প্রবেশপথের গার্ডরেল সরেছে। কয়েক জন পুলিশকর্মী এলাকায় বসে থাকলেও বহুতল ভেঙে পড়ার পরের, অর্থাৎ ২০-২৫ দিন আগের সেই কড়াকড়ি নেই। পুরসভার লোকজনের যাতায়াতও চোখে পড়ে না। জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার বন্ধ রয়েছে বেআইনি নির্মাণ ভাঙার কাজ। ফলে ইট-সুরকি সরাতে আসা গাড়ির চেনা জটলাও নেই। তবে গার্ডেনরিচের নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়ার সেই বিপর্যয়স্থল এখনও শোকাচ্ছন্ন।
ইদের দুপুরে সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, সদ্য তৈরি বহুতলের নীচে মোটরবাইকের উপরে একা বসে সৈয়দ মুস্তাফা আলি। বছর আটচল্লিশের মুস্তাফা বললেন, ‘‘এই মহল্লা এমন ইদ দেখেনি। চেনা লোক দেখলে হয়তো গলা জড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাতে দেখবেন। আদতে এঁদের বুকে গভীর ক্ষত। হাতে গোনা পরিবারই এখানে রয়েছে, ওই দুর্ঘটনায় যাদের কেউ মারা যাননি।’’
গত ১৭ মার্চ বহুতল ভেঙে পড়ার সময়ে মুস্তাফাকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন স্ত্রী শমা বেগম। প্রতিবেশীর ফোন পেয়ে ফিরে এসে তিনি জানতে পারেন, তাঁদের ঘরের উপরেই ভেঙে পড়েছে বহুতল। স্ত্রী ছাড়াও তার নীচে চাপা পড়েছেন মুস্তাফার ভাই এবং শ্যালিকা। গলা বুজে আসা অবস্থায় মুস্তাফা বলেন, ‘‘আমার ছেলেও হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ওকে ফেরাতে পেরেছি। শুধু ওর জন্যই ইদে নতুন পোশাক কিনেছি। ইদ নিয়ে মেতে থাকত যে মানুষটা, সে-ই তো আর নেই!’’ মোবাইল বার করে স্ত্রীর ছবি বার করলেন। সেই ছবিতে নিঃশব্দে নেমে এল জল।
মুস্তাফার সঙ্গে কথা শেষ করে দু’পা এগোতেই এলাকার একমাত্র মসজিদ। মসজিদের সাজ বলতে সামনের ফাঁকা অংশে কিছু রঙিন বেলুন লাগানো হয়েছে। ওই পথ ধরে ডান দিকে ঘুরলেই ভেঙে পড়া বহুতল। এখনও যার সমস্তটা সরিয়ে নিতে পারেননি পুরকর্মীরা। সেখানেই ঘুরছে খুদেদের দল। পাশের দোকানে বসা মহম্মদ রহিম তাদের মধ্যে থেকে এক নাবালিকাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ওর বাবা ওই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। স্বামী হারিয়ে সংসার চালাবেন কী করে, সেই ভাবনায় অস্থির মেয়েটির মা।’’
ওই চাতালেই খেলতে আসা বছর পাঁচেকের মেয়েকে কোলে তুলে এক যুবক চললেন কিছু কিনে দিতে। দোকানের সামনে পৌঁছে বললেন, ‘‘এই হল মহম্মদ ইমরানের মেয়ে। ওর বাবা আমার বন্ধু। বহুতলের নীচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছে ইমরান।বাবা নেই তো কী? আমরা আছি। বহুতল ভেঙে পড়ার ঘটনায় যে সব পরিবার প্রিয়জনদের হারিয়েছে, তাদের পাশে থেকে এ বার ইদ পালন করছি আমরা।’’
মহল্লায় কান পাতলে শোনা যায়, আব্দুল রউফ নিজামির কথা। এ পাড়ার শেরু চাচা! পুরনো পোশাক গায়ে ঘুরছিলেন শেরুর ভাই মহম্মদ ফারুক নিজামি। ফারুক বলেন, ‘‘দাদা শেরু বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশের কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। পাড়ার অনেককে সেখানে কাজ দিয়েছেন। আমপান হোক বা অন্য সমস্যা— শেরু বহু ঘরের আলো হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইদে একাই বহু গরিব পরিবারকে খাবার দিতেন। মাঝেমধ্যেই অজমের শরিফ যেতেন। তিনিও দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। ওঁর ছোট ছোট চার ছেলে-মেয়ে রয়েছে। ওদের দিকে তাকানো যায় না।’’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারুকের মন্তব্য, ‘‘কী মনে করে যে এই বহুতল তৈরির মধ্যস্থতায় দাদা ঢুকলেন। পাড়ার লোক ওঁর কথা শুনতেন, তাই প্রোমোটার ওঁকে ব্যবহার করল। যে বহুতল দাঁড় করাতে কাজে যাওয়া, তার নীচেই শেষে চাপা পড়লেন দাদা!’’
‘ভাঙা মহল্লা’ জুড়ে স্বজন হারানোর হাহাকার তাই ছাপিয়ে যায় ইদের শুভেচ্ছা-বার্তাকে।