আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারই জড়িত। মঙ্গলবার নিম্ন আদালতে যে ৪৫ পাতার চার্জশিট জমা দিয়েছে সিবিআই, তা আনন্দবাজার অনলাইনের হেফাজতে রয়েছে। সেই চার্জশিটের পাতায় পাতায় উল্লেখ রয়েছে অভিযুক্তের বিস্তারিত গতিবিধি। রয়েছে আরও তদন্তে নেমে পাওয়া আরও নানা তথ্যও। সিবিআইয়ের চার্জশিটে নির্যাতিতাকে ‘ভি’ (ভিক্টিম) বলে উল্লেখ করেছে। তবে সর্বত্রই ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম উল্লেখ করেছে।
চার্জশিটে সিবিআই যা জানিয়েছে, তার মর্মার্থ— ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারই ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় জড়িত। ৯ অগস্ট ভোরে তিনিই ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন। সিসিটিভি-র ফুটেজ এবং পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ থেকে সে বিষয়ে নিশ্চিত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে আলাদা ভাবে চার্জশিটে জানিয়েছে সিবিআই। সেই মর্মে তাঁদের জেরা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, তাঁদের সরাসরি ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় জড়িত বলে মনে করছে না সিবিআই।
সিভিকের দুপুরের গতিবিধি
সিবিআই তাদের চার্জশিটে ঘটনা ঘটার প্রায় ১৬ ঘণ্টা আগে থেকে ধৃতের গতিবিধির উল্লেখ রয়েছে। সিবিআই জানিয়েছে, ৮ অগস্ট দুপুর থেকে ধৃত সিভিকের গতিবিধির পূর্ণাঙ্গ তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। তার বিবরণ দিয়ে সিবিআই বলেছে, কলকাতা পুলিশের ৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ব্যারাক থেকে অভিযুক্ত সিভিক বার হন। সঙ্গে ছিলেন আর এক জন সিভিক। দু’জনে মোটরসাইকেল নিয়ে যান আরজি করে। দ্বিতীয় সিভিকের এক আত্মীয় ভর্তি ছিলেন আরজি করে। তাঁরই খোঁজ নিতে যান দু’জনে। সেই কাজ মিটিয়ে দুপুরেই আরজি কর ছাড়েন দু’জন। তার পরে যান এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের শোভাবাজার শাখায়। তখন ২টো ৪৫ মিনিট। এএসআই অনুপ দত্তের অ্যাকাউন্টে নগদ টাকা জমা দিতে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা করা যায়নি (এই অনুপের সঙ্গে ধৃত সিভিকের ছবি মিলেছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল কলকাতা পুলিশ)। ব্যাঙ্কে কাজ না হওয়ায় দু’জনে মিলে মদ কেনেন। তার পর অভিযুক্ত সিভিক চলে যান আরজি করে। অন্য সিভিক ফিরে যান ব্যারাকে।
রাত থেকে ভোর
চার্জশিটে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা বলেছে, ৮ অগস্ট রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে ধৃত সিভিকের অনুরোধে ব্যারাক থেকে তাঁর দুপুরের সঙ্গী সিভিক পৌঁছন আরজি করে। তার পরে দু’জনেই বেরিয়ে যান হাসপাতাল থেকে। আবার মদ এবং খাবার কিনে দু’জনে যান চেতলার একটি যৌনপল্লিতে। সেখানে কে কী করেছেন, চার্জশিটে তারও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা লিখেছে, চেতলার ওই যৌনপল্লির একটি বাড়িতে ঢোকেন দু’জন এবং বিয়ার কেনেন। ধর্ষণ-খুনে অভিযুক্ত সিভিক যৌনপল্লিতে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হননি। তিনি শুধু বিয়ার পান করেছিলেন। তবে অন্য সিভিক এক যৌনকর্মীর সঙ্গে ঘরে ঢুকেছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে দুই সিভিকই ৯ অগস্ট ভোর ৩টে ২০ মিনিটে আরজি করে পৌঁছন।
