ডেঙ্গির চেহারা বদলে গিয়েছে, কোভিডের পরে আরও ভয়ানক! বিভ্রান্ত চিকিৎসকেরাও

ডায়মন্ড হারবার থেকে এক মহিলা কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর চামড়া ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। শরীরের ভিতরেও রক্তপাত। প্লেটলেট, ভিটামিন কে দিয়ে রক্তপাত কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। অন্য দিকে, দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক ডেঙ্গি রোগীকে নিয়ে নাজেহাল চিকিৎসকেরা। তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ধনুষ্টঙ্কার হলে রোগী যেমন বেঁকে যান, এ ক্ষেত্রেও তা-ই হচ্ছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা ডেঙ্গির এমন উপসর্গ আগে দেখেছেন বলে মনেই করতে পারছেন না। শহরের এক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের দাবি, রক্তচাপ বাড়ানোর চার রকম ওষুধ প্রয়োগ করেও তা বাড়ানো যাচ্ছে না। কিডনি ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দেওয়াতেই রোগীর এই অবস্থা বলে তাঁর মত।

চিকিৎসকদের দাবি, ডেঙ্গি আক্রান্ত হওয়ার ৪-৫ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক চিকিৎসকের মন্তব্য, ‘‘এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। আমাদের কে যে বোকা বানাচ্ছে তা-ই বুঝতে পারছি না। এ বারে সংক্রমণের হার ২০১৩-১৪-র কাছাকাছি থাকলেও, ভয় দেখাচ্ছে ডেঙ্গির নিত্যনতুন উপসর্গ। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে যখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,‌ তত ক্ষণে তাঁর মাল্টিঅর্গান ফেলিওর শুরু হয়ে গিয়েছে।’’

২০১৩-১৪ সালে কলকাতায় ডেঙ্গি সংক্রমণ হঠাৎ করেই লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তখন যে কয়েক জন চিকিৎসক ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন তাঁদের অন্যতম পরজীবী বিষয়ক বিজ্ঞানী স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিতাভ নন্দী। ডেঙ্গির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আছেন তিনি। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘এ বার প্রথম যখন সংক্রমণ শুরু হল, তখন উপসর্গ ছিল একেবারেই মামুলি। বলা হল ডেঙ্গ থ্রি ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। ডেঙ্গি ভাইরাসের এই প্রজাতিতে রোগীর অবস্থা কখনই আয়ত্তের বাইরে চলে যায় না। নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম।’’ কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে উপসর্গের যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে তাতে বিস্মিত অমিতাভ। তিনি বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা এত তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে, আমরা চিকিৎসার সুযোগই পাচ্ছি না। ২০১৩-১৪ সালে ডেঙ্গিতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

রোগটা বুঝতে না পারায়। কারও যে ডেঙ্গি হয়েছে তা বুঝতে পারার আগেই আক্রান্তের মৃত্যু হচ্ছিল। সেই রোগ একটা নতুন নাম পেয়েছিল— অজানা জ্বর। ডেঙ্গি-সংক্রমিত এলাকার মানুষের মধ্যে ওই ভাইরাসের চার প্রজাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) তৈরি হয়েছিল। তাই ধীরে ধীরে মৃত্যু হারও কমছিল। আর মানুষের ভয়টা কমছিল। কোভিডজয়ী অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন, যেখানে কোভিড কাবু করতে পারেনি, সেখানে ডেঙ্গি কোন ছার!’’

অধিকাংশ মানুষ যেমন মাস্ক ছাড়াই জনসমুদ্রে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, তেমনই ‘অভিজাত’ এলাকার বড় অংশের মানুষ মশারি খাটিয়ে শোয়ার ‘বদভ্যাস’ ত্যাগ করে সাহসী হয়ে উঠেছেন। ডেঙ্গি নিয়ে লেখালেখি করার দীর্ঘ অভ্যাসে আমি বুঝেছি, প্রধানত চারটি কারণে ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত হয়।

১) মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি

২) স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারির অভাব

৩) মানুষের সচেতনতার অভাব, যেমন মশারি ব্যবহার না করা, জল জমিয়ে রাখা এবং

৪) জীবাণুর চরিত্র বদলে যাওয়া।

নজরদারির অভাব আর সচেতন হওয়া এই দু’টি বিষয়ে নগরবাসীকে কোনও ভাবেই পাশ মার্ক দেওয়া যাবে না। এই দুই ‘মারাত্মক ব্যাধি’ থেকে মুক্তি পাওয়া শক্ত। আর জীবাণু চরিত্র বুঝতে পারায় মানুষ কোন ছার, তা শিবেরও অসাধ্য। এ বারের ডেঙ্গির অতি সংক্রমণের জন্য এই দু’টি কারণকে স্বাভাবিক ভাবেই অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে। অমিতাভর ব্যাখ্যা, ‘‘এত দিন ধরে ডেঙ্গি রোগীর চিকিৎসা করছি, কিন্তু এ ভাবে গায়ের চামড়া ফেটে রক্ত বেরোতে দেখিনি। কোনও রোগীকে মস্তিষ্কের রক্তপাতে ধনুষ্টঙ্কার রোগীর মতো বেঁকে যেতেও দেখিনি। কোভিড ও তার প্রতিষেধকের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক আছে কি না সেটাই খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।’’ প্রবীণ এই চিকিৎসকের মনে হয়েছে, কোভিড অথবা তার প্রতিষেধক কিংবা দুটোরই মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে নির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।

মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াতেই সংক্রমণ খুব তাড়াতাড়ি এতটা ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে। এ ব্যাপারে গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন ওই পরজীবী বিষয়ক বিজ্ঞানী।

বাকি যে বিষয়গুলিকে অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা কাঠগড়ায় তুলছেন তার মধ্যে অন্যতম, এ বারের বর্ষার ধরন। আর জীবাণুর চরিত্র পরিবর্তন। অভিজ্ঞ এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘এ বার বর্ষা হয়েছে খেপে খেপে। একটানা প্রবল বৃষ্টি হয়নি। একটানা ভারী বৃষ্টি হলে জল জমতে পারে না। মশারা জলে ডিম পাড়লেও তা ধুয়ে চলে যায়। ফলে সংক্রমণের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়। কিন্ত এ বার খেপে খেপে বৃষ্টি হওয়ায় খানাখন্দে, ভাঙা বাড়ির গর্তে জল জমে থেকেছে অনেক দিন ধরে। মশার ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা তৈরি হয়েছে অনেক বেশি। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো উচিত ছিল।’’

একটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের এক ভাইরোলজিস্টের মন্তব্য, প্রথমে আপাত নিরীহ ডেঙ্গ থ্রি-র সংক্রমণ হওয়ায় অনেকেই নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু নিরীহ ভাইরাসই চরিত্র বদলে এতটা ভয়ঙ্কর হয়েছে কি না তা এখনও দেখা হয়নি। কেউ কেউ আবার বলছেন, শরীরের মধ্যে থাকা অন্য জীবাণুর সঙ্গে জোট বেঁধে ডেঙ্গ থ্রি এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছে কি না সেটাও দেখা দরকার। সামান্য একটি ভাইরাস আর তার বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশা মিলে এ বার বড় শিক্ষা দিচ্ছে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং প্রশাসনের বড় কর্তাদের!

এই শিক্ষার প্রতিফলন আগামী বছরে ডেঙ্গি প্রতিরোধ ব্যবস্থায় কোনও পরিবর্তন আনে কি না সেটাই দেখার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.