‘হিন্দুত্ব’ শব্দ ব্যবহার করে প্রথম গ্রন্থ শিকাগো বক্তৃতারও একবছর আগে, এক বাঙালির কলমে। কে সেই বাঙালি?

সাভারকারের দৌলতে (Hindutva: Who is a Hindu গ্রন্থের সুবাদে) ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির ব্যবহার ও মর্যাদা নিঃসন্দেহে বেড়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, হিন্দু মহাসভার বরিষ্ঠ কার্যকর্তা, সভাপতি। কিন্তু তারও ৩১ বছর আগে বাংলার বুকে হুগলী জেলার সিঙ্গুরের কাছে কৈকালা গ্রাম থেকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের পুরোধা হয়ে নেতৃত্ব দিলেন যে বাঙালি, যে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজসেবী ও প্রাক্তন আমলা শ্রী চন্দ্রনাথ বসু (৩১ শে আগষ্ট ১৮৪৪ – ২০ শে জুন, ১৯১০), তাঁকে কি আমরা মনে রেখেছি? বাংলার নবজাগরণকে প্রকৃতার্থে কেন ‘হিন্দু নবজাগরণ’ বলা হবে, তার চিহ্ন সংকেত কিন্তু নিহিত ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতেই। আর এই বৃত্তে চন্দ্রনাথকে ধরে যে ‘পঞ্চতত্ত্ব’-র উজ্জ্বল আভা আমরা জ্বলতে দেখলাম, তার মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস-বঙ্কিমচন্দ্র-ভূদেব মুখোপাধ্যায়-শশধর তর্কচূড়ামণি-চন্দ্রনাথ বসুর নামও আসবে। যদি প্রকৃত অর্থে ‘সিঙ্গুর আন্দোলন লোকাল’ এই নামে কোনো ট্রেন চালু রাখতেই হয়, তা বাঙালির কর্মনাশের কারখানা বন্ধ করার জন্য নয়, বাঙালি হিন্দুর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক আন্দোলন গড়ে ওঠার চন্দ্রনাথীয় প্রচেষ্টার জন্য।

ভূদেব, বঙ্কিম ও শশধরের প্রেরণা ও উৎসাহে চন্দ্রনাথের হিন্দুত্বের অভিমুখে যাত্রা। শশধর ও বঙ্কিমচন্দ্রের উপর ছিল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অপরিসীম স্নেহ ও আশীর্বাদ। এইরকম একটা আবহে ১৮৯২ সালে চন্দ্রনাথ বসু রচনা করলেন ‘হিন্দুত্ব’ নামক এক তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ, যা নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন পরবর্তী জাতীয়তাবাদী সনাতনী নেতৃবৃন্দ ও সাহিত্যিক মহল। এই বই কে কে পড়েছেন তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু স্বামীজি নিশ্চয়ই বইটির খবর রেখেছেন, কারণ বইয়ের ভাবনার সঙ্গেও স্বামীজির ভাবনার বহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

বইটিতে লেখক পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতবর্ষের প্রাচীন বৈভবের গর্ব করা মনুষ্যত্ব নয়, মনুষ্যত্ব হল প্রাচীন বৈভবের পুনর্লাভ করা। তার কারণ ভারতবর্ষের প্রাচীন বৈভবের মতো বৈভব বিশ্বে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। লেখক হিন্দু, হিন্দুত্ব ও হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সর্বত্র অত্যুচ্চ মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, হিন্দুর মন জগতের ছাঁচে ঢালা (Cosmically constituted), এমন বিরাট মন অন্য কোনো ধর্মে নেই। হিন্দুর মনের মতো সমগ্রগাহী, সমগ্রব্যাপী মন পৃথিবীতে আর পাওয়া যাবে না। প্রকৃত হিন্দু বলতে তিনি অসাধারণ মৌলিকতা সম্পন্ন বিরাট মানুষকে বুঝিয়েছেন। ভারতীয় হিন্দুকে কখনো কারো কাছে বিন্দুমাত্র ঋণী হতে হয় নি। না ধর্মশাস্ত্রে, না দেবতত্ত্বে, না দর্শনে, না বিজ্ঞান- সমাজ প্রণালীতে। তাঁর মত হল, হিন্দুত্বের আলোচনায় হিন্দুমাত্রেরই প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। প্রাচীন গৌরবে কেবল গর্ব অনুভব না করে, প্রকৃত হিন্দু হওয়ার মতো কঠিন কাজটি তিনি সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন সবাইকে। তাঁর মতে এটি এক মহৎ কাজ।

চন্দ্রনাথ বসু ভারতীয় হিন্দুদের সামনে হিন্দুত্বের এক বিরাট কাজের অবধারণা দিয়েছেন। যে কাজ সম্পন্ন হলেই আমরা প্রাচীন বৈভবে গর্ব করবার অধিকারী হবো৷

বইটির সূচী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে সোহহং, লয়, নিষ্কাম ধর্ম, আহার, ব্রহ্মচর্য, বিবাহ, দেবতা, মূর্তিপূজা, মৈত্রী ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বলেছেন হিন্দুর হিন্দুত্ব হচ্ছে ‘সোহহং’ এই কথায়, সেই আমি — মানুষই সেই পরব্রহ্ম। এটিই হিন্দুর লক্ষণ, হিন্দুত্বের লক্ষণ, হিন্দুধর্মের লক্ষণ। বলেছেন ব্রহ্ম যে পদার্থ, ব্রহ্মাণ্ডও সেই পদার্থেই নির্মিত। ব্রহ্মই ব্রহ্মাণ্ডের উপাদান, সৃষ্টিকর্তাই সৃষ্টির উপাদান। খৃষ্টান ধর্মে বলা হয়, সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং যে বস্তু, সৃষ্ট জগৎ সে বস্তু নয়, সে বস্তু থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।

চন্দ্রনাথ বসুর হিন্দুত্ব বইটির পাতায় পাতায় হিন্দু ধর্মের সার কথা মণিমাণিক্যের মতো থরেবিথরে সাজানো রয়েছে। বইটি সুখপাঠ্য।

কল্যাণ গৌতম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.