তারিখটা ছিল ২রা মে ২০২১, আজ থেকে প্রায় বছর আড়াই পূর্বে। মেঘাচ্ছন্ন পূবের আকাশেও যেন অকাল শ্রাবণের ঘনঘটা। ভারী হয়ে আসছে এই বঙ্গের আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষ। টিভির পর্দায় সম্প্রচারিত হচ্ছে একটার পর একটা হৃদয় বিদীর্ণ করা দুঃসহ সংবাদ। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়, নাহ এবারও শেষ রক্ষা হল না। প্রবল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে সামান্য ব্যবধানে একটার পর একটা আসন হারাচ্ছেন বিজেপি প্রার্থীরা। খন্ডিত, চুর্ণবিচুর্ণ রক্তাক্ত হল কোটি কোটি হিন্দু বাঙালীর হৃদয়। দুপুর গড়াতেই মানসিক ভাবে পরাজয় বরণ করে বিষন্নতার পারাবারে অবগাহন করলেন পরিবর্তনকামী কোটি কোটি হিন্দু বাঙালী। আগামী আরও পাঁচ বছর মায়ামতা বিবর্জিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারের অসহনীয় নৈরাজ্য, অপশাসন, উগ্র সন্ত্রাসবাদের শিকার হওয়ার আতঙ্কে দিশেহারা হলেন আট থেকে আশি আবালবৃদ্ধবনিতা। যজ্ঞের আগুনে ঘৃতাহুতির মত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে শুরু করল একটার পর একটা বল্গাহীন খুন, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ শ্লীলতাহানির মত বর্বরোচিত নারকীয় ঘটনাপ্রবাহ। স্বাধীনতাত্তোর ভারতবর্ষে এই প্রথমবার অদ্ভুত এক পৈশাচিক রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠল তৃণমূলের দুর্দমনীয় জহ্লাদ বাহিনী। আতঙ্কগ্রস্ত হিন্দু বাঙালীর মানসপটে প্রত্যাবর্তিত হল পূর্বপুরুষের মুখনিঃসৃত সেদিনের সেই নোয়াখালী দাঙ্গার ভয়াবহ রোমহর্ষক স্মৃতি। অনির্দিষ্টকালের জন্য গৃহত্যাগী হলেন লক্ষ লক্ষ বিজেপি কর্মী। কেউ বা আশ্রয় নিলেন পার্শ্ববর্তী রাজ্যে, কেউ বা বেছে নিলেন আত্মহননের পথ।
ঘটনার আজ প্রায় আড়াই বছর উত্তীর্ণ, কিন্ত পরিতাপ একটাই যে অদ্যাবধি বিচার পায়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। নাহ, দোষীদের সাজা হয়নি, ঠোঁটের কোনায় বঙ্কিম হাসি ঝুলিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। তারা কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছ, কারণ “ঈশ্বর পরিত্যক্ত এই বঙ্গদেশে বিচারের বাণী আজও যে নীরবে নিভৃতে কাঁদে”।
সেদিনের সেই দগদগে ক্ষতের ভয়ার্ত স্মৃতিতে আজও আমাদের মত সাধারণ কর্মীদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অব্যাহত। বিজেপি দলের প্রতি প্রবল আনুগত্যে যে সকল কর্মীরা একদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জীবনের বাজি ধরেছিলেন, ক্ষোভে দুঃখে অভিমানে অপমানে তারাই মুখ ফিরিয়ে নিলেন দলের থেকে। বিতৃষ্ণা আর ঘৃণার প্রাবল্যে অবর্ণনীয় এক বিবমিষায় আক্রান্ত হলেন নীচুতলার কর্মীবৃন্দ। অসহায়তার এই চরম মুহূর্তে পাশে পেলেন না উচ্চতর নেতৃত্বদের, যাদের রবাভয়ে প্রাণ বিপন্ন করে রাজনীতিটা করতে এসেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য বিজেপিতে দেখা দিল প্রচন্ড রকমের ভাটার টান, অস্তিত্ব হয়ে উঠল সঙ্কটাপন্ন। নড়েচড়ে বসলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত হল কর্মীদের হৃত মনোবল পুনরুদ্ধারে রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বে আনা হবে নতুন মুখ, এমন এক মুখ যাঁর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে সর্বস্তরে।
