বাংলায় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের বয়স তখন ছয় বছর। ১৯৮৩ সালে সেই জ্যোতি বসুর সরকারের বিরুদ্ধেই আন্দোলন শুরু করেছিল জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন এবিজেডিএফ (নিখিলবঙ্গ জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট)। ঠিক তার পরের বছরেই সিপিএম জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে পাল্টা সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিল। ৪১ বছর আগে যে পথে হেঁটেছিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শাসক সিপিএম, ২০২৪ সালে সেই পথেই হাঁটল বাংলার বর্তমান শাসক তৃণমূল।
শনিবার আরজি কর হাসপাতালে যখন জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের ডাকা গণ কনভেনশন চলছে, সেই সময়েই কলকাতা প্রেস ক্লাবে আত্মপ্রকাশ করল জুনিয়র ডাক্তারদের পৃথক সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স’ অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউবিজেডিএ)। যা আপাতদৃষ্টিতে ‘অরাজনৈতিক’ হলেও নেপথ্যে যে তৃণমূল রয়েছে, তা স্পষ্ট। নইলে সাংবাদিক সম্মেলন শুরুর আগে তৃণমূলের এক মুখপাত্রকে সংগঠনের তরফে বক্তাদের ক্রমপর্যায় ঠিক করে দিতে দেখা যেত না। যদিও পুরোটাই ‘অন্তরালে’ থেকে। যেমনটা ১৯৮৩ সালে করেছিল সিপিএমও। সিপিএম সূত্রের খবর, সেই সময়ে কলকাতা জেলা সিপিএমের তরফে বিষয়টি পরিচালনার ভার ছিল অধুনাপ্রয়াত রাজদেও গোয়ালার উপর।
প্রত্যাশিত ভাবেই নতুন সংগঠন একাধিক দাবি এবং অভিযোগ তুলেছে। সংগঠনের অন্যতম আহ্বায়ক শ্রীশ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আরজি করে নির্যাতিতারর জন্য বিচার চেয়ে আমরাই আন্দোলন শুরু করেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম আন্দোলন চলুক এবং পরিষেবাও দেওয়া হোক। কিন্তু অন্য একটি অংশ পরিষেবা না দিয়ে কেবল আন্দোলনের কথা বলতে থাকে।’’ তাঁর দাবি, তাঁরা পরিষেবা এবং আন্দোলন সমান্তরাল ভাবে চালাতে চেয়েছিলেন বলেই তাঁদের বিরুদ্ধে থ্রেট কালচারের অভিযোগ তোলা হয়েছে।
আরজি করের অভ্যন্তরীণ কমিটি থ্রেট কালচারে যুক্ত থাকার অভিযোগে ৫১ জন জুনিয়র ডাক্তার, ইন্টার্ন এবং পড়ুয়াকে সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করেছিল। যদিও কলকাতা হাই কোর্ট ওই নির্দেশের উপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করেছে গত মঙ্গলবার। শনিবার পাল্টা সংগঠনের তরফে একাধিক জুনিয়র ডাক্তার, ইন্টার্ন দাবি করেছেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। আরজি করের ইন্টার্ন অতনু বিশ্বাস যেমন বলেছেন, ‘‘ওটা কোনও তদন্ত কমিটিই ছিল না। ওটা ছিল ক্যাঙারু কোর্ট।’’
নতুন সংগঠনের অভিযোগ, নির্যাতিতার বিচার চেয়ে আন্দোলনের নামে কোটি কোটি টাকা তোলা হয়েছে। শ্রীশ, সৌরভ দাস প্রমুখের দাবি, বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে গত দু’মাসে ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা ঢুকেছে। নির্যাতিতার ময়নাতদন্তের নথিতে সাক্ষরকারী এক জুনিয়র ডাক্তারের নাম করেই বলা হয়েছে, তাঁর অ্যাকাউন্টে ২৮ লক্ষ টাকা ঢুকেছে। নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশের মঞ্চে আরজি করের ইন্টার্ন আতাউল রহমান দাবি করেছেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি ওই টাকাপয়সার বিষয়টিকেও তদন্তের আওতায় আনুক। প্রসঙ্গত, আরজি করের আর্থিক দুর্নীতি মামলার অভিযোগের তদন্ত ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
ডব্লিউবিজেডিএ-এর তরফে শনিবার ঘোষণা করা হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যেই তারাও গণ কনভেনশনের আয়োজন করবে। কলকাতা শহরেই হবে সেই কনভেনশন। জুনিয়র ডাক্তারদের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষকেও সেই কনভেনশনে শামিল করার চেষ্টা করা হবে। সৌরভ জানিয়েছেন, গণ কনভেনশনের পরে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও দ্বারস্থ হতে পারেন।
উল্লেখ্য, গত সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেই আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের অন্যতম ‘মুখ’ অনিকেত মাহাতো দাবি করেছিলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে থ্রেট কালচারের অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা এক এক জন নটোরিয়াস ক্রিমিনাল (দাগি অপরাধী)। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই এ নিয়ে অনিকেতকে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, তিন দিনের মধ্যে অনিকেত সমাজমাধ্যমে ক্ষমা না চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হবে। যদিও অনিকেত জানিয়েছেন, তিনি এমন কোনও নোটিস পাননি। শনিবার নতুন সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, যে আরডিএ-এর অভিযোগের ভিত্তিতে আরজি করে তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছিল, যার নেতা অনিকেত, সেই সংগঠনের কোনও ‘বৈধতা’ নেই। অর্থাৎ, অবৈধ একটি সংগঠনের অভিযোগে আরজি কর কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটির নামে গণশাস্তি দিয়েছিলেন। সৌরভ, শ্রীশেরা দাবি করেছেন, তাঁরাই আসলে থ্রেট কালচারের শিকার। তাঁরাই সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছেন।
ডব্লিউবিডেডিএ আরও দাবি করেছে, আন্দোলনের নামে জুনিয়র ডাক্তারেরা (অনিকেতরা) স্বাস্থ্য পরিষেবায় অরাজকতা তৈরি করতে চাইছেন। ১৯৮৭ সালের জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের নেতা চিকিৎসক অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শাসকের স্লোগান মিলে যাচ্ছে। সেই সময়ে সিপিএমের তৈরি করা সংগঠন বলেছিল, আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারেরা হাসপাতালে নৈরাজ্য তৈরি করতে চাইছেন। আজকেও প্রায় একই কথা বলা হচ্ছে।’’
গত দু’মাস ধরে আরজি কর আন্দোলনে ক্রমশ ‘চাপ’ তৈরি হয়েছিল তৃণমূল তথা সরকারের উপর। মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিবকে ‘বিড়ম্বিত’ও হতে হয়েছে বার বার। সেই প্রেক্ষাপটে গত সোমবার জুনিয়র ডাক্তারদের ‘আমরণ অনশন’ প্রত্যাহারের পর আন্দোলন যখন বেশ খানিকটা স্তিমিত, ঠিক সেই সময়েই আত্মপ্রকাশ ঘটল পাল্টা সংগঠনের। অনেকের মতে, যা আসলে পাল্টা ভাষ্য নির্মাণের ‘মঞ্চ’।