সম্প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস (NCPCR) এবং ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন (NCW)-এর পক্ষ থেকে দায়ের করা একটি পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে। মুসলিম ব্য়ক্তিগত আইনের অধীনে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। এই রায়টি ভারতীয় আইনি ব্যবস্থায় ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন এবং সাধারণ আইনের মধ্যে টানাপোড়েনকে পুনরায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।
আবেদনের মূল যুক্তি ছিল যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের এই বিধানটি শিশুর অধিকার সুরক্ষা আইন, ২০১২ (POCSO) এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন, ২০০৬ (Prohibition of Child Marriage Act, 2006) এর মতো প্রচলিত আইনগুলির সঙ্গে বিরোধ বাধাচ্ছে । NCPCR এবং NCW এর মতে, একজন ১৬ বছর বয়সী মেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করে বিয়ে করার অনুমতি দেওয়া তার মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং তাকে শিশু হিসেবে সুরক্ষা প্রদানের আইনের পরিপন্থী। তারা যুক্তি দিয়েছিল যে এই ধরনের বিবাহ মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং তাদের শিক্ষা ও বিকাশের সুযোগ সীমিত করে।
তবে, সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে এই যুক্তিগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেছে যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন একটি প্রতিষ্ঠিত এবং স্বতন্ত্র আইনি ব্যবস্থা, যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার অংশ। আদালত স্পষ্ট করেছে যে একজন মুসলিম মেয়ে যদি বয়ঃসন্ধিতে (Puberty) পৌঁছে থাকে, তাহলে সে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন অনুযায়ী বিয়ে করার জন্য যোগ্য। এই বয়ঃসন্ধির বয়স সাধারণত ১৫ বছর ধরা হয়, তবে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে যে এটি ১৬ বছর বয়সের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আদালতের এই সিদ্ধান্তটি দুটি ভিন্ন আইনি কাঠামোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। একদিকে, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অধিকারকে সম্মান জানাচ্ছে, যা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অন্যদিকে, এটি আধুনিক সমাজে শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তৈরি প্রচলিত আইনগুলির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এই রায়টি ভারতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের দাবিকে আরও জোরদার করতে পারে। অনেকে মনে করেন যে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই আইনগুলোর আধুনিকীকরণ প্রয়োজন, যাতে তা নারীর অধিকার এবং শিশুদের সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। যদিও আদালত এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আইনের পক্ষেই রায় দিয়েছে, এটি একটি বড় বিতর্কের সূচনা করেছে যে ধর্মীয় আইন কি দেশের প্রচলিত আইনের উপর প্রাধান্য পাবে?
আদালতের এই সিদ্ধান্তের পর, এটি আশা করা হচ্ছে যে এই বিষয়ে একটি বৃহত্তর আলোচনা এবং আইনি পর্যালোচনার প্রয়োজন হতে পারে। এটি শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যই নয়, বরং ভারতের বহু-ধর্মীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইনের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করেছে। এর ফলে, একটি সাধারণ সিভিল কোড (Common Civil Code) প্রবর্তনের দাবি আরও জোরালো হতে পারে, যা সকল নাগরিকের জন্য সমান আইন নিশ্চিত করবে।
এই মামলার রায়টি শিশুদের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, এবং আইনি সংস্কারের মতো জটিল বিষয়গুলোর একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এটি কেবল একটি আইনি রায় নয়, বরং সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের বিচার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।