নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’কে বুধবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হয়েছিল। বিচারক তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, আপাতত ১৪ দিন সুজয়কে ইডি হেফাজতে থাকতে হবে। আদালতে তোলার আগে তাঁকে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য জোকা ইএসআই হাসপাতালে গিয়েছিল ইডি। আদালতে ইডি জানায়, সুজয় কিছু খেতে চাইছেন না। এর ফলে তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাতে তদন্তপ্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইডির দাবি, নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে অন্য ধৃত এবং অভিযুক্তদের (যাঁদের মুখে বার বার ‘কালীঘাটের কাকু’ নামটি শোনা গিয়েছে) বয়ান সামনে রেখে ‘কালীঘাটের কাকু’কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। এমনকি মোবাইল ফোনে তাঁর সামনে যাবতীয় তথ্য তুলে ধরা হলেও, তিনি তা মানতে অস্বীকার করেন। তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠেছে সুজয়ের বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে তাঁর যোগের কথাও আদালতে তুলে ধরেন গোয়েন্দারা। তাঁদের মূল অভিযোগ, ধৃত ও অভিযুক্তদের বয়ান এবং সঙ্গে সুজয়ের বয়ান মেলানো যাচ্ছে না।
জেরার মুখে সুজয় দাবি করেছেন, তিনি মানিককে ২০২১ সালের আগে চিনতেন না। কিন্তু ইডির দাবি, মানিকের হোয়াটস্অ্যাপ কথোপকথন ঘেঁটে ২০১৮ সাল থেকে সুজয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। মানিক গ্রেফতার হন ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর। অর্থাৎ, অন্তত ৭ মাস আগে থেকেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের নজরে রয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসের প্রাক্তন কর্মী এই ‘কালীঘাটের কাকু’। ইডি আদালতে জানিয়েছে, ২০১৪ সালের টেট প্রার্থীদের বেআইনি নিয়োগের জন্য এই সুজয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কুন্তল। বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা নিজে তা স্বীকারও করেছেন। সেই সময় সুজয়কে কুন্তল ৭০ লক্ষ টাকা দেন। সুজয়ের কথাতেই আরও ১০ লক্ষ পৌঁছে দেন পার্থের কাছেও। এ ছাড়া, তাপস মণ্ডলের বয়ানও আদালতে ইডি জানিয়েছে। তাঁর দাবি অনুযায়ী ৩২৩ জন টেট প্রার্থীর নাম এবং যাবতীয় তথ্যের তালিকা ‘কাকু’র কাছে পাঠানো হয়েছিল। সুজয় মারফত সেগুলি পৌঁছে যায় মানিকের কাছে।
তাপস মণ্ডলের মুখে এই সুজয়ের নাম প্রথম শোনা গিয়েছিল। গোপাল দলপতিও ‘কালীঘাটের কাকু’র নাম করেছিলেন। সিবিআই সুজয়কে দু’বার তলব করে। প্রথম বার সিবিআই দফতরে গিয়ে হাজিরা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরের বার নিজের আইনজীবীকে দিয়ে নথিপত্র পাঠিয়েছিলেন। অভিষেককে নিজের ‘সাহেব’ বলে দাবিও করেন সুজয়। নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংস্থার কাছ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা মূল্যের জমিতে বিনিয়োগ করেছিলেন কাকু। যে কথা তিনি নিজেও স্বীকার করেন। গত ৪ মে সুজয়ের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়েছিল সিবিআই। সেই তল্লাশি অভিযানে সুজয়ের বাড়ি থেকে কয়েক লক্ষ নগদ টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। তার পর ২০ মে সুজয়ের বেহালার ফকিরপাড়া রোডের ফ্ল্যাট, বাড়ি, অফিস-সহ বহু জায়গায় তল্লাশি চালায় ইডি। ওই দিনই নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তল ঘোষের চিঠি সংক্রান্ত মামলায় অভিষেককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ‘কাকু’র সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন ৩টি সংস্থাতেও তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। তার পর তাঁকে মঙ্গলবার ডেকে পাঠানো হয়। দীর্ঘ জিজ্ঞাবাদের পর গ্রেফতার হন সুজয়।
