কষ্ট করে কেনা আইফোনটা রয়ে গেল! সাফাইকর্মীর পুত্র, প্রতিবন্ধী ইউটিউবার অমিতের জীবনযুদ্ধ শেষ

পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জনপ্রিয় ইউটিউবার অমিত মণ্ডলের। মাত্র ২২ বছর বয়সেই থেমে গিয়েছে তাঁর সাফল্যের দৌড়। অল্প সময়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন অমিত। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর ভিডিয়ো দেখতেন নিয়মিত। ইউটিউব থেকে তাঁর রোজগারে সংসারের হাল ফিরেছিল। কিন্তু সাফল্যের স্বাদ খুব বেশি দিন উপভোগ করতে পারলেন না এই প্রতিবন্ধী যুবক।

ছোটবেলা থেকেই বিশেষ ভাবে সক্ষম অমিত। হাঁটাচলা করতে পারতেন না তিনি। অমিতের বাবা চিত্ত মণ্ডল এবং মা সন্ধ্যা মণ্ডল, দু’জনেই পেশায় সাফাইকর্মী। তাঁরাও বিশেষ ভাবে সক্ষম।স্থানীয় পঞ্চায়েত এলাকায় বিভিন্ন বাজারে ঘুরে ঘুরে সাফাইয়ের কাজ করতেন তাঁরা। এ ছাড়াও, অমিতের মা বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন। সেই আয়ে চলত সংসার। দরিদ্র পরিবারে শারীরিক অক্ষমতা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু হাজারো টানাটানির মাঝেও ছেলের পায়ের সমস্যা দূর করার জন্য বহু চেষ্টা করেছিলেন অমিতের বাবা।

ফ্রেজারগঞ্জের অমিতের পড়াশোনা শুরু সরস্বতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার পর বাড়ির কাছেই কৃষ্ণপ্রসাদ আদর্শ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করেন তিনি। ইতিহাসে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন শিবানী মণ্ডল মহাবিদ্যালয়ে।

Youtuber Amit Mondal dies in tragic road accident.

পায়ের চিকিৎসার জন্য নানা হাসপাতালে ঘুরেছিলেন অমিত। এক দিন নিজের পায়ে হাঁটবেন, এই স্বপ্ন দেখতেন। বাবা-মায়েরও অনেক আশা ছিল অমিতকে নিয়ে। প্রতিবন্ধকতা অবশ্য তাঁকে আটকাতে পারেনি। কখনও মা, কখনও বাবা, কখনও অন্য কোনও পরিচিতের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন অমিত। পরে হুইলচেয়ার কেনা হয়। অনটনের সংসারে হাল ফেরাতে ইউটিউবকে আঁকড়ে ধরেছিলেন অমিত। তাঁর পুঁজিও হয়েছিল সেই অনটনই।

ইউটিউবে ভ্লগ তৈরি করেই সফল হয়েছিলেন অমিত। তাঁর ভিডিয়োতে আকাশকুসুম কিছু থাকত না। নিজের সাদামাটা জীবন, দৈন্য, রোজকার ছোট ছোট আনন্দ, অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরতেন ইউটিউবের পর্দায়। রোজ যেন জগৎকে নতুন করে আবিষ্কার করে চলেছিলেন অমিত। তাঁর অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি ধরা থাকছিল ভিডিয়োয়। প্রতিবন্ধী অমিতের পায়ে ভর করে তাঁর অভিজ্ঞতার শরিক হচ্ছিলেন হাজারো মানুষ।

অমিতের ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘মাই লাইফ অমিত মণ্ডল’। এই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৩ লক্ষ ১৫ হাজার। মোট ৩৫৯টি ভিডিয়ো পোস্ট করা হয়েছে এই চ্যানেলে। অনটনের সংসারে বাবা-মা অমিতকে কী ভাবে মানুষ করেছেন, তাঁদের রোজকার সংগ্রাম ফুটে উঠেছে ভিডিয়োগুলিতে। চ্যানেলে নিজের সম্বন্ধে অমিত লিখেছেন, ‘‘আমি অমিত। আমি আমার বন্ধুদের ভালবাসি। আমি যতটা পারি, ভিডিয়ো তৈরি করে তা আপলোড করার চেষ্টা করি। এই চ্যানেলে আমার বাবা-মায়ের পরিশ্রম এবং আমাদের প্রতিদিনের যাপনের নানা মুহূর্ত তুলে ধরা হয়। যদি কোনও ভুলত্রুটি হয়, দয়া করে আমাকে ভাই আর ছেলে মনে করে ক্ষমা করে দেবেন।’’

Youtuber Amit Mondal dies in tragic road accident.

অমিত আরও লেখেন, ‘‘আমার বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই আমি এই ভিডিয়ো বানানো শুরু করেছি। আশা করি, এই পথে আপনারা সকলে আমার পাশে থাকবেন। আপনাদের ভালবাসা এবং ভগবানের আশীর্বাদ ছাড়া আমি এই পথে আসতেই পারতাম না। দয়া করে আমার পাশে থাকুন।’’

ইউটিউব থেকে অমিতের রোজগার তাঁদের সংসারের হাল ফিরিয়েছিল। পরিশ্রমের টাকায় কিছু দিন আগেই আইফোন কিনেছিলেন অমিত। তাঁর সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন অনুরাগীরাও।

Youtuber Amit Mondal dies in tragic road accident.

মঙ্গলবার প্রাণঘাতী পথ দুর্ঘটনার এক দিন আগেও ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন অমিত। কলকাতায় এসে আলিপুর জেল মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা রেকর্ড করেছিলেন। শেষ ভিডিয়োটি ইউটিউবে আড়াই লক্ষ মানুষ দেখেছেন।

মামা এবং মামির সঙ্গে বকখালি ঘুরতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অমিতদের স্কুটার। তাঁর মামা স্কুটার চালাচ্ছিলেন, অমিত বসেছিলেন মাঝখানে। অন্য একটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়ে ভারসাম্য হারায় তাঁদের স্কুটার। একটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে গিয়ে ধাক্কা খায় সেটি। তিন জনেই গুরুতর জখম হন। ডায়মন্ড হারবারের হাসপাতালে চিকিৎসার পর অবস্থার অবনতি হলে অমিতকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে মৃত্যু হয় তাঁর। অকালে থেমে গিয়েছে জীবনের দৌড়, থমকেছে স্বপ্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.