আলোচনায় উঠে এল একাধিক নাম, কিন্ত প্রকৃত রত্নকে খুঁজে নিতে কালবিলম্ব করেননি জে পি নাড্ডা জীর নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটির জহুরীর চোখ। ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ নবনিযুক্ত রাজ্য সভাপতি হিসেবে ঘোষিত হল ডক্টর সুকান্ত মজুমদারের নাম। অর্পিত হল ড্যামেজ কন্ট্রোলের গুরুদায়িত্ব। একে তো দেশ মাতৃকার ডাক, তদুপরি রাজ্য বিজেপির তখন অস্তিত্ব চরম সঙ্কটে, অগত্যা সাড়া দিলেন সংঘের আদর্শে দীক্ষিত, আগাগোড়া রাষ্ট্রবাদী মানসিকতাসম্পন্ন সুকান্ত মজুমদার। পর্বতসদৃশ আত্মবিশ্বাস আর মাত্র বছর দুয়েকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে দেশোদ্ধারের মহান অর্ঘ্যে ব্রতী হয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন রাজ্য বিজেপির পুণর্জাগরনের যাবতীয় দায়ভার। সুকান্তবাবুর এ হেন দুঃসাহসিক সিদ্ধান্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা “কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যা রবি ……….” ঠিক কতটা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল, তা এই অধমের জানা না থাকলেও একথা হলফ করে বলাই যায় যে তাঁর এই মাত্রাতিরিক্ত দুঃসাহসে ভ্রু কুঁচকেছিলেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বৃহদাংশ।
পূর্বতন রাজ্য সভাপতি দোর্দন্ডপ্রতাপ দিলীপ ঘোষের অমিতবিক্রম আগ্রাসী ভাবমূর্তির পাশে ঠিক কতটা মানানসই হয়ে উঠবেন আদ্যন্ত শিক্ষা জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত আপাত নিরীহ এই অধ্যাপক, রাজনৈতিক আলোচনার আবর্তে এই বিতর্কই হয়ে উঠল মুখ্য উপজীব্য। দেখা দিল প্রবল সংশয়, দ্বিধাবিভক্ত হলেন রাজনৈতিক কারবারিরা। প্রসঙ্গত এ কথা অনস্বীকার্য যে বঙ্গ বিজেপির চমকপ্রদ উত্থানের নেপথ্যে দিলীপ ঘোষের ভূমিকা অপরিসীম, তাই নতুন দায়িত্বের ছত্রে ছত্রে সুকান্তবাবুকে তৃণমূলের পাশাপাশি লড়াই করতে হয়েছে দিলীপবাবুর ছায়ার সঙ্গে, যা বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁকে ফেলা হয়েছে আতস কাঁচের তলায় দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তুল্যমুল্য বিচারে এবং বলাই বাহুল্য যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সসম্মানে কৃতকার্য হয়ে নিজের সুনামের সাথে সুবিচার করেছেন।
আজ ১৯ শে সেপ্টেম্বর ২০২৩। সভাপতি পদে সুকান্তবাবুর কার্যকালের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। ইতিমধ্যেই অভাবনীয় একাধিক সাফল্য তাঁর ঝুলিতে। শিক্ষা জগতের মতই, রাজনৈতিক শিক্ষানবিশ থেকে তাঁর উত্তরণ ঘটেছে রাজনীতির মাষ্টারমশাইয়ে। তাঁর বিশ্বস্ত হাত ধরেই প্রায় তলানীতে পৌঁছে যাওয়া দলীয় কর্মীদের লুপ্তপ্রায় মনোবল প্রত্যাবর্তিত হয়েছে প্রায় একশ শতাংশ, যার জ্বলন্ত প্রমাণ বিগত দু বছরের বিবিধ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অভাবনীয় সাফল্য; যা ছিল সভাপতি হিসেবে সুকান্তবাবুর বিগত দু’বছরের ফাইনাল পরীক্ষা। সেই অর্থে সাফল্যের নিরিখে তাঁর প্রাপ্তি প্রায় গগনচুম্বী। নিজের হাতে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে তিনি প্রমাণ করেছেন, A Leader is one, who knows the way goes the way and shows the way.
