রহস্যের নাম ‘ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড’! হিসাবের গোলকধাঁধায় ঘুরছে ক্রিকেট, ভারতের হারে বাড়ছে নিয়ম ঘিরে বিতর্ক

সুনীল গাওস্কর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্য নিয়ম চালুর পরামর্শ দিয়েছেন। আকাশ চোপড়ার মতে, আইসিসি-র সময় এসেছে নিয়মে কিছু বদল করার। কোন নিয়ম নিয়ে তাঁদের ক্ষোভ? ভারতের দুই প্রাক্তন ক্রিকেটার সুর চড়িয়েছেন ‘ডাকওয়ার্থ-লুইস’ নিয়মের বিরুদ্ধে। বৃষ্টিবিঘ্নিত ক্রিকেট ম্যাচে যে নিয়মের উপর নির্ভর করে ঠিক হয়, কত রান তাড়া করতে হবে। এই নিয়ম নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। ক্রিকেটেরেরা বলেন, তাঁরা এই নিয়ম বুঝতে পারেন না। কী ভাবে তার হিসাব হয় তা-ও অজানা। পার্‌থে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম এক দিনের ম্যাচে ‘ডাকওয়ার্থ-লুইস’ নিয়মে কমে গিয়েছে ভারতের রান। তাতেই আগুনে ঘি পড়েছে।

‘ডিএলএস মেথড’ বা ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির প্রবর্তক দুই ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ এবং টনি লুইস। আন্তর্জাতিক এক দিন বা টি-টোয়েন্টিতে সাধারণত বৃষ্টি বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিঘ্নিত ম্যাচে এই নিয়ম ব্যবহার করা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয় পরে ব্যাট করা দলের জন্য। এই নিয়ম প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৯৬-৯৭ সালে জিম্বাবোয়ে বনাম ইংল্যান্ডের এক দিনের ম্যাচে। ২০০১ সালে আইসিসি এই পদ্ধতি আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করে।

ডিএলএস নিয়ম অনুযায়ী কোনও এক দিনের ম্যাচের ফল তখনই ঘোষিত হবে যখন উভয় ইনিংসে কমপক্ষে ২০ ওভার করে খেলা হয়ে গিয়েছে। যদি প্রথম ইনিংসের মাঝপথে বিঘ্ন ঘটে এবং প্রথম ইনিংস কম ওভারে শেষ করতে হয়, তখন দ্বিতীয় ইনিংসের লক্ষ্য আবার নতুন করে নির্ধারিত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম ইনিংসে কত ওভার বাকি ছিল, কত রান হয়েছে আর কত উইকেট ছিল, এই সব কিছুর উপর ভিত্তি করে হিসাব হয়।

সাধারণত এ সব ক্ষেত্রে লক্ষ্য দ্বিতীয় ইনিংসে বেড়ে যায়। যুক্তি, প্রথম ইনিংসের কিছুটা অংশ জুড়ে প্রথমে ব্যাট করা দল ভেবেছিল তাদের হাতে আরও সময় আছে। ওভার কমে যাওয়ার কথা আগে জানলে তারা আরও দ্রুত রান নেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাট করত। তাই লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ভারত ১৩৬ রান করলেও তা কমিয়ে ১৩০ করা হয়েছে।

লক্ষ্যমাত্রা কমে যাওয়ায় অবাক আকাশ। তিনি সেই ম্যাচে ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় ছিলেন। তখনই প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আকাশ বলেন, “ভারত ১৩৬ রান করল। কিন্তু তা কমিয়ে ১৩০ করে দেওয়া হল। এটা অন্যায়। অবিচার। কারণ, ম্যাচের শুরুতে ভারত ভেবেছিল ৫০ ওভারের খেলা।” আকাশ আরও বলেন, “ডিএলএস-এর হিসেব সাধারণত রান বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অন্য একটা হিসাবও আছে। বেশি উইকেট পড়ে গেলে রান কমে যাবে। ভারতের ৯ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তাই নিয়ম বলে দিল, তুমি ১৩৬ রান করেছ। যদি প্রথম থেকেই জানতে ২৬ ওভারের খেলা, সে ক্ষেত্রে এই রানটাও করতে পারতে না। এটা অদ্ভুত। মেনে নেওয়া যায় না।”

ডিএলএস নিয়মে যদি পরে ব্যাট করা দলের রিসোর্স প্রথমে ব্যাট করা দলের রিসোর্সের থেকে বেশি হয়, তা হলে প্রথম দলের রিসোর্সকে দ্বিতীয় দলের রিসোর্স থেকে বাদ দিয়ে দিতে হবে। তার পর তাকে ২২৫ (আইসিসি নির্ধারিত এক দিনের ম্যাচের গড় স্কোর) এর শতাংশে ভাগ করতে হবে। শেষে তাকে প্রথমে ব্যাট করা দলের রানের সঙ্গে যোগ করে পরে ব্যাট করা দলকে টার্গেট দিতে হবে।

