সন্ত সুরদাস ছিলেন জন্মান্ধ। অন্তরের দৃষ্টি থাকলে অন্ধও যে অভূতপূর্ব সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারেন, সন্ত সুরদাসের জীবনচরিত জানলে নিজেকে বিশেষ ভাবে সক্ষম করে তুলতে পারবেন যেকোনো দিব্যাঙ্গ; এই বার্তা দিলেন অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। গত ১২ মে সন্ত সুরদাস জন্মজয়ন্তীতে ‘সক্ষম’ নামক দিব্যাঙ্গদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে নিবেদিত জাতীয় সংগঠন সারা দেশে পালন করেছে ভাবগম্ভীর এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সমদৃষ্টি, ক্ষমতা বিকাশ এবং ক্ষমতার অনুসন্ধানই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এদিন ‘সক্ষম’-এর কলকাতা শাখা মানিকতলার ‘কল্যাণ ভবন’-এ আয়োজন করে এক মনোজ্ঞ কর্মক্রম।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। সভায় উপস্থিত ছিলেন সক্ষমের সভাপতি ডা. অরবিন্দ ব্রহ্ম, স্বস্তিকা পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক ড. বিজয় আঢ্য, সক্ষমের পূর্ববর্তী কার্যকর্তা ডা. সনৎ কুমার রায় এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত কার্যবাহ শ্রী শশাঙ্ক শেখর দে। অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন শ্রীমতী পারমিতা কুন্ডু এবং ড. সুজাতা রায় মান্না। সঞ্চালনা করেন ডাঃ সাত্যকি দাস।
অধ্যাপক চক্রবর্তী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, মনীষীর নাম ‘সুরদাস’, অর্থাৎ সুর বা মেলোডির অতন্দ্র সেবক৷ তাঁর কৃতি ও কৃষ্টির জন্য তাঁকে ‘জন্মান্ধ’ না বলে, বলা ভাল ‘আজন্ম দিব্যদ্রষ্টা’। কারণ বিদূষী হেলেন কেলারকেও বলা হত পৃথিবীর সবচাইতে বড় দ্রষ্টা এবং বক্তা। যিনি চোখে দেখেন না, কানে শোনেন না, কথা বলতে পারেন না, তাঁর অন্তরে এত জ্ঞান কোথা থেকে এলো? বাইরের পৃথিবী দৃশ্যদূষণে যখন পূর্ণ, তখন মনের দৃষ্টি যাঁর সবচেয়ে বেশি, তিনিও পারবেন সবচেয়ে বড় দ্রষ্টা হতে! মনের আলো জ্বালিয়ে ভেতরের মানুষের অন্তঃকরণ দেখতে। অনুভূতিহীনতার অন্ধকার, নির্দয়তার অন্ধকার, করুণাহীনতার অন্ধকার দূর করতে আজ যে একজন সুরদাসের বড্ড প্রয়োজন! মনে পড়বে কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতার পংক্তি —
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;”
জন্মান্ধ সন্ত সুরদাস কৃষ্ণভক্তির বাৎসল্য রসের পরম প্রচারক। ১৪৭৮ সালে ব্রজের পথে ‘সীহী’ গ্রামে সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। গুরু বল্লভাচার্যের সঙ্গে তিনি যমুনার তীরে ‘বাঁকে বিহারি মন্দির’-এ অবস্থান করতেন। অন্ধত্ব তাঁকে জীবন যুদ্ধে পরাজিত করতে পারে নি। রোজই কিছু শ্লোক রচনা করে শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মে সমর্পণ করে তবে তিনি অন্ন গ্রহণ করতেন। হিন্দি সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য রচনা ‘সুর সাগর’, ‘সুরসারাবলী’, ‘সাহিত্য লহরী’ এবং ‘রাধারসকেলী’। তাঁর সাধনায় রয়েছে ভগবৎ চরণে আশ্রয় নিয়ে জীবনের প্রতি প্রেম, আশা ও আনন্দের প্রেরণা লাভ। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জীবনকে পরাজিত করতে পারে না দিব্যাঙ্গ-যুক্ত মানুষকে, এটাই তাঁর প্রধান শিক্ষা। তাই আমরা সন্ত সুরদাসের জীবনী পাঠ করবো।
অধ্যাপক চক্রবর্তী আরও বলেন, দিব্যাঙ্গের অধিকারী মানুষ যে আত্মশক্তিতে আর ভগবৎ সাধনায় উজ্জীবিত হয়ে অসাধ্য সাধন করতে পারেন, তা সন্ত সুরদাস (১৪৭৮-১৫৮৩) নিজের জীবনচর্যা ও মানসচর্চায় প্রমাণ করে গেছেন। জন্মান্ধ এই পদাবলী রচয়িতা ও সঙ্গীতজ্ঞ ১০৫ (মতান্তরে ১০৮) বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি মধ্যযুগীয় ভক্তিবাদী আন্দোলনের এক অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব এবং ‘পুষ্টিমার্গীয় ভক্তি’-র প্রচারক। এই পথে ভক্তের উপর ভগবানের কৃপার নাম পোষণ বা পুষ্টি। এই পুষ্টি নিবৃত্তির উপদেশ দেয় না। দেয় জীবনের গভীর প্রেম, আশা ও আনন্দের প্রেরণা। একজন জন্মান্ধ যদি জীবন সংগ্রামে হেরে না যান, তবে দিব্যাঙ্গের অধিকারী কোনো মানুষই জীবনে হেরে যেতে পারেন না।
মূল অনুষ্ঠানের পূর্বে ‘সক্ষম’-এর পক্ষ থেকে প্রয়াত সত্য নারায়ণ আগরওয়ালের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সংগঠনের সম্পাদক শ্রী অনিখ ব্যানার্জী সহ অন্যান্য কার্যকর্তাবৃন্দ।