ইডি হেফাজতে ১৪ দিন
বুধবার ‘কালীঘাটের কাকু’র জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেননি বিচারক। তাঁকে ব্যাঙ্কশাল আদালেত তোলা হয়েছিল। বিচারক ১৪ দিনের ইডি হেফাজতের নির্দেশ দেন সুজয়কে। তাঁর আইনজীবী সেলিম রহমান আদালতে দাবি করেন, ইডির এই গ্রেফতারি বেআইনি। তাঁদের অ্যারেস্ট মেমো দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। সুজয় এবং তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ তুলে তিনি জানান, তাঁদের কন্যা বিবাহিত। স্ত্রীর দেখাশোনা করেন সুজয়ই। তাঁর নিজেরও শারীরিক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এই সব যুক্তি আদালতে গ্রাহ্য হয়নি।
‘অনশনে’ আশঙ্কা
ইডি সুজয়কে নিয়ে বুধবার সকালে আদালতে জোকা ইএসআই হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গিয়েছিল। সেখান থেকে আদালতে যাওয়ার পর বিচারককে কেন্দ্রীয় সংস্থা জানায়, ‘কালীঘাটের কাকু’ কিছু খেতে চাইছেন না। তাঁর এই ‘অনশনের’ ফলে আদতে তদন্তের ক্ষতি হবে। ইডির আশঙ্কা, না খেয়ে সুজয়ের শরীর খারাপ হয়ে পড়বে এবং তাতে তদন্ত ব্যাহত হবে।
পার্থকে ১০ লাখ
রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ১০ লক্ষ টাকা দিতে বলেছিলেন ‘কালীঘাটের কাকু’, আদালতে তেমনই জানিয়েছে ইডি। তাদের দাবি, কুন্তল বয়ানে জানিয়েছেন, তিনি সুজয়কে ৭০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। তাঁর কথাতেই আরও ১০ লক্ষ টাকা দেন পার্থকেও। ২০১৪ সালের কয়েক জন টেট প্রার্থীর বেআইনি নিয়োগের জন্য ‘কাকু’র সঙ্গে কুন্তল যোগাযোগ করেছিলেন।
বয়ানে অসঙ্গতি
সুজয়ের বয়ানের সঙ্গে নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত ও অভিযুক্ত (যাঁদের মুখে বার বার ‘কালীঘাটের কাকু’ নামটি শোনা গিয়েছে) অন্যদের বয়ানের অসঙ্গতি রয়েছে বলে দাবি ইডির। অভিযোগ, সুজয় একাধিক তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছেন। অন্য বয়ান সামনে রেখে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। যাবতীয় অভিযোগ মানতে অস্বীকার করেছেন বার বার।
মানিকের সঙ্গে যোগ
সুজয় তাঁর বয়ানে দাবি করেছেন, তিনি মানিককে ২০২১ সালের আগে চিনতেন না। কিন্তু তদন্তে ইডির হাতে এসেছে অন্য তথ্য। মানিকের হোয়াটস্অ্যাপ কথোপকথন ঘেঁটে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা দেখেছেন, তাঁর সঙ্গে সুজয়ের যোগাযোগ রয়েছে অন্তত ২০১৮ সাল থেকে। ওই সময় থেকেই মানিককে বহু টেট প্রার্থীর নথি সুজয় পাঠিয়েছিলেন। পাঠানো হয়েছিল মার্কশিট এবং অ্যাডমিট কার্ডও।
তাপসের দাবি
নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে অপর ধৃত তাপস মণ্ডলও ‘কালীঘাটের কাকু’র সঙ্গে বেআইনি নিয়োগ সংক্রান্ত যোগাযোগের কথা ইডিকে জানিয়েছেন। গত বছর নভেম্বরে তাপসের বয়ান অনুযায়ী, ৩২৩ জন টেট প্রার্থীর তালিকা সুজয়কে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে সেই তালিকা পাঠানো হয় মানিকের কাছে।
সাত মাস ধরে নজরে
মানিক গ্রেফতার হন ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর। তার আগে তাঁর বাড়িতে দীর্ঘ তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। সেই সময়েই মানিকের হোয়াটস্অ্যাপ ঘেঁটে ‘কালীঘাটের কাকু’কে পাওয়া গিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে গত ৭ মাস ধরেই সুজয় গোয়েন্দাদের নজরে রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করছিল ইডি।