অপরাধ
সিবিআই চার্জশিট বলছে, অভিযুক্ত সিভিককে আরজি করে নামিয়ে দিয়ে অন্য সিভিক ভলান্টিয়ার ব্যারাকের উদ্দেশে রওনা দেন। অভিযুক্ত সিভিক যান ট্রমা কেয়ার সেন্টারের দোতলায়। জনৈক শুভ দে-র অস্ত্রোপচারের বিষয়ে খোঁজ নিতে সেখানে গেলেও রোগীর বাড়ির কাউকে তিনি দেখতে পাননি। তার পরে তিনি চলে যান ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের পাঁচতলায়। সেখান থেকে নেমে আসেন চারতলায়। ভোর ৪টে ৩ মিনিটে চেস্ট মেডিসিনের সেমিনার রুমে ঢোকেন ওই সিভিক ভলান্টিয়ার। সেখানেই একা শুয়েছিলেন ওই চিকিৎসক। ধর্ষণ এবং খুনের পরে ভোর ৪টে ৩১মিনিটে সেমিনার রুম থেকে বেরিয়ে যান অভিযুক্ত।
বীর্য এবং লালা ধৃত সিভিকেরই
সিবিআই জানিয়েছে, নির্যাতিতার পোশাক, চাদর এবং মৃতদেহ থেকে সংগ্রহ-করা বীর্য এবং লালার নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, তা ধৃত সিভিকেরই। মিলেছে ছোট চুল। যা ধৃত সিভিকেরই বলে জানিয়েছে সিবিআই। বীর্য এবং লালা নির্যাতিতার দেহের ময়নাতদন্তের সময়েই সংগ্রহ করা হয়েছিল। ধৃতের যে ট্রাউজ়ার্স এবং জুতো পুলিশ উদ্ধার করেছিল, তা থেকেও মৃতার রক্তের দাগ মিলেছে। চার্জশিটে উল্লেখ রয়েছে, নির্যাতিতার কুর্তির দু’টি প্রান্তই ছেঁড়া ছিল। ঘটনাস্থল থেকে নির্যাতিতার যে চশমা উদ্ধার হয়েছিল, তার চশমার একটি কাচ ভাঙা ছিল বলেও চার্জশিটে রয়েছে। বলা হয়েছে, নির্যাতিতার মৃত্যুর কারণ শ্বাসরোধ। তাঁকে গলা টিপে খুন করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মেডিক্যাল বোর্ড
ধর্ষণ এবং খুনের তদন্তের জন্য ডিরেক্টর জেনারেল অফ হেল্থ সার্ভিসেসকে সিবিআই অনুরোধ করেছিল, যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। তারাই ময়নাতদন্ত-সহ সব পরীক্ষা করেছে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন নয়াদিল্লির এমস, রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতাল, লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ, সফদরজং হাসপাতাল এবং মৌলানা আজ়াদ মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন দিল্লি এমসের ফরেন্সিক মেডিসিনের অধ্যাপক আদর্শ কুমার।
নির্যাতিতার প্রতিরোধ ও ময়নাতদন্তের সময়
সিবিআই ৪৫ পাতার চার্জশিটের ২১ নম্বর পাতায় উল্লেখ করেছে, ধর্ষণের সময়ে নির্যাতিতা মরিয়া হয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। যার প্রমাণ মিলেছে ধৃত সিভিকের মেডিক্যাল পরীক্ষায়। চার্জশিটে উল্লেখ রয়েছে, ধৃতের শরীরে পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন মিলেছিল। যা নির্যাতিতার বাধা দেওয়ার চিহ্ন। একই সঙ্গে ময়নাতদন্তে প্রমাণ মিলেছে, বলপ্রয়োগ করে ধর্ষণ করা হয়েছিল তরুণী চিকিৎসককে। সিবিআই চার্জশিটে লিখেছে, ময়নাতদন্তের সময়ে মৃতার দেহ শক্ত (রাইগর মর্টিস) হয়ে গিয়েছিল। যা থেকে স্পষ্ট যে, ময়নাতদন্তের অন্তত ১২-১৮ ঘণ্টা আগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল।
মা এবং বাবা-সহ ১২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ
