বামপন্থী মাত্রেই টিপ্পনী কাটেন প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে। ড. মেঘনাদ সাহার ‘সবই ব্যাদে আছে’ – এহেন ব্যাঙ্গোক্তির ঝোল টেনে বামেরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে তাঁর মতো একজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীকেও সহজেই ‘বেদ-বিরোধী’ লেফ্টিস্ট বলে দেগে দিতে কসুর করেনি। কিন্তু নিজেদের দলে টানার অলীক স্বপ্ন দেখতে দেখতে সাময়িক সন্তোষ লাভ করলেও তিনিই যখন ১৯৫৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির রহস্যময় মৃত্যুর তদন্ত দাবী করেন, সেই দাবীর সমর্থনে কিন্তু বাম-বাজনা একটি বারের জন্যও বাজে নি। আর বাজবেই বা কেন? শ্যামপ্রসাদের মৃতদেহ যখন কাশ্মীর থেকে কলকাতায় এল বাংলার মানুষ যাতে সেই শোকযাত্রায় সামিল হতে না পারেন, সেজন্য এক পয়সা ট্রাম-ভাড়া বৃদ্ধিকে সামনে রেখে ধর্মঘট ডেকে কলকাতা অচল করে দিল। রাজনৈতিক চালাকি একেই বলে। শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টায় তৈরি পশ্চিমবঙ্গে বসেই বামেরা বাংলার বারোটা বাজিয়েছেন।
আসলে মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞান সাধনা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামেরই অন্যতর রূপ, যেখানে তাঁর মতো ভারতীয় বিজ্ঞানীরা অন্বেষণের গৌরবময় আঙিনায় নিজেদের তুলে ধরে ভারতবর্ষকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন৷ ১৮৯৩ সালের ৬ ই অক্টোবর এই পদার্থবিজ্ঞানী তথা নিউক্লিয়-গবেষকের জন্ম হয়। এলাহাবাদে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির তিনি ছিলেন প্রথম সভাপতি। যুক্ত ছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস, এশিয়াটিক সোসাইটি, সিএসআইআর, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন সহ নানান প্রতিষ্ঠানে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ গড়ে ওঠে তাঁরই অবদানে।
আলোচনা করবো সাংসদ হিসাবে মেঘনাদ সাহা সেদিন কী বলেছিলেন। “বন্দীদশায় শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুকালীন ঘটনাবলীর পূর্ণ তদন্তের জন্য যে দাবী আমার মাননীয় বন্ধু শ্রীযুক্ত এন সি চ্যাটার্জী উপস্থাপিত করেছেন, আমি সর্বান্তঃকরণে সেই দাবীকে সমর্থন করছি৷ আমি দুই তরফের যুক্তি তর্ক শুনেছি। আমি এই দেখে খুবই মর্মাহত হলাম যে, আমার বিপরীত দিকে যে বন্ধুরা বসে রয়েছেন তাঁরা এই তদন্তের অত্যন্ত সরল ও সহজ দাবীর বিরোধিতা করেছেন। আমি আরও দুঃখিত হলাম এই দেখে যে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু সম্বন্ধে সহস্র সহস্র কংগ্রেস সদস্যকে ব্যক্তিগত আলাপে যে অভিমত ব্যক্ত করতে শুনেছি, সে সম্বন্ধে সংসদে দাঁড়িয়ে উঠে তাঁদের কেউই কিছু খুলে বললেন না,……… আমি জানি না কেন ড. কাটজু (তৎকালীন গৃহমন্ত্রী) তাঁর যাবতীয় আইন-সংক্রান্ত জ্ঞান প্রয়োগ করে তদন্তের এই সামান্য দাবীর বিরোধিতা করেছেন। ড. কাটজুকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি কিন্তু তৎসত্ত্বেও দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি তদন্তের বিরোধিতা করে তিনি যে-সব আইন-সংক্রান্ত যুক্তি-তর্কের অবতারণা করেছেন তা আমাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে নি।……জনসাধারণের সমক্ষে সেই ঘটনাবলী সংক্রান্ত সব তথ্য পেশ করা যেত অনায়াসেই। আমার মনে হয় যে সরকার যদি তদন্তের এই দাবী মেনে নিতেন তাহলে জনসমক্ষে সরকারের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল হত। কিন্তু সরকার সে পথে গেলেন না।”
আজকের দিনে রাজ্যে যখন অধ্যাপক-গবেষক-বিদ্যাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা নানান পদ অলংকার করে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন, তখন মানবাধিকার নিয়ে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার বলিষ্ঠ দৃষ্টান্ত আমাদের এখনও পথ দেখায়, গড্ডালিকা প্রবাহের বাইরেও পথ আছে। তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই।
কল্যাণ গৌতম।