নীলবাড়ির লড়াইয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে আড়াই বছর। সেই আড়াই বছর আগে বদলে গিয়েছিল অধুনা দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপি প্রার্থী দেবাশিস ধরের জীবন। তখন কোচবিহারের পুলিশ সুপার দেবাশিস চাকরিজীবনের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনেও ধাক্কা খান। এখনও সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ বার বিজেপি তাঁকে বীরভূম আসনে প্রার্থী করেছে। জিতলে লালমাটির জেলায় প্রথম জয়ে বিজেপির নতুন দিনের সূচনা হবে। আর প্রার্থী দেবাশিস ফিরে পাবেন তাঁর অতীত। যে অতীত ফিরে পেতে চান তিনি। ফিরে পেতে চান তাঁর হারিয়ে ফেলা ‘আদর’।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফায় ১০ এপ্রিল ভোটগ্রহণ ছিল কোচবিহারের শীতলখুচিতে। ভোটগ্রহণের সময় মাথাভাঙা ব্লকের জোড়পাটকির আমতলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অশান্ত পরিবেশ তৈরি হলে গুলি চালায় কেন্দ্রীয় বাহিনী। ঘটনায় চার জন নিহত হন। তার অভিঘাত পড়ে রাজ্য রাজনীতিতে। অভিঘাত পরে কোচবিহারের পুলিশ সুপার দেবাশিসের জীবনেও। এই লোকসভা ভোটের প্রার্থীর জীবন বদলে দিয়েছিল সেই বিধানসভা ভোট।
দেবাশিসের দুই আদরের সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে গিয়েছিল। চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা, নানা মামলায় তদন্তের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যেই নিজের কন্যা এবং মায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। আড়াই বছর হয়ে গেল দেবাশিস তাঁর আত্মজার মুখ দেখতে পাননি। আড়াই বছর হয়ে গেল দেবাশিসের মুখদর্শন করতে চান না তাঁর গর্ভধারিনী মা-ও। আনন্দবাজার অনলাইনকে দেবাশিস বলেন, ‘‘আমার কন্যা আগে থেকেই ওর মায়ের সঙ্গে থাকত। আদালতের নির্দেশে সপ্তাহে এক দিন দেখা করতাম। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যখন একের পর এক মামলা, হেনস্থা তখন মেয়েই আমাকে ওর কাছে যেতে বারণ করে দেয়।’’ কিছুটা অবসন্ন সুরেই দেবাশিস বলতে থাকেন, ‘‘সেই থেকে আড়াই বছর বুকে পাথর চেপে অপেক্ষায় আছি। মেয়ের মুখটাও দেখা হয়নি। ও তো এ বার পনেরোয় পা রাখল।’’
বিজেপি প্রার্থী হিসেবে নামঘোষণার কয়েক দিন আগেই পুলিশের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন দেবাশিস। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের অফিসার দেবাশিস ২০১০ সালে আইপিএস হন। একের পরে এক দায়িত্ব সামলে ২০২১ সালের ভোটের সময় কোচবিহারের পুলিশ সুপার হয়েছিলেন। সেই সময়ে দিনহাটায় বিজেপি কর্মীর দেহ উদ্ধার ঘিরে অশান্তি ছড়ানোর পরে কোচবিহারের তৎকালীন পুলিশ সুপার কে কান্ননকে বদলি করে নির্বাচন কমিশন। দায়িত্বে আসেন দেবাশিস।
শীতলখুচির ঘটনার পরে রাজ্য বিজেপি একটি ‘অডিয়ো ক্লিপ’ প্রকাশ করে দাবি করে সেটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দাবি করা হয়, শীতলখুচির তৃণমূলপ্রার্থী পার্থপ্রতিম রায়ের সঙ্গে মমতা কথা বলছিলেন। সেখানে নানা রাজনৈতিক পরামর্শ দিতে শোনা যায় এক নারীকণ্ঠকে। যা মমতার বলে দাবি করা হয়। পরে সেই অডিয়োর সত্যতা স্বীকার করে নেয় তৃণমূল। এর পরে অভিযোগ ওঠে, ওই অডিয়ো ক্লিপ বিজেপির হাতে তুলে দিয়েছেন দেবাশিস। এর পরেই ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’ বা বাধ্যতামূলক প্রতীক্ষায় পাঠানো হয় দেবাশিসকে। কোনও পদোন্নতিও হয়নি। শেষে উর্দি ছেড়ে পদ্মের উত্তরীয় নিয়েছেন দেবাশিস।
বিধানসভা নির্বাচনের পরে দেবাশিসের বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পত্তির মামলায় তদন্ত শুরু করেছিল রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি। তাঁর বাড়িতে সিআইডি তল্লাশি চালিয়েছিল। এক ব্যবসায়ীর সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ পাওয়া যায় বলে দাবি করে সিআইডি। সেই সময়ে দেবাশিসের সরকারি আধিকারিক মায়ের বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়। মেয়ের পরে মায়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে দেয় সেই তল্লাশি। দেবাশিস বলেন, ‘‘বাড়িতে তল্লাশিটা মেনে নিতে পারেননি মা। আমার মুখদর্শন করবেন না বলে জানিয়ে দেন। বলেন, আমায় শান্তিতে মরতে দে!’’ সেই থেকে আর তিনি মায়ের কাছে যাননি বলে জানান দেবাশিস। বলেন, ‘‘মা এখন খুবই অসুস্থ। শয্যাশায়ী। ফোনে খোঁজ নিই। কিন্তু মায়ের কাছে গত প্রায় আড়াই বছরে একটি দিনের জন্যও যাইনি।’’
দিনের পর দিন চাকরিতে পদোন্নতি না হওয়ায় আর্থিক চাপে পড়ে দেবাশিস অন্য রাজ্যে বা দিল্লিতে চলে যেতে চেয়েছিলেন। সেই জন্যই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে যোগাযোগ করেন। সেই সূত্রেই তাঁর বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের সঙ্গে কথা, আলোচনা, অনলাইনে পদ্মে যোগ এবং শেষপর্যন্ত বীরভূমে প্রার্থী। ভোট জিতে দলের হয়ে, দেশের হয়ে কাজ করতে চান দেবাশিস। সঙ্গে তাঁর হারিয়ে যাওয়া দুই আদরের সম্পর্ককেও ফিরে পেতে চান। বললেন, ‘‘আমি যদি সাংসদ হতে পারি, যদি কোনও বড় পদ পাই, তা হলে হয়তো আবার সব কিছু আগের মতো হতে পারে। আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে মেয়ে হয়তো আমার সামনে আসতে রাজি হবে। ‘বাবা’ বলে ডাকবে। আমিও মায়ের কাছে গিয়ে বসতে পারব সেই আগের মতো।’’