চার্জশিটের সাতটি পাতা জুড়ে সিবিআই ১২৮ জনের নামের তালিকা দিয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছেন নির্যাতিতার মা, বাবা, প্রতিবেশীও। পাশাপাশিই হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের প্রধান, চিকিৎসক, জুনিয়র ডাক্তার, বিভিন্ন শ্রেণির কর্মীদেরও নাম রয়েছে। তাঁদের নামের পাশাপাশি ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রত্যেকের বয়ান নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেনি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। শুধু একটি জায়গায় মায়ের বয়ানে লেখা রয়েছে, তিনি গিয়ে দেখেছিলেন, মেয়ের চোখ থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।
ফোনের সূত্রেই গ্রেফতার সিভিক
ঘটনাস্থল থেকে মেলা ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের ব্লুটুথ ইয়ার সেট এবং ফোনই যে অনেক কিছু নিশ্চিত করেছে, চার্জশিটে তারও উল্লেখ করেছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার চার্জশিটে বলা হয়েছে, মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন এবং সিসিটিভি-র ফুটেজের সময় মিলে গিয়েছে। যা থেকে তারা নিশ্চিত, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন ধৃত সিভিকই।
নির্যাতিতার সঙ্গীরা কে কোথায়
কলকাতা পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ ছিল, ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার আগে ওই তরুণী চিকিৎসক চার জনের সঙ্গে ৮ অগস্ট রাতের খাবার খেয়েছিলেন সেমিনার রুমে। সিবিআইয়ের চার্জশিটের ৯ নম্বর পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে অনলাইনে খাবার আনিয়ে মোট পাঁচ জন খাবার খেয়েছিলেন। সেই সময়ে অলিম্পিক্স চলছিল। মোবাইলে খেলা দেখে সেমিনার রুমেই শুয়ে পড়েন ওই চিকিৎসক। বাকিদের মধ্যে দু’জন চলে যান স্লিপ স্টাডি রুমে। অন্যেরা যান নিজেদের কাজে। ঘটনার অব্যবহিত পরে সমাজমাধ্যমে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এক ইন্টার্ন ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সিবিআই ওই ইন্টার্নের কথা উল্লেখ করে চার্জশিটে লিখেছে, তিনি ঘটনার সময়ে তিনতলায় নিজের কাজ করছিলেন।
কে প্রথম দেখেন?
যে দু’জন জুনিয়র চিকিৎসক স্লিপ স্টাডি রুমে বিশ্রাম করতে গিয়েছিলেন, তাঁদেরই এক জন ৯ অগস্ট সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ নির্যাতিকে ওয়ার্ডে না দেখে সেমিনার রুমে খুঁজতে যান। তিনি গিয়ে দেখেন, ওই তরুণী অসংলগ্ন অবস্থায় ম্যাট্রেসের উপর শুয়ে রয়েছেন। সেই সময়ে তাঁর নিম্নাঙ্গে কোনও কাপড় বা আবরণ ছিল না। ওই অবস্থা দেখে তিনি খবর দেন আর এক জন জুনিয়র ডাক্তারকে। ওই দু’জনেরই পলিগ্রাফ টেস্ট হয়েছে। এর পর প্রথম জুনিয়র ডাক্তার খবর দেন দুই মহিলা পিজিটি-কে। ওই দু’জনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। দুই মহিলা পিজিটি খবর দেন এক সহকারী অধ্যাপককে। তিনিই দেখে প্রাথমিক ভাবে আন্দাজ করেন, তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। এক জন মহিলা পিজিটি দেহ ঢেকে দেন বিছানার চাদর দিয়ে। তার পরে খবর যায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।