শিক্ষা প্রজ্ঞা মেধা মননের চুড়ান্ত পরাকাষ্ঠা গবেষক অধ্যাপক ডক্টর সুকান্ত মজুমদার ইতিমধ্যেই হয়ে উঠেছেন শোষিত অবহেলিত নিপীড়িত সমাজের কন্ঠস্বর। অর্জন করেছেন মানুষের বিশ্বাস, ভালবাসা। নিজেকে তৃণমূল সভানেত্রীর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থানে রেখে একটিও অপশব্দ ব্যবহার না করে, সুন্দর ভাষার ব্যবহারে, নিখুঁত শব্দচয়নে ক্রমাগত তীরবিদ্ধ করে চলেছেন শাসক শিবিরকে অথচ অদ্যাবধি তাঁর বিরুদ্ধে ভাষা সন্ত্রাসের একটি অভিযোগও ওঠেনি। তাই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, ব্যপ্তি আজ প্রসারিত হয়েছে সর্বস্তরে। দলের প্রাজ্ঞ নেতৃবর্গ ও পূর্বতন সভাপতির প্রতি তাঁর অবিমিশ্র শ্রদ্ধাবোধ বারবার প্রমাণ করে কেন তিনি একজন Class Apart ব্যক্তিত্ব। সংযত মার্জিত রুচিশীল ব্যবহার তাঁকে সম্মানিত সমাদৃত করে তুলেছে বুদ্ধিজীবী মহলেও।
“সুকান্ত” নামের সাথে সাযুয্য রেখেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আক্ষরিক অর্থেই তিনি হয়ে উঠেছেন একজন আদর্শ “সুকান্ত” চরিত্র। তিনি সুকান্ত, তিনি পড়াশোনার মতই রাজনীতির একনিষ্ঠ তাপস। তাই তো একমাত্র তিনিই পারেন বহুল প্রচারিত টিভি চ্যানেলের ইন্টারভিউতে নজিরবিহীন ভাবে দলীয় কর্মীদের “দেবতুল্য” অভিধায় আখ্যায়িত করতে। আমরা জানি রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প, আর কর্মীরাই দলের প্রকৃত সম্পদ। তাই দলীয় কর্মী ও গণদেবতাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন একজন যথার্থ রাজনৈতিক নেতার শিক্ষাগত উচ্চতার পাশাপাশি চরিত্রের মানবিক দিক ও ব্যাপ্তিকেই সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে। এ কারণেই এত স্বল্প সময়েও তিনি তাঁর স্থান করে নিয়েছেন আমার মত অগণিত সাধারণ কর্মীর হৃদয়ের মণিকোঠায়। রাজ্য সভাপতি হিসেবে দলের প্রতি তাঁর নিখাঁদ দায়বদ্ধতা কর্তব্য নিষ্ঠা জন্ম দেয় এক দুর্মর আশাবাদের। একেবারে সম্মুখ সারি থেকে তাঁর নেতৃত্ব প্রদানের সহজাত প্রবনতা বিশ্বাস করতে শেখায় যে কোন বাঁধাই দুর্লঙ্ঘ্য বা অনতিক্রম্য নয়। তাই পশ্চিমবঙ্গের অগণিত জাতীয়তাবাদী মানুষ অনিমেষ নয়নে চেয়ে আছেন সুকান্ত মজুমদারের মুখপানে।
তুমি স্বপ্নের সওদাগর,
তুমি বাঙালীর অনুরাগ
দ্যুলোক ভূলোকে মন্দ্রিত আজি
তোমারই বজ্রনাদ ॥
তব আলোকে বিভাসিত জাতি সাহসেতে বলীয়ান
সুকান্ত তোমার মুখপানে চেয়ে
বেঁচে আছে কোটি প্রাণ ॥