আরও একটা বছর বয়স বাড়ল লিয়োনেল মেসির। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর জন্য ভেসে আসছে শুভেচ্ছা বার্তা। তাতে যেমন খ্যাতনামীরা রয়েছেন তেমনই রয়েছেন মেসির কোটি কোটি ভক্ত। সে তো প্রতি বছরই হয়। তবে এ বার কিছুটা আলাদা। নিজের ৩৬ বছরের জন্মদিনটা হয়তো সব থেকে আনন্দ করে পালন করবেন মেসি। পরিবারের সঙ্গেই হয়তো থাকবেন। কিন্তু মনের মধ্যে শান্তিটা অন্য সব বারের থেকে বেশি থাকবে। কারণ, এই একটা বছরে যে নিজের সব থেকে প্রিয় উপহার পেয়ে গিয়েছেন মেসি। ফুটবল বিশ্বকাপ। ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করার পরে এটিই মেসির প্রথম জন্মদিন।
এক বছর আগে মেসি যখন নিজের ৩৫তম জন্মদিন পালন করছিলেন তখন তাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে দেশের হয়ে দুটো ট্রফি জেতা হয়ে গিয়েছে। ২০২১ সালে পেয়েছেন কোপা আমেরিকা। ২৮ বছরে পরে আবার লাতিন আমেরিকার সেরা দল হয়েছে আর্জেন্টিনা। পরের বছর জন্মদিনের মাসেই জিতেছেন ফাইনালিসিমা। ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন ইটালিকে হেলায় হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। কিন্তু তখনও বোধ হয় বুকের বাঁ দিকটায় হালকা খচখচানি থাকতই। কারণ, অধরা ছিল বিশ্বকাপ। বার বার সাক্ষাৎকারে যিনি বলেছেন, সাতটি বালঁ দ্যর-এর থেকে একটি বিশ্বকাপ তাঁর কাছে বেশি দামি, তাঁর তো খারাপ লাগারই কথা। কারণ, ওই ট্রফিটা না পেলে যে আর্জেন্টিনাবাসীর কাছে মারাদোনার পরে দ্বিতীয় স্থানেই থেকে যেতে হত তাঁকে। শ্রেষ্ঠ হওয়া হত না।
তাই একটাই লক্ষ্য ছিল মেসির। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপটা জিততেই হবে। যে করেই হোক। কাতারের বিশ্বকাপ জেতার প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। অন্য দলের মতো হোটেলে না থেকে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সঙ্গে করে খাবার ও রাঁধুনি নিয়ে গিয়েছিলেন মেসিরা। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, কিলিয়ান এমবাপের মতো তারকারা থাকলেও বিশ্বকাপের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সেই মেসি। তিনি কী করছেন, কী বলছেন সে দিকেই নজর ছিল সংবাদমাধ্যমের। মেসিদের অনুশীলনে থাকত সব থেকে বেশি ভিড়।
বিশ্বকাপের শুরুটাই যে এ ভাবে হবে তা ভাবতে পারেননি মেসি। প্রথম ম্যাচে ফিফা ক্রমতালিকায় ৫০-এর বাইরে থাকা সৌদি আরবের কাছে হার। আবার প্রশ্ন শুরু হয়েছিল, এ বারও কি ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হবে মেসিকে? হতাশ ছিলেন লিয়ো। তিনি নিজে সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘‘মনে হচ্ছে যেন মারা গিয়েছি।’’ কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। দলকে এক জায়গায় জড়ো করেছিলেন। নেতার মতো সবার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘‘পরের দুটো ম্যাচ জিততেই হবে।’’ লিয়োর কথা মেনে নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিয়েছিলেন দলের বাকি সব ফুটবলার। কাতার বিশ্বকাপেই যেন প্রকৃত অর্থে নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন মেসি। যেখানে তিনিই শেষ কথা। গোটা দলটা খেলছে তাঁকে জেতাতে। ঠিক যে ভাবে ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে সচিন তেন্ডুলকরকে জেতাতে খেলেছিলেন ভারতের বাকি সব ক্রিকেটার। আর যখন একটা দলের ফুটবলারেরা এতটা তাগিদ দেখান তখন তাঁদের খেলাটাই বদলে যায়। আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। বিশ্বকাপ জিতে তবে থেমেছিলেন মেসিরা।
