যাদবপুরকাণ্ডে গবেষণারত পড়ুয়া অরিত্র মজুমদারকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। রাত দেড়টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব চলেছে। অন্য দিকে, পুলিশি জেরার পর যাদবপুর থানা থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরলেন আর এক ছাত্র রুদ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘আলুকেও (অরিত্র) ছেড়ে দেবে।’’ কিছুক্ষণ ক্যাম্পাসে থাকার পর রুদ্র অ্যাপ ক্যাব ধরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। রাত পৌনে দুটো নাগাদ কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) বিদিশা কলিতা যাদবপুর থানা থেকে বেরিয়েছেন। তিনি জানান, তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বয়ান খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে আবার ডাকা হতে পারে বলে জানান তিনি।
যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার শুরু থেকেই অরিত্রের নাম ঘুরপাক খাচ্ছিল নানা মহলে। এমনকি, যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় তাঁর নাম নিয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, যাদবপুরের ওই ছাত্রকে পাকড়াও করলে অনেক তথ্য বেরোবে। মঙ্গলবার দিনভর অরিত্র ওরফে আলুর ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। যাদবপুরের গবেষণারত ওই পড়ুয়াকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ুয়া এবং ছাত্রনেতা অরিত্র থানায় ঢোকার আগে হাসিমুখে বলেন, ‘‘আপাতত যাই। কথা বলে আসি (পুলিশের সঙ্গে)।’’ এর পর কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটিও আগামিকাল অর্থাৎ বুধবার অরিত্রকে ডেকে পাঠিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে অরিত্র আনন্দবাজার অনলাইনকে জানান, তিনি সদ্য ট্রেকিং করে ফিরেছেন। সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেছেন। শারীরিক এবং মানসিক ভাবে তিনি ক্লান্ত। অনেক ধকল গিয়েছে। আপাতত বিশ্রাম নেবেন। এ নিয়ে পরে কথা বলবেন। দু’দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্রাম আর নেওয়া হয়নি। পুলিশের তলবে যাদবপুর থানায় ছুটতে হয়েছে বাঁশদ্রোণীর ওই বাসিন্দাকে।
অন্য দিকে, হস্টেলে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যাদবপুরের আরও এক পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে পুলিশ। তিনি বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া রুদ্র। পুলিশ সূত্রে প্রথমে জানা যায়, বুধবার থানায় আসতে বলা হয়েছে ওই ছাত্রকে। যাদবপুরকাণ্ডে এই দুই ছাত্রের ভূমিকা কী, তা খতিয়ে দেখতে চাইছেন তদন্তকারীরা। পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই রুদ্রের সঙ্গে আরও এক ছাত্রকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানা যায়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের মৃত্যুর তদন্তে নেমে পুলিশ একটি ডায়েরি পায়। ডায়েরির পাতায় লেখা ‘চিঠি’ ঘিরে প্রচুর প্রশ্ন উঠেছে। তার মধ্যে বড় প্রশ্ন ‘ডাবল রাইটিং’ নিয়ে। ওই চিঠিটি লেখা হয়েছে ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়ে উদ্দেশে। সেখানে পাওয়া যায় জনৈক ‘রুদ্রদা’র কথা। এর পর রুদ্রের নাম উঠে আসে। যে ছাত্র মারা গিয়েছেন, তাঁকে চিনতেন? সংবাদমাধ্যমকে রুদ্র জানান, তাঁর সঙ্গে এক বার অল্প কথাই হয়েছিল ওই ছাত্রের সঙ্গে। এবং সেটাও হস্টেল সম্পর্কিত। তাঁর কথায়, ‘‘ওকে বলেছিলাম মেন হস্টেলে র্যাগিং হয়। সাবধানে থাকবি। যাদের চিনিস তাঁদের নিয়ে থাকবি।’’ ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ, ৮ অগস্ট প্রথম বর্ষের ওই ছাত্রের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। কিন্তু সেই দিন আর কোনও কথা হয়নি বলেই দাবি করেছেন রুদ্র।
পুলিশের নজরে অরিত্র
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রভাবশালী’ ছাত্রনেতা হিসাবে পরিচিতি রয়েছে অরিত্রের। তাঁর কথাতেই নাকি একটা সময় ইঞ্জিনিয়রিং বিভাগের সমস্ত জিবি বৈঠক, আন্দোলন পরিচালিত হত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিতেও দেখা যেত তাঁকে। তা হলে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর এ হেন অরিত্র কেন অনুপস্থিত ছিলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অরিত্রের দাবি, তিনি ১০ অগস্ট কলকাতার বাইরে চলে যান। আগেই ঠিক ছিল, তিনি বেড়াতে যাবেন। ৯ অগস্ট ওই ‘দুর্ঘটনা’র সময় তিনি হস্টেলেই ছিলেন না। তখন বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য ব্যাগপত্র গোছানোয় ব্যস্ত ছিলেন। পর দিন, ১০ অগস্ট কলকাতা ছাড়ার আগে কিছু ক্ষণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। তখন ওই ‘দুর্ঘটনা’র কথা শোনেন। ফেসবুক পোস্টে অরিত্র দাবি করেছেন, ঘটনার পরের দিনই তিনি দিল্লি যান। সেখান থেকে বেড়াতে যান কাশ্মীর। কাশ্মীর যাওয়ার প্রমাণ হিসাবে বিমানের টিকিটের ছবিও পোস্ট করেছেন। যদিও সেই টিকিটের ছবি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় সমাজমাধ্যমে। অন্য দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার খাতায় ঘটনার দিন তাঁর সই নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