ধরা যাক, প্রথমে ব্যাট করে টিম ‘এ’ ৫০ ওভারে ২৬০ রান করল। পরে নেমে টিম ‘বি’ ৪০ ওভারে ৫ উইকেটে ১৯৯ রান করল, এমন অবস্থায় বৃষ্টিতে খেলা স্থগিত হয়ে গেল। এ ক্ষেত্রে টিম ‘এ’ পুরো ৫০ ওভারে খেলেছে, তাই তাদের রিসোর্স ১০০%। টিম ‘বি’-র শুরুতে রিসোর্স ছিল ১০০%। ৪০ ওভার শেষে টিম বি ৫ উইকেট হারিয়েছে। ডিএলএস-এর একটি নির্দিষ্ট চার্ট রয়েছে। সেই অনুযায়ী তাদের রিসোর্স বাকি ২৭.৫%। অর্থাৎ টিম ‘বি’- র মোট ব্যবহৃত রিসোর্স ১০০-২৭.৫ = ৭২.৫%। এখানে টিম ‘বি’-র রিসোর্স টিম ‘এ’-র থেকে কম। সুতরাং ‘বি’-র লক্ষ্যমাত্রা হবে মূল লক্ষ্যমাত্রার ৭২.৫/১০০ গুণ। টিম ‘এ’-র স্কোর ছিল ২৬০। তাই টিম ‘বি’-র লক্ষ্য হবে ২৬০x৭২.৫/১০০ = ১৮৮.৫ বা ১৮৯ রান। যেহেতু ম্যাচ আর হয়নি, সেহেতু এ ক্ষেত্রে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে টিম ‘বি’-কে। কারণ, তারা ১৮৯ এর থেকে ১০ রান বেশি করেছে। ফলে পরে ব্যাট করলেও তারা ১০ রানে বিজয়ী হয়েছে।

বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের কথা এলেই মনে পড়ে যায় ১৯৯০ সালে বাংলার শেষ রঞ্জি জয়ের কথা। সেই ম্যাচেও বৃষ্টি প্রভাব ফেলেছিল। ফলে ‘কোশেন্ট’ (তখন ডিএলএস নিয়ম আসেনি) পদ্ধতিতে জয়ী হয়েছিল বাংলা। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বলা হয়, সেই ‘কোশেন্ট’-এর হিসেব নাকি রেখেছিলেন দলের ক্রিকেটার অরুণ লাল। তাঁর হিসেব মতোই ব্যাট করে বাংলা। সেই দলের অধিনায়ক সম্বরণও বুঝতে পারেন না ডিএলএস পদ্ধতি। তিনি বললেন, “এই নিয়মটা কেউ বোঝে না। আমিও না। কিন্তু কিছু তো করার নেই। নিয়ম যখন আছে তখন সেটা মানতেই হবে। ভারতকে ভাবতে হবে, বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলে ডিএলএস মাথায় রেখে খেলতে।” অরুণ অবশ্য এই নিয়মের ত্রুটি বিশেষ খুঁজে পাননি। তিনি বললেন, “আমার মনে হয় ডিএলএস নিয়ম দু’দলকেই সমান সুবিধা দেয়। এতে বিতর্কের কিছু নেই।”

অরুণ নিয়মের ফাঁক খুঁজে না পেলেও তা খুঁজে পেয়েছেন আকাশ। পার্‌থে যখন ভারত বল করতে নামল, তখন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল চার বোলার সর্বোচ্চ পাঁচ ওভার করে করবেন ও এক বোলার সর্বোচ্চ ছ’ওভার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া বল করার সময় ওভার কমার আগেই সাত ওভার বল করেন জশ হেজ়লউড। স্টার্ক ছ’ওভার বল করে ফেলেছিলেন। তা হলে তো অস্ট্রেলিয়াই সুবিধা পেল। আকাশ বলেন, “অস্ট্রেলিয়ার সেরা দুই বোলার ২৬ ওভারের মধ্যে ১৩ ওভার করেছে। কিন্তু ভারত তা করতে পারেনি। তা হলে তো ডিএলএস নিয়মে ভারতের রান বাড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল। সেটা হল না। অস্ট্রেলিয়া বাড়তি সুবিধা পেল।”

এই পরিস্থিতিতে আইসিসি-কে নিয়ম বদলের পরামর্শ দিয়েছেন গাওস্কর। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় এই নিয়ম কেউ খুব একটা বোঝে না। তা হলে তো ভিজেডি (ভি জয়দেবন) নিয়ম ব্যবহার করা যায়। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে এই নিয়ম রয়েছে। এটা অনেক বেশি সরল। হিসাব করা সহজ। ফলে ক্রিকেটারদের সুবিধাই হবে।” গাওস্করের পরামর্শ কি মানবে আইসিসি? না ভবিষ্যতে আবার প্রশ্ন উঠবে এই নিয়ম নিয়ে। হিসাবের গোলকধাঁধাতেই ঘুরতে থাকবে ক্রিকেট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.