শুভেন্দুর দ্বিজত্বপ্রাপ্তি! এই প্রথম বার সঙ্ঘ পরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার পেলেন দিল্লিতে

তিনি বিজেপির। কিন্তু তিনি কি ‘পরিবারের’?

গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়ার পর গত প্রায় আড়াই বছর ধরে এই প্রশ্ন ছিল তাঁকে ঘিরে। সোমবার থেকে সেই প্রশ্ন আর রইল না। সোমবার থেকে শুভেন্দু অধিকারী যেমন বিজেপির, তেমনই পরিবারেরও। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার এত দিন পর অবশেষে ‘দ্বিজত্বপ্রাপ্তি’ হল তাঁর।

সোমবার নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) ‌শীর্ষ স্তরের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। এর পরে বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে জেতেন। বিরোধী দলনেতা হন। ক্রমশ রাজ্য বিজেপির অন্যতম প্রধান ‘মুখ’ হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু এত দিন সঙ্ঘের কোনও সর্বভারতীয় বৈঠকে ডাক পাননি। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আড়াই বছরের মাথায় সেই সুযোগ পেলেন শুভেন্দু।

কলকাতায় আরএসএস দফতরে দু’এক বার গিয়েছেন শুভেন্দু। গত ২৩ জানুয়ারি সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের অনুষ্ঠানেও ‘গণবেশ’ (সঙ্ঘের পোশাক) পরে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্ঘের শীর্ষ স্তরের ডাক পাওয়া এবং সেখানে উপস্থিত থাকার তফাত রয়েছে।

আরএসএস অবশ্য বলছে, এই বৈঠক একেবারেই সংগঠনের ‘রুটিন’ বিষয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে রাজ্যওয়াড়ি বিভিন্ন সম মনোভাবাপন্ন সংগঠনের নেতৃত্বকে নিয়ে সাংগঠনিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। কখনও তা নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হয় না। কবে, কখন, কোথায় বৈঠক এবং সেখানে কারা থাকছেন— সবই সাধারণ ভাবে গোপন থাকে। তবে এই বৈঠকে কারা ডাক পাবেন, তার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। যখন যাঁকে প্রয়োজন, তখন তাঁকে ডাকা হয়। শুভেন্দু পরিষদীয় নেতা। কিন্তু এর আগেও পরিষদীয় নেতাকে এমন বৈঠকে ডাকার নজির রয়েছে। কিন্তু তবুও ওই বৈঠক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরে। কারণ, শুভেন্দু সেই বৈঠকে ডাক পাওয়ায় তা আর ‘রুটিন এবং সাধারণ’ পর্যায়ে থাকেনি।

রাজ্য বিজেপির তরফে যাঁরা দিল্লির ওই বৈঠকে ছিলেন, তাঁরা সকলেই সঙ্ঘের কাজ থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রয়েছেন। কিন্তু এই প্রথম তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া কোনও নেতা এই ধরনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে ডাক পেলেন। কেউ কেউ বলছেন, শ্রাবণের প্রথম সোমবারে গোটা দেশের ‘রুদ্রাভিষেক’ পালনের দিন শুভেন্দুরও ‘অভিষেক’ হল। সঙ্ঘের বৈঠকে যোগ দিয়ে ‘দ্বিজত্বপ্রাপ্তি’ হল তাঁর। উপবীত ধারণের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ সন্তানেরা যেমন দ্বিতীয় জন্ম পান, তেমনই ‘দ্বিজ’ হয়ে উঠলেন শুভেন্দু।

শুভেন্দু বরাবরই প্রকাশ্যে দাবি করেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর সঙ্ঘের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। একটা সময়ে আরএসএস-এর শাখাতেও যেতেন বলে জানিয়েছেন একাধিক বার। তবে তিনি কখনও আরএসএস-এর ‘পদাধিকারী’ ছিলেন না। তবে বৈঠকে শুভেন্দুর ডাক পাওয়া নিয়ে বিজেপি নেতারা নীরব। কেউ কেউ তো বৈঠকের কথা স্বীকারও করছেন না! শুভেন্দুও কোনও কথা বলেননি। সোমবারের বৈঠক সেরে রাতেই কলকাতায় ফিরেছিলেন শুভেন্দু। মঙ্গলবার বিকেলে ফের দিল্লি গিয়েছেন। দুপুরে বিধানসভায় এলেও সোমবারের বৈঠক সম্পর্কে কোনও কথা বলতে চাননি।