বিশ্বকাপের আগে মেসির সমালোচকেরা বলতেন, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, আর মেসি ক্লাব ফুটবলে।’ দেশের জার্সি গায়ে দিলেও যেন একটি খোলসের মধ্যে ঢুকে যান লিয়ো। ট্রফি জেতানোর চাপ নিতে পারেন না। তাই বার বার কেঁদে বিদায় নিতে হয় তাঁকে। এ বার সেই সমালোচকেদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন মেসি। এক নতুন মেসিকে দেখেছে ফুটবল দুনিয়া। যিনি মাঠের মধ্যে আগ্রাসী। প্রতিপক্ষ ফুটবলার থেকে কোচ, কাউকে রেয়াত করেন না। চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। বিতর্ক হবে জেনেও পিছপা হন না। মেসিই একমাত্র ফুটবলার যিনি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব, প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করেছেন। গ্রুপ পর্বে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি না ফস্কালে বিশ্বকাপের সাতটি ম্যাচেই গোল করার নজির গড়তে পারতেন লিয়ো।
বিশ্বকাপ জেতার আগেই অবশ্য আর্জেন্টিনার সমর্থকদের নয়ণের মণি হয়ে উঠেছিলেন লিয়ো। তাঁর টানেই প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে হাজার হাজার সমর্থক পাড়ি দিয়েছিলেন কাতার। খোলা আকাশের নীচে শুয়েছেন, কিন্তু প্রতিটি ম্যাচে আকাশি-সাদা জার্সিধারিদের জন্য গলা ফাটিয়েছেন। বৃদ্ধ থেকে শিশু, সবাই ছিল সেই তালিকায়। প্রথম ম্যাচে হারের পরেও তাই তাঁরা মেসির উপর থেকে বিশ্বাস হারাননি। এমনকি, ফাইনালে ওঠার পরে আর্জেন্টিনার এক মহিলা সাংবাদিক মেসির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বলেই ফেলেন, ‘‘তুমি বিশ্বকাপ জেত বা না জেত, তাতে তোমার উপর থেকে আমাদের বিশ্বাস এক চিলতেও কমবে না। তুমি দেশের কোটি কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছ। তাদের আনন্দ দিয়েছ। লিয়ো, তোমাকে একটা কথাই বলতে চাই। ধন্যবাদ।’’
বিশ্বকাপ জেতার পরে মেসি যখন দলের সঙ্গে বুয়েনস আইরেসে পা দেন, তখন সেখানকার রাস্তায় নেমে পড়েছেন সবাই। সেই উচ্ছ্বাসে শামিল হয়েছিলেন মেসিও। নিজের শহর রোসারিয়োতে গিয়ে বাড়ি ঢুকতে পারছিলেন না মেসি। তাঁকে দেখতে গোটা শহর ভিড় করে। কিন্তু তার পরেও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। কখনও পরিবারের কারও জন্মদিন পালন করেছেন। কখনও স্ত্রী আন্তোনেল্লা ও তিন সন্তানের সঙ্গে দেখা গিয়েছে মেসিকে। বিশ্বকাপে মেসি যখন মাঠে খেলছেন তখন মাঠের বাইরে থেকে সমানে তাঁকে ভরসা জুগিয়েছে তাঁর পরিবার। সেই কারণে, ট্রফি জেতার পরে সবাইকে মাঠে ডেকে নিয়েছেন। একসঙ্গে উল্লাস করেছেন। ছবি তুলেছেন। বিশ্বকাপের আগে ও পরে এই একটা জিনিসই বদলায়নি মেসির জীবনে। সেটা হল পরিবারের সঙ্গে তাঁর সমীকরণ। আদ্যন্ত পারিবারিক লিয়োর লড়াইয়ের শক্তি যে তাঁর পরিবার। সব ঝড়-ঝাপ্টায় পাশে থেকেছেন স্ত্রী, সন্তান, মা। যাঁদের সঙ্গে জীবনের সব থেকে খারাপ মুহূর্ত কাটিয়েছেন, সব থেকে সুন্দর মুহূর্তে পাশে থাকার অধিকার তো তাঁদেরই সব থেকে বেশি।
দেশের হয়ে ভাল সময় কাটালেও গত এক বছরে ক্লাবের হয়ে সময়টা ভাল যায়নি মেসির। প্যারিস সঁ জরমঁ-র সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হয়েছে। ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতার পরে সেটা যেন আরও বেড়েছে। প্যারিসের ক্লাবের হয়ে মাঠে নামার সময় সমর্থকদের বিদ্রুপ শুনতে হয়েছে। সতীর্থদের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তাই আর প্যারিসে থাকেননি মেসি। চুক্তি বৃদ্ধি করেননি। মেসি প্যারিস ছাড়বেন এ কথা শুনে ঝাঁপিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্লাব। সৌদি আরব, স্পেন তালিকায় থাকলেও মেসি বেছে নিয়েছেন আমেরিকার মেজর সকার লিগের ক্লাব ইন্টার মায়ামিকে। পরের মাসেই নতুন ক্লাবের হয়ে নেমে পড়বেন তিনি।
কাতারে নামার আগেই মেসি জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ বারই শেষ। আর বিশ্বকাপ খেলবেন না। বিশ্বকাপ জেতার পরে অবশ্য অবসর নেননি তিনি। জানিয়েছেন, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে আরও কিছু দিন খেলতে চান। মেসি-ভক্তরা চান, ২০২৬ সালের বিশ্বকাপেও তিনি খেলুন। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে মেসি জানিয়েছেন, আর বিশ্বকাপে নামবেন না তিনি। কত দিন আর খেলবেন মেসি? উত্তর অজানা। পরিবারের সঙ্গে জন্মদিনের আনন্দ করতে করতেই হয়তো সেই সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলবেন লিয়ো।