলে অভিযোগ, সেই সব দোকান ভেঙে ফেলা হল পুর প্রশাসনের তরফ থেকে। সেই উচ্ছেদ অভিযানে উপস্থিত ছিলেন সিউড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান-সহ কাউন্সিলরেরা এবং সিউড়ি থানার পুলিশ। সূত্রের খবর, বোলপুর পুরসভাও বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ অভিযানের উদ্যোগ নিতে পারে।
আসানসোল পুরনিগম:আসানসোল পুরনিগমের পক্ষ থেকে কোনও উচ্ছেদ অভিযান না চালানো হলেও বুধবার এ নিয়ে বৈঠকে বসেন মেয়র বিধান উপাধ্যায়। এই বোর্ড মিটিংয়ে পরবর্তী কালে কী পদক্ষেপ করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয় বলে খবর। এই প্রসঙ্গে বিধান জানান, মুখ্যমন্ত্রী যা নির্দেশ দিয়েছেন তা সঠিক ভাবে পালন করা হবে। বেআইনি দখলদারদের উচ্ছেদের পাশাপাশি মানুষের কাছেও উপযুক্ত পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া হবে।
আলিপুরদুয়ার পুরসভা: বেআইনি ‘দখলদার’দের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় আলিপুরদুয়ার পুর প্রশাসনও। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি অস্থায়ী দোকান এবং অবৈধ নির্মাণ।
উল্লেখ্য, রাজ্যের জায়গায় জায়গায় শুরু হওয়া দখলদার উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে বৃহস্পতিবার নতুন করে বৈঠক ডেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বৃহস্পতিবার দুপুরে নবান্ন সভাঘরে আয়োজিত ওই বৈঠকে থাকতে বলা হয়েছে বিভিন্ন জেলার জেলাশাসক, বিভিন্ন দফতরের আমলা, কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ বিভিন্ন কমিশনারেটের কমিশনার এবং অন্যান্য কর্তাকে। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদেরও ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, দখলদার উচ্ছেদ অভিযান কী ভাবে চলছে, তাতে কোনও বদল ঘটাতে হবে কি না, সে সব নিয়ে পর্যালোচনা হতে পারে এই বৈঠকে। আলোচনা হতে পারে উচ্ছেদ অভিযানের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েও।
রাজ্য জুড়ে চলা ‘দখলদার’ উচ্ছেদ নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধী শিবির। ‘দখলদার’ উচ্ছেদের বিরোধিতা করে বুধবার রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পরামর্শ, প্রশাসনের তরফে উচ্ছেদে এলে বাধা দিতে হবে। প্রয়োজনে তিনি নিজে বুলডোজ়ারের সামনে দাঁড়াতে রাজি আছেন। ‘দখলদার’ উচ্ছেদ করতে বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা ‘অমানবিক’ বলেও মন্তব্য করেছেন শুভেন্দু। তিনি জানিয়েছেন, তিনি বা তাঁর দল বেআইনি ভাবে সরকারি জমি অধিগ্রহণের পক্ষে নেই। কিন্তু রাজ্যের সর্বত্র নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই কাজ করতে হবে। এর জন্য আগে রাজ্য সরকারকে এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) তৈরি করতে হবে বলেও দাবি করেছেন শুভেন্দু।