‘আলু’র ভূমিকা কী
পুলিশ তাঁর নাম না করলেও সমাজমাধ্যম থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম, দিনের পর দিন আলোচনা চলেছে যাদবপুরের পড়ুয়া ‘আলু’কে নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত মহলে অরিত্র পরিচিত আলু নামেই। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গবেষণারত ওই পড়ুয়াকে নিয়ে তাঁর বিভাগের প্রধান পার্থ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘১১ অগস্ট বিভাগীয় প্রধানের দফতরে উপস্থিতির খাতায় অরিত্রের স্বাক্ষর রয়েছে।’’ তবে সমাজমাধ্যমে এত অভিযোগ সত্ত্বেও অরিত্র আত্মপক্ষ সমর্থনে সামনে আসেননি। ক্যাম্পাসে আলোচনা— যাঁকে সব সময় মিছিলের সামনে দেখা যায়, এত বড় ঘটনার পর তিনি কেন সামনে এলেন না? অরিত্র জানাচ্ছেন, আপাতত এ সব নিয়ে কিছু বলবেন না। যা বলার তিনি পুলিশকে বলবেন। আলুকে নিয়ে কলকাতা জেলার এসএফআইয়ের সভাপতি দেবাঞ্জন দে অভিযোগ করেন, ‘‘অরিত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ডিএসএফের নেতা। যাদবপুরের মেন হস্টেলের দখলদারির সঙ্গে অরিত্রদের সংগঠন যুক্ত।’’ উল্লেখ্য, মৃত ছাত্রের পরিবার অরিত্রের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করেনি। কিন্তু তদন্তে উঠে এসেছে, ঘটনার পর অভিযুক্ত সৌরভ চৌধুরী এক প্রাক্তন ছাত্রনেতাকে ফোন করেছিলেন। সেই প্রাক্তন নেতা অরিত্র, এমন অভিযোগ পুলিশের কাছেও পৌঁছয় বলে সূত্রের দাবি। যদিও এ বিষয়ে লালবাজার থেকে বার বারই প্রকাশ্যে বলা হয়েছে, ওই প্রাক্তন ছাত্রনেতার খোঁজ তারা আদৌ করেনি। প্রসঙ্গত, ঘটনার পর এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘সেই রাতে গেট বন্ধ করে রাখা, পুলিশকে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশের পিছনে অরিত্র-সহ দুই নেতার কী ভূমিকা ছিল? প্রভাবশালীর হাত মাথার উপরে আছে বলেই কি পুলিশ-প্রশাসন এ সব দেখেও দেখছে না?’’
ফেটসুরবিবৃতি
যাদবপুরের পড়ুয়ামৃত্যুর ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলে সরব যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংগঠন ‘ফেটসু’। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মদ্যপান, ধূমপান বা অন্যান্য মাদক সেবন কোনও ভাবে সমর্থনযোগ্য নয় বলেও জানিয়েছে ওই ছাত্র সংসদ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মদের বোতল উদ্ধারের ঘটনার প্রেক্ষিতে ফেটসু বিবৃতি দিয়ে বলে, ‘‘র্যাগিংয়ের কারণে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় স্বচ্ছ এবং দ্রুত তদন্ত করতে হবে। দোষীদের যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র্যাগিং রুখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শীঘ্রই বৈঠক ডাকারও দাবি তুলেছে যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংগঠনটি। পাশাপাশি জানিয়েছে, বিভাগীয় নবীনবরণ-সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নবাগত পড়ুয়াদের র্যাগিংয়ের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তাদের সংগঠন কোনও রকমের র্যাগিংকেই সমর্থন করে না।
র্যাগিংয়ের অভিযোগ জানাতে খোলা হল টোল ফ্রি নম্বর
র্যাগিং আটকাতে এ বার টোল ফ্রি নম্বর চালু করল রাজ্য সরকার। মঙ্গলবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পুজো কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠকে ওই নম্বরের কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘লালবাজারে সারা রাজ্যের জন্য একটি টোল ফ্রি নম্বর করা হচ্ছে। নম্বরটি হল— ১৮০০৩৪৫৫৬৭৮। এটা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে।’’ যাদবপুরকাণ্ডের প্রেক্ষিতে এই নম্বর চালু করা হয়েছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘যাদবপুর আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। অনেক দিন এটা (র্যাগিং) বন্ধ ছিল। হয়তো অনেক ঘটনাই ঘটে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে জানায় না। অন্ধ্রপ্রদেশেও একটি ঘটনা ঘটেছে। আমি সিআইডি-র হাতে সেটার দায়িত্ব দিয়েছি। তারা তদন্ত শুরু করে দিয়েছে।’’