আরএসএস-এর পরিভাষায় এমন বৈঠককে ‘সমন্বয় বৈঠক’ বলা হয়। যেখানে সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের ডাকা হয়। জেলা, রাজ্য এবং সর্বভারতীয় স্তরে বছরে একাধিক বার হয় এমন বৈঠক। সোমবারের বৈঠক ছিল সর্বভারতীয় স্তরের। দিল্লির একটি আশ্রমে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চলেছে ওই বৈঠক। কড়া অনুশাসনের মধ্যে কাটাতে হয়েছে সকলকে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রবেশ এবং তার পর থেকে ঘড়ির কাঁটা ধরে সব কাজ করতে হয়েছে। সকাল থেকে টানা আলোচনা। দুপুরে ‘সহভোজ’ এবং বিকেলে ফের বৈঠক। সাধারণ ভাবে নিরামিষ ভাত, ডাল, রুটি, তরকারি খাওয়া হয় সেখানে। তবে শুধু বিজেপি নয়, সোমবার রাজ্য থেকে বিদ্যার্থী পরিষদ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সংস্কার ভারতী-সহ প্রধান কয়েকটি সংগঠনের রাজ্য নেতারাও ওই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে।

রাজ্য বিজেপি থেকে গিয়েছিলেন ছ’জন। শুভেন্দু ছাড়াও রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সতীশ ধন্দ। রাজ্যের পাঁচ সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ডাক পেয়েছিলেন একমাত্র জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন বাংলার নেতা তথা বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ। এ ছাড়াও রাজ্য আরএসএস-এর কর্তারা ছিলেন। আরএসএস সাংগঠনিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গকে তিনটি প্রান্তে (রাজ্য) ভাগ করে। উত্তরবঙ্গ, মধ্যবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের তিন প্রান্ত প্রচারক বৈঠকে ছিলেন বলে জানা গিয়েছে।

সঙ্ঘের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের তরফে উপস্থিত ছিলেন দু’জন। দুই ‘সহ-সরকার্যবাহ’ অরুণ কুমার এবং রাম দত্ত। অরুণ বিবিধ ক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্ঘের সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। রাম সর্বভারতীয় নেতা হলেও তাঁর কেন্দ্র কলকাতা। অভেদানন্দ রোডের কেশব ভবনই তাঁর ঠিকানা। সোমবারের বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা নিশ্চিত ভাবে জানা না গেলেও রাজ্য বিজেপি নেতাদের একাংশ বলছেন, বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির কথাই আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল। তা নিয়ে বিজেপি-সহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে রিপোর্ট পেশ করা হয়। কোন কোন বিষয়ে জোর দিতে হবে, আগামী লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য কোন সংগঠনকে কী করতে হবে, কে কাকে কী ভাবে সহযোগিতা করবে, মূলত সে সব নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

২০২৪ সালের বিজয়া দশমী থেকেই সঙ্ঘের শতবর্ষ পালন পর্ব শুরু হওয়ার কথা। তার ঠিক আগে লোকসভা নির্বাচন বিজেপির মতো সঙ্ঘ পরিবারের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সব সংগঠন যাতে মিলিত ভাবে নির্বাচনে ঝাঁপাতে পারে, তা নিয়েও সোমবারের বৈঠকে আলোচনা হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। তাঁদের দাবি, নির্বাচনের মতো বিষয় থাকার কারণেই শুভেন্দু ডাক পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, মুকুল রায়ও বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে এই ধরনের বৈঠকে সঙ্ঘের ডাক পাননি। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কিছু পরে হাওড়ার তাঁতিবেড়িয়ায় রাজ্য স্তরের একটি সারা দিনের শিবিরে ডাক পেয